মুজিব: একটি জাতির রূপকার

১৩ অক্টোবর ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটি বাংলাদেশে রেকর্ড সংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন ভারতীয় নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল। বাংলাদেশের পর ভারতসহ বিশ্বব্যাপী ২৭ অক্টোবর মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। সিনেমাটি দেখে জানাচ্ছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত।

গল্প: ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটির প্রেক্ষাপট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। পিরিওডিক্যাল ওয়েতে শ্যাম বেনেগাল পর্দায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন কাহিনি তুলে ধরেছেন। বায়োগ্রাফিক্যাল ঘরানার সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে দেখা যায় একজন বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনদর্শন তুলে ধরা হয়। নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল সিনেমার গল্পের ক্ষেত্রে সেদিকেই নজর দিয়েছেন। মোটাদাগে বলা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের প্রতিটি পিরিয়ড নিয়ে আবর্তিত হয়েছে সিনেমাটি।

চিত্রনাট্য: বায়োগ্রাফিক্যাল সিনেমায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিত্রনাট্য। কেননা গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তির সম্পূর্ণ জীবনের ভিজ্যুয়ালাইজেশন হবে পর্দায়। অন্যান্য আট-দশটা সিনেমার চেয়ে এই ঘরানার সিনেমার চিত্রনাট্য খুবই নিখুঁতভাবে সাজাতে হয়। প্রতিটি সিকুয়েন্স সূক্ষ্মভাবে লিখতে হয়। সিনেমার চিত্রনাট্য যৌথভাবে লিখেছেন দুই ভারতীয় অতুল তিওয়ারি ও শামা জাইদি। সিনেমায় উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে টুঙ্গিপাড়ায় বেড়ে ওঠা। কলকাতায় পড়াশোনা করা থেকে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়া; সবকিছুই উঠে এসেছে চিত্রনাট্যে। চিত্রনাট্য সুলিখিত।

অভিনয়: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী দশের অধিক অভিনয়শিল্পী কাজ করেছেন সিনেমাটিতে। মাল্টি কাস্টিং। বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিব্যজ্যোতি আর বড়বেলার চরিত্রে আরিফিন শুভ। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন দুজন অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা ও দীঘি। তরুণী বয়সের চরিত্রে দেখা যায় দীঘিকে ও প্রাপ্তবয়স্ক চরিত্রে দেখা যায় তিশাকে। ছবিতে তিশাকে রাখা হয়েছে ন্যারেটর ও রেণু চরিত্রে। তাকে এই গুরুত্ব দেওয়াটা খুব ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে। অভিনেত্রী হিসেবে তার যে অবস্থান সেটার সাথে সুবিচার করা হয়েছে। তিশার গল্পকে ন্যারেট করার ধরন ছিল বেশ স্পর্শকাতর। তিশা যেকোনো সময়ের জন্যই এখনও নির্ভরযোগ্য অভিনেত্রী এটা তিনি প্রমাণ করেছেন নিজের পারফরম্যান্সের মাধ্যমে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মহাত্মা গান্ধীর অভিনেতাদের গেটআপ একদম হুবহু ছিল। এই দুই চরিত্রে পশ্চিমবঙ্গের পেশাদার অভিনেতা ছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদের চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু দারুণ পারফরম্যান্স করেছেন। সিনিয়র অভিনেতাদের দিয়ে করানো চরিত্রগুলো এ ছবিতে বড় ভূমিকা রেখেছে তাদের অভিনয়শক্তির কারণে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চরিত্রে তৌকীর আহমেদকে ভালো লেগেছে। সোহরাওয়ার্দীর চরিত্রে তৌকীর সেই গাম্ভীