‘মা পেশাগত দায়িত্বের কারণে কখনও পরিবারকে অবহেলা করেননি’

সংশপ্তক হাসান

স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে নতুন এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তাতে যুদ্ধের কোনো ডামাডোল ছিল না। ছিল দেশকে ঢেলে সাজানোর প্রয়াস। সংস্কৃতি অঙ্গনেও লেগেছিল তার আঁচ। এই আন্দোলনে যারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের একজন জিনাত বরকতুল্লাহ। বরেণ্য নৃত্যশিল্পী ও অভিনয়শিল্পী। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে নৃত্য চর্চার বিকাশে তার ভূমিকা ছিল অনাস্বীকার্য। তিনি নৃত্যচর্চা বিকাশেই শুধু ভূমিকা রাখেননি। নৃত্যকলার শিক্ষক হিসেবে ছিলেন দীর্ঘদিন।

জিনাত বরকতুল্লাহর জন্ম কুমিল্লা। তিনি ভাষা আন্দোলনের বছর (১৯৫২) ৩ অক্টোবর পৃথিবীতে আসেন। বাবা ছিলেন কুমিল্লার ডিসি। জিনাত বরকতুল্লাহর পৈত্রিক ভিটা চাঁদপুরে। তবে সেখানে থাকা হয়নি তার। কেননা তার দাদা চাঁদপুর থেকে এসে বসতি গেড়েছিলেন ঢাকার ধানমন্ডির সিদ্দিক বাজারে। ওই সূত্রে তার বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। নাচের সঙ্গে তার সখ্যতা অ আ পড়ার বয়সে। বয়স যখন চার তখন গাজী আলিমুদ্দিন মান্নানের কাছে নাচ শেখা শুরু করেন। পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নাচ শেখেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে। এ সময় ভরতনাট্যম, কথক ও মনিপুরী নাচ বিশেষভাবে রপ্ত করেন তিনি। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শাস্ত্রীয় নৃত্যে শিক্ষা নিলেও নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন লোকনৃত্যে।

ছাত্রী হিসেবেও বেশ মেধাবী ছিলেন জিনাত বরকতুল্লাহ। উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সমাজকল্যাণ বিভাগে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষে জিনাত যোগ দেন সেখানকার পারফর্মিং আর্ট একাডেমিতে। পরে শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত প্রোডাকশন বিভাগের পরিচালক হিসেবে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে নাচের জ্ঞান ছড়িয়ে দেন পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে। দীর্ঘ ২৭ বছর এইদায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

বহুমুখী গুণে গুণান্বিত ছিলেন জিনাত বরকতুল্লাহ। নাচের পাশাপাশি মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন অভিনয়েও। দেশের একজন গুণী অভিনেত্রী হিসেবে তার নাম রয়েছে। অভিনয়ে তার এই যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ সালে। সে বছর ‘মারিয়া আমার মারিয়া’ নামের একটি নাটকে অভিনয় করেন তিনি। নাটকটি প্রচার হয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এরপর একাধিক নাটকে দেখা গেছে বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বকে। তার অভিনয় মুগ্ধ করেছে দর্শককে। ফলে অভিনেত্রী হিসেবেও সমাদর পেয়েছেন তাদের কাছে। অভিনয় ক্যারিয়ারে ৮০টিরও বেশি নাটকে কাজ করেছেন তিনি। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হচ্ছে ‘ঘরে বাইরে’, ‘অস্থায়ী নিবাস’, ‘বড় বাড়ি’, ‘কথা বলা ময়না’।

দেশের নৃত্যচর্চার বিকাশে জিনাত বরকতুল্লাহ একটি মহীরুহর নাম। শিল্পাঙ্গনে তার নাম উচ্চারিত হবে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে। নৃত্যে অবদান রাখায় গুণী এই নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রীকে প্রদান করা হয়েছে অনেক পুরস্কার এবং ভূষিত করা হয়েছে সম্মাননায়। ১৯৮৫ সালে শের-ই-বাংলা স্মৃতি পুরস্কার পান তিনি। এরপর পান নাট্যসভা পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে নৃত্যকলায় ক্যাডেট কোর পুরস্কার পান। দীর্ঘদিন শিল্পকলায় গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন জিনাত বরকতুল্লাহ। প্রতিষ্ঠানটিও তাকে পুরস্কৃত করেছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কারের দশ বছর পর তিনি ভূষিত হন শিল্পকলা একাডেমি পদকে। এছাড়া ইউনেস্কো পুরস্কার, তারকালোক পুরস্কার, সহস্রাব্দ পুরস্কার, অমৃতবাজার পুরস্কার পয়েছেন গুণী এই নৃত্যশিল্পী। জিনাত বরকতুল্লাহ ‘শিল্পকলা’য় বিশেষ অবদান রাখায় ২০২২ সালে একুশে পদক প্রদান করে বাংলাদেশ সরকার।

ব্যক্তিগত জীবনে জিনাত বরকতুল্লাহ বিশিষ্ট টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, প্রযোজক ও পরিচালক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। জিনাত-বরকতুল্লাহ দম্পতির দুই কন্যা বিজরী বরকতুল্লাহ এবং কাজরী বরকতুল্লাহ।

কন্যা বিজরীর কথায় জিনাত বরকতুল্লাহ

বিজরী বরকতুল্লাহ অনুসরণ করেছেন মায়ের পদাঙ্ক। দেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তিনি। পাশাপাশি নৃত্যশিল্পীও। ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকেই তুলেছেন নাচের মুদ্রা। সদ্য প্রয়াত মা জিনাত বরকতুল্লাহকে নিয়ে রঙবেরঙয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিজরীর কথায় উঠে আসে জিনাত বরকতুল্লাহর পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের নানা দিক। জিনাতকন্যা জানান, সংস্কৃতি জগতের গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পথ চললেও তার প্রভাব পড়তে দেননি পরিবারের ওপর। পেশাগত দায়িত্বের কারণে পারিবারিক দায়িত্বে অবহেলা করেননি কখনও।

তিনি বলেন, ‘প্রথমত মা আমার কাছে মা-ই। আমরা ছোটবেলা থেকে কখনও অনুভব করিনি মা একজন কর্মজীবী নারী। কখনও দেখিনি নিজের সন্তান ও পরিবারকে সময় না দিয়ে অন্যক্ষেত্রে বেশি সময় দিয়েছেন। তিনি পরিবারকে যেমন সময় দিয়েছেন তেমনই কর্মক্ষেত্রও সমান প্রাধান্য পেয়েছে তার কাছে। দুই জায়গায় ভারসাম্য রেখে চলেছেন তিনি।’

জিনাত বরকতুল্লাহর কাজের পরিধি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মা’কে দেখেছি দেশকে বিদেশের মাটিতে তিনি রিপ্রেজেন্ট করতেন। তাছাড়া তিনি শুধু শিল্পকলার গুরুত্বপূর্ণ পদেই ছিলেন না। শিল্পকলা প্রতিষ্ঠার পেছনে তার অবদান রয়েছে। এসব কারণে কর্মক্ষেত্রে তার প্রচুর সময় ব্যয় হলেও কখনও মনে হয়নি মা আমাদের সময় দিচ্ছেন না। আমাদের বেড়ে ওঠার পুরো সময়টাই তিনি আগলে রেখেছেন। রোজ অফিস থেকে এসে কাপড় না বদলেই মাকে রান্না ঘরে ঢুকতে দেখতাম। মাকে দেখে শিখেছি দায়িত্ব ও সময়ানুবর্তিতা মেনে যদি কেউ চলে তবে জীবনের সব জায়গায় সমানতালে কাজ করতে পারবেন তিনি।’

বিজরীর কথায় উঠে আসে, তার বাবা-মায়ের একে অন্যের প্রতি গভীর ভালোবাসার কথা। তিনি বলেন, ‘মাকে আমার বাবা শতভাগ উৎসাহ দিতেন। তা না হলে একজন নারীর পক্ষে এতকিছু করা সম্ভব হতো না। আমার মা-ও ওই জায়গাটি ঠিক রেখেছেন। বিশেষ করে আমার বাবার প্রতিটি দায়িত্ব তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। বাবার সব কাজ মা নিজ হাতে করতেন। যেমন বাবার খাবার, চা, নাস্তা সব নিজ হাতে বানাতেন। আমি দেখেছি, যতকিছুই হোক না কেন আমার বাবাকে খাওয়ানোর দায়িত্বটা তিনি কারও হাতে দিতেন না। বাবা খাওয়ার সময় মা পাশে বসে থাকতেন। এই ছোট ছোট জিনিসগুলো যে সংসারে নতুন করে ভালোবাসার জন্ম দেয়, সম্পর্কের পরিচর্যা করে আমরা মার কাছ থেকে শিখেছি। যা আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। তো এসব কারণে মাকে মূল্যায়ন করাটা কঠিন। বিশেষ করে আমার বাবা চলে যাওয়ার পর উনি ভেঙে পড়েছিলেন। তার কাছে চলে যেতে চাইতেন। প্রতিদিন এই কথা বলতেন। ওনাকে খুব মিস করতেন। তবে শেষ পর্যন্ত সান্ত্বনা এটাই যে বাবার কবরের ওপরই মাকে দাফন করা হয়েছে। যেন তারা দুজন একসাথেই আছেন। আমার মা স্বামী স্বামী করেই আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বাবার চলে যাওয়াটা মানতেই পারেননি তিনি। গত তিন বছর ধরে এই জিনিসগুলো আমাদের পরিবারকে আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে।

