মিসেস গিন্নি বিবি বউ ওয়াইফ

মাহবুব আলম

ঢাকার অদূরে এক পিকনিকে গিয়ে দেখি ৮/৯ জন নারী বেশ আসর জমিয়ে ফেলেছেন। শীতের সকালে হালকা রোদে আসরের নারীকূলের মুখমণ্ডল বেশ উজ্জ্বল ও চকচক করছে। দূর থেকে মনে হলো, আসরের মধ্যমণি নাদুস-নুদুস এক মধ্যবয়সী নারী। অন্যান্য নারীদের অধিকাংশই মাথায় স্কার্ফ ও হিজাবধারী হলেও ওই নারীর পোশাক-আশাক আটপৌরে চিরচেনা বাঙালির। বোরখা-হিজাব, স্কার্ফ আর পাজামা-কুর্তার প্রতি মোহগ্রন্থের যুগে তিনি শাড়ি ব্লাউজেই নিজের ব্যক্তিত্ব প্রসারিত করে আসরের মধ্যমণিতে পরিণত হয়েছেন। এমনকি তার শরীরে অলংকারের কোনো বাহুল্যও নেই।

এই অবস্থা দেখে খুব ভালো লাগলো। ভালো লাগলো এই জন্য যে, এদের অধিকাংশই গৃহবধূ। এরা সুযোগ পেয়ে উন্মুক্ত খোলা প্রান্তরে প্রাণ খুলে হাসছে। যা ঢাকায় চার দেয়ালে বন্দি অবস্থায় খুব কমই দেখা যায়।

এই অবস্থা দেখে ঘাড় ফেরাতেই দেখি আমার এক সহকর্মী বন্ধু আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তারপর কাছে এসে বললো, ওরা তো দেখি আসর জমিয়ে ফেলেছে। সত্যিই নারীরা পারে বটে। যেখানেই যাক দ্রুত জমাতে পারে। কি বলেন?

Ñতা তো বটেই।

Ñসত্যি বলতে কি আমার মিসেসের জন্যই আসা। ওতো পিকনিকের নাম শুনলেই লাফিয়ে ওঠে। ওই যে দেখছেন না গাছের একটু ছায়া পড়েছে মুখের উপর, কমলা বোরকা পরা, ওই আমার মিসেস। এক মিনিট দাঁড়ান। আমি ডেকে আনছি।

বলে বন্ধুটি নারীদের আসরে গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে আনলো। তারপর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এই হলো আমার মিসেস।

তারপর আমাকে দেখিয়ে বলল, উনি আমার অফিসের কলিগ বড় ভাই মাহবুব আলম। মাহবুব ভাই।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়শই লক্ষ্য করেছি নব্য শিক্ষিতদের অধিকাংশই তার স্ত্রীকে কারো সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলছে, ‘আমার মিসেস’। ভুলেও বলছে না আমার মিসেস তন্বী, তাহসিন বা তাসদিল। আর যারা মিসেস বলছে না তারা বলছে, ‘আমার ওয়াইফ’। এক্ষেত্রেও নামের কোনো বালাই নেই। আরো দেখছি, এক্ষেত্রে তাদের স্ত্রীরাও বেশ গদগদ। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় যে তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হলো এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

এ বিষয়ে ভারতের এক প্রখ্যাত বাঙালি লেখক অনেক আগে লিখে গেছেন, ‘যখন কেউ তার স্ত্রীকে তার মিসেস বলে পরিচয় দেবে তখন ধরে নেবেন সেই ব্যক্তি কোনো সরকারি হোমরা-চোমরা অর্থাৎ আমলা। আর যখন কেউ বলে, আমার বউ লক্ষ্মী বা ইশিতা অথবা ঈশানি তখন ধরে নিবেন সে মাস্টার মশাই না হয় কবি-সাহিত্যিক। আর যখন দেখবেন কেউ বলছে, আমার গিন্নি তখনই বুঝে নেবেন ছা-পোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি।

এ থেকে একদিকে যেমন শ্রেণি অবস্থান স্পষ্ট হয়, অন্যদিকে শ্রেণি উত্তরণের দিকটিও প্রকট হয়ে ওঠে। কারণ এখন শুধু সরকারি আমলারা নন, কর্পোরেট হাউজে কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সাংবাদিকরা পর্যন্ত স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দেয় ‘আমার মিসেস’ বলে। এমনকি এ থেকে কবিরাও বাদ যাচ্ছেন না।

আসলে এটা আর কিছু নয়, স্রেফ দাস মনোবৃত্তি। ইংরেজদের প্রতি দাস মনোবৃত্তি। প্রায় ৮০ বছর হলো ইংরেজরা আমাদের দেশ ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু তারপরও আমাদের দাস মনোবৃত্তির অবসান হয়নি। অবসান ঘটেনি। তারই ফলশ্রুতি ‘আমার মিসেস’, ‘আমার ওয়াইফ’। আসলে দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় ইংরেজরা যে ময়লা-আবর্জনা রেখে গেছে আমরা সেই ময়লা-আবর্জনার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

অবশ্য ময়লা-আবর্জনার মধ্যে ইংরেজরা ভালো কিছু রেখে গেছে, ফেলে গেছে, সেই ভালো কিছুকে কিন্তু আমরা গ্রহণ করিনি। গ্রহণ করার চেষ্টাও করিনি। যদি তা করতাম তাহলে ‘আমার মিসেস’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তার নাম বলে তার অস্তিত্বকে স্বীকার করতাম। জানান দিতাম। কিন্তু না, নব্য শিক্ষিতরা মিসেস শব্দটি শিখেছে। আর তাইতো পাখির মতো এই শেখানো বুলি আউড়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে। এতে যে স্ত্রীর স্বাধীন অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়, তার সত্তাকে বিলীন করে দেওয়া হয়; সে বিষয়ে নব্য শিক্ষিত ও শ্রেণি উত্তরণে কসরত করা স্বামীদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দুর্ভাগ্যজনক এরাই আবার নারী স্বাধীনতার কথা বলে, নারীর অধিকারের কথা বলে, বলে নারী মুক্তির কথা। শুধু বলে তাই নয় এরা এ নিয়ে ফেসবুকে পোস্টও দেয়। অবশ্য ওই পোস্ট দেওয়ার মধ্যেই ওদের ভন্ডামি ধরা পড়ে এদের অলক্ষ্যে। কারণ এই পোস্টে অধিকাংশের স্ত্রীর মুখমণ্ডল নেই।

এছাড়া আরও একটি বিষয় ইদানিং লক্ষ্য করছি যে স্ত্রী, বউ, ওয়াইফ বা মিসেস নয়। বলা হচ্ছে ‘বিবি, আমার বিবি’। বিবি উর্দু ও ফার্সি ভাষায় স্ত্রী বা বউকে বুঝায়। কাজেই এতে দোষের কিছু নয়। কিন্তু হঠাৎ করে এই বিবি বলার প্রবণতার কারণ কি? এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এই প্রশ্নের কোনো সঠিক জবাব আমার কাছে নেই। তবে দেখে-শুনে পরিপার্শিক অবস্থা বিবেচনা করে মনে হচ্ছে এটাও নিজেকে, নিজের পরিবারকে তুলে ধরার নব্য প্রবণতা। এটাও এক ধরনের শ্রেণি উত্তরণের প্রাণান্তর প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে মুসলিম সমাজের আশরাফ আর আতরাপের বিষয়ে। আর তাইতো দেখছি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অজ পাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা প্রথম জেনারেশন যাদের বাড়িতে উর্দু-ফার্সির চর্চা দূরে থাক বাংলা চর্চাই নেই। তারাই এখন কথায় কথা বলে, আমার বিবি-বাচ্চা গ্রামে থাকে। অথবা বলে, এখন থেকে আমার বিবি-বাচ্চা আমার সঙ্গেই ঢাকায় থাকবে।

সব দেখে-শুনে মনে হয় আমরা এক মহা ফ্যাসাদের মধ্যে পড়েছি। তবে এটা ফ্যাসাদ না আপদ তা নিয়ে ইতি টানার সময় এখনও আসেনি। এজন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। হয়তো যুগের পর যুগ। এই নিয়ে আমার এক লেখক বন্ধু কঠিন মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলার বকলম মানুষগুলো দুই লাইন পড়তে শিখে যেমন ভাতরে বলে অন্ন ঠিক এভাবেই একটু-আধটু ইংরেজি শিখে বউকে কয় ‘ওয়াইফ’।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

12 − 4 =