মুক্তিযুদ্ধের শিশুতোষ চলচ্চিত্র: আমরা তোমাদের ভুলব না

মৌ সন্ধ্যা

স্বাধীন বাংলা বেতারের গানটি শোনেননি এমন বাঙালি পাওয়া যাবে না। এখনো নতুন এই গান। গানটি শুনলে মনে এক আলাদা স্পন্দন তৈরি হয়। আমরা আনমনেই গেয়ে উঠি ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে,/ বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা/ আমরা তোমাদের ভুলব না।’ / দুঃসহ বেদনার কণ্টক পথ বেয়ে/ শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা/ আমরা তোমাদের ভুলব না।/ যুগের এ নিষ্ঠুর বন্ধন হতে/ মুক্তির এ বারতা আনলে যারা/ আমরা তোমাদের ভুলব না।/ কিষাণ কিষাণীর গানে গানে,/ পদ্মা, মেঘনার কলতানে,/ বাউলের একতারাতে আনন্দ ঝঙ্কারে/ তোমাদের নাম ঝংকৃত হবে।/ নতুন স্বদেশ গড়ার পথে/ তোমরা চিরদিন দিশারী রবে/ আমরা তোমাদের ভুলব না।’ গানটি লিখেছেন গোবিন্দ হালদার আর সুর করেছেন আপেল মাহমুদ।

‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। আমরা জানবো সেই চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে। তবে তার আগে জেনে নেওয়া যেতে পারে তুমুল জনপ্রিয় এই গানটির পেছনের গল্প। সুরকার আপেল মাহমুদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে বিজয় দিবসের দিন শহীদদের স্মরণে গানটি করা হয়েছিল। এটা লিখেছিলেন কলকাতার গীতিকবি গোবিন্দ হালদার। বিজয় দিবসের দিনই গানটি বেজেছে।’ গানটি প্রথম গেয়েছিলেন স্বপ্না রায়। কুমিল্লার এক কলেজে পড়তেন স্বপ্না। তিনি স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। তিনি আরও অনেকগুলি মুক্তিযুদ্ধের গান গেয়েছেন।

‘আমরা তোমাদের ভুলব না’র মুক্তি

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে কিশোরদের ভূমিকাও কম নয়। তাদের ত্যাগের গল্প নিয়ে শিশু-কিশোরদের উপযোগি করে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে বেশকিছু। এই সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির প্রযোজনায় সিনেমাটি নির্মিত হয় ১৯৯০ সালে। মুক্তি পায় সেই সময়েই। চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন পরিচালক হারুনুর রশিদ।

চলচ্চিত্রের পেছনে যারা

পর্দায় যারা অভিনয় করেন তাদের মানুষ চেনে এবং মনে রাখে। কিন্তু একটা সিনেমা নির্মাণের পেছনে থাকে অনেকের অবদান। এই পেছনের মানুষদের কথা আমরা সাধারণত মনে করি না। সিনেমাটির শব্দগ্রহণে ছিলেন এম এ মজিদ। সম্পাদনা করেন জালাল আহমেদ। সংগীত পরিচালনা করেন আবু তাহের। সাজসজ্জা করেন মাসুদ। ব্যবস্থাপনায় ছিলেন লিটন। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সর্দার জয়েন উদ্দিনের গল্প থেকে এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। চিত্রনাট্য সংলাপ লিখেছিলেন পরিচালক হারুনুর রশিদ নিজেই। সিনেমাটির প্রধান চরিত্রের নাম মতলুব। আবুল হায়াত অভিনয় করেছেন হাতেম নামের এক গ্রাম্য ডাক্তারের ভূমিকায়।

কী আছে সিনেমায়

মতলুব নামের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের কাহিনী নিয়ে ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। এক ঘণ্টা ঊনিশ মিনিট দৈর্ঘ্যরে এই সিনেমার সবচাইতে আকর্ষণীয় চরিত্রটির নাম মতলুব। এই কিশোরকে ঘিরেই চলচ্চিত্রটির গল্প এগিয়েছে। সিনেমার শুরুতেই দেখা যায় অনেকগুলো মুষ্ঠিবদ্ধ হাত। সেগুলোতে লেখা মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান। মুক্তিকামী জনতার কণ্ঠে শোনা যায় সেসব স্লোগান ‘অধীনতা নয় স্বাধীনতা চাই’। এরপর দেখানো হয় কিছু জলরঙে আঁকা ছবি। এরপর কবি শামসুর রাহমানের কবিতা বেজে ওঠে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে, আর কতবার ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায় আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা, শহরের মোড়ে জলপাই রঙের ট্যাংক এলো…।’

এরপর শুরু হয়, আমরা তোমাদের ভুলবো না শিরোনামের গান। এই গানের মধ্য দিয়ে পরিচালক সিনেমার মূল গল্প শুরু করেন। গ্রামের বাড়ির উঠানে মোরগ ডাকছে। নামাজ শেষ করে মতলুবকে ডাকে তার বাবা। মতলুবের মা বলেন মতলুবকে বাজারে পাঠিয়েছেন তিনি। কিছুক্ষণ পরেই বাজার থেকে ফিরে আসে মতলুব। খালি হাতেই বাজার থেকে ফিরে এসেছে সে। মাকে বলে, বাজারে সব দোকান বন্ধ। কিশোর মতলুব বাজার থেকে জেনে আসে অনেক কিছু। সে শুনেছে ঢাকা শহরে খুব গোলমাল চলছে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে সেই গোলমাল। তাই গ্রামের বাজারেও দোকান বন্ধ। মতলুবের কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েন বাবা-মা। কারণ তাদের বড় ছেলে রশিদ ঢাকায় পড়ালেখা করে। বড় ছেলে কোথায় কী অবস্থায় আছে ভাবতে থাকেন তারা।