বিজরী মনে করিয়ে দেন, আজীবন সততা ও সরলতা বুকে পুষে পথ চলতেন জিনাত বরকতুল্লাহ। অভিনেত্রী বলেন, ‘তার ভেতর সততাটা খুব শক্তভাবে ছিল। সততা ও সরলতা শব্দ দুটি আমার মায়ের জন্যই প্রযোজ্য।’

অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার পরও জিনাত বরকতুল্লাহ ছায়ার মতো বিজরীর সাথে থাকতেন। এমনটা উল্লেখ করে বলেন, ‘প্রথম থেকে আমার জীবনের বেশিরভাগ কাজেই আম্মাকে সাথে নিয়েছি। একা ঢাকার বাইরে যেতাম না। বিয়ের আগ পর্যন্ত সব সময় মা সাথে যেত। আমি একটু ভুলোমনা গোছের ছিলাম। এটা সেটা হারিয়ে ফেলতাম। আর ওদিকে মা ঠিকই সেসব গুছিয়ে নিয়ে আসতেন। তিনি খুবই গোছানো ছিলেন। টিপটপ পরিপাটি যাকে বলে। নিজেকে সাজসজ্জায় যেমন পরিপাটি ছিলেন ঘরসংসারেও তেমনই পরিপাটি ছিলেন। ঘরের কাজের ক্ষেত্রে কাজের লোকের ভরসা করতেন না। কাজের লোক থাকুক না থাকুক ঘর ঝাটা দেওয়া, রান্নার কাজটা তিনি হাত লাগিয়ে করে ফেলতেন। আর তিনি ভালো রান্না করতেন।’

নন্দিত এই নৃত্যশিল্পীর ধর্মপরায়ণ ছিলেন। বিজরীর কথায় উঠে আসে বিষয়টি। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা-মা কিন্তু খুবই ধর্মপরায়ন ছিলেন। ২০১০ সালে তারা দুজনই হজ করেছেন। আমার মা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। বাবাও পড়তেন। মা যেখানেই গেছেন পাঁচ মিনিটের বিরতিতে নামাজটা পড়ে নিতেন। এমনকি গাড়িতেও পড়তেন। এটা দেখেই বড় হয়েছি আমরা।’

২০ সেপ্টেম্বর জীবনের লেনাদেনা চুকিয়ে চলে গেছেন জিনাত বরকতুল্লাহ। বেশ কয়েক মাস ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে। সবমিলিয়ে ওই সময়টা হাসপাতাল-বাসা করেই কেটেছে বিজরীর সময়। মায়ের চলে যাওয়াটা এখনও কাঁদায় তাকে। মায়ের শেষ সময়টা তুলে ধরে বলেন, ‘শেষের দিকে তিনি কষ্ট পাচ্ছিলেন খুব। আইসিইউতে যাওয়া, লাইফ সাপোর্টে রাখা, সেখান থেকে ফিরে আসা, আবার যাওয়া। এগুলো ওনার জন্য খুব কষ্টদায়ক ছিল। কিন্তু আমাদের হাতে কিছু ছিল না। সান্ত্বনা এটাই আমরা দুই বোন আমাদের যতটুকু সাধ্য ছিল তার সবটাই করেছি বাবা মায়ের জন্য। রাত দিন ২৪ ঘণ্টা রুটিন করে আমরা তার সাথে থেকেছি। তার ওষুধ খাওয়ানো থেকে সব এভাবেই করেছি।’

মা জিনাত বরকতুল্লাহর থাকা ও না থাকার তফাৎটা কেমন জানতে চাইলে চুপ হয়ে যান বিজরী। কণ্ঠ ধরে আসে তার। কথা বলতে গিয়ে থমকে যান। বুঝতে পারি এটা ব্যাখ্যা করার সামর্থ্য বিজরী কেন কোনো সন্তানেরই নেই। এ কারণেই হয়তো লাকি আখন্দ গান বেঁধেছিলেন, একটা চাঁদ ছাড়া রাত আঁধার কালো, মায়ের মমতা ছাড়া কে থাকে ভালো।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × four =