রশিদের খোঁজ নেওয়ার জন্য বাজারের দিকে ছুটে যান বাবা। একটা রেডিও বাজছে বাজারে। সেটা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বাজারে আসা লোকজন। এমন সময় রশিদের দেখা মেলে বাজারের মধ্যে সে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। গ্রামের লোকজন তাকে দেখে জানতে চায় শহরের অবস্থা। কিছুই বলতে পারে না রশিদ। পরে সব খুলে বলতে চায়। এমন সময় রশিদের দেখা পান বাবা। তাকে সাথে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। সন্তানকে ফিরে পেয়ে খুশি হন মা। রশিদ বাবা-মা’কে শোনায় ঢাকা শহরে দেখে আসা ভয়ংকর ঘটনার কথা। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ ঢাকায় ছাত্রদের উপর হামলা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। রশিদের চোখের সামনে অসংখ্য ছাত্রদের মেরে ফেলা হয়েছে। কারফিউ চলছে। রশিদ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে এসেছে।

গ্রামেও পাকিস্তানিরা হানা দিতে পারে যখন তখন। ভয়ে শঙ্কিত সবাই। মতলুব-রশিদদের গ্রামের মানুষরাও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গ্রামের ডাক্তার, দারোগা, কৃষকসহ সকল পেশার মানুষ একত্রিত হয়। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা গ্রামে ঢোকার রাস্তা কেটে রাখবে। গাছ কেটে ফেলে রাখবে রাস্তায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সাহস যোগায় সবাইকে। সেই ভাষণ শুনতে শুনতে সবাই কাজে লেগে পড়ে।

গ্রামের মানুষের এই সামান্য প্রতিরোধ উপেক্ষা করে পাকিস্তানি আর্মির গাড়ি গ্রামে প্রবেশ করে। নির্বিচারে গুলি করে ওরা। গ্রামের মানুষদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। মতলুবের চোখের সামনে বাবা-মা দুজনই শহীদ হন। বৃদ্ধ-শিশু সবাইকে মারতে থাকে হানাদার বাহিনী। বেঁচে যায় মতলুব ও তার ভাই রশিদ। ডাক্তার হাতেম চাচাও বেঁচে থাকে। সে তার বাড়িতে নিয়ে আসে মতলুবদের। রশিদ মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায়। এর মধ্যে আসে মুকিম নামের একজন। হাতেম ডাক্তারকে নানা খবর দিয়ে যায় সে। রশিদ যুদ্ধে চলে যায়। হাতেম ডাক্তারের কাছে থেকে যায় মতলুব। সেও যুদ্ধ করতে চায়।

একদিন হাতেম ডাক্তারকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। অনেক নির্যাতন করে তাকে। অবশেষে পাকিস্তানিদের চিকিৎসা দেওয়ার বিনিময়ে রক্ষা পায় তার প্রাণ। অন্যদিকে সেই গাঁয়ে পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করে কয়েকজন রাজাকার। তারা গাঁয়ের মানুষের ছাগল, মুরগি কেড়ে নিয়ে যায়। রাজাকারের নাতি কাঞ্চন মতলুবের ভালো বন্ধু। তার মাধ্যমে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে কৌশলে ঢুকে পড়ে মতলুব। ওদিকে রশিদও মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এক সময় সেও ধরা পড়ে পাকিস্তানিদের হাতে। ডাক্তার হাতেমের সহযোগিতায় মুক্ত হয় রশিদ। নিজ গ্রামে অপারেশন করে। মেরে ফেলে রাজাকারকে।

এরপর রাজাকারের নাতি কাঞ্চনের সাথে কথা হয় মতলুবের। এক সময় মতলুব জানতে পারে কাঞ্চন রাজাকার হতে চায় না সেও মুক্তিযুদ্ধে যাবে। এরপর ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা। মতলুবও শহীদ হয়। পাকিস্তানি আর্মির কমান্ডারকে খতম করতে গিয়ে প্রাণ দেয় সে। সিনেমায় মতলুবের অভিনয় দেখে চোখে পানি চলে আসবে। এমন হাজারো মতলুবের জীবনের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’ সিনেমাটি মানুষ পছন্দ করেছিল। অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে এই সিনেমা, এখনো ইউটিউব চ্যানেলে দর্শক উপভোগ করছে। রাষ্ট্রীয় সম্মানেও ভূষিত হয়েছে সিনেমাটি। ১৯৯০ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে এই সিনেমা। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার পায় এটি।

ইউটিউবে ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’

এখন খুব সহজেই দেখার সুযোগ আছে এই সিনেমাটি। জিডি চয়েস নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে রয়েছে এটি। সেখান থেকে অনেকেই দেখেছে সাদা কালো এই সিনেমাটি। দর্শক তাদের অনুভূতিও ব্যক্ত করেছে কমেন্টে। এক ব্যক্তি কমেন্ট করেছেন, ‘এই মুভিগুলো সরকারি খরচে আধুনিক প্রিন্ট করে সযত্নে রাখা উচিত। যাতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানতে পারে।’ অন্য আরেকজন লিখেছেন, ‘এগুলো আমাদের সম্পদ, ভবিষ্যতের সঞ্চয়। এগুলো আরও ভালোভাবে সংরক্ষণের জন্য সরকারের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’

আমরাও বলতে চাই, যত্নে সংরক্ষিত হোক এসব ইতিহাসনির্ভর সিনেমাগুলো। এছাড়াও আরও অনেক মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মাণ হোক। তরুণ প্রজন্ম আমাদের শেকড়ের সন্ধান পেয়ে যাবে এসব সিনেমায়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eighteen − seven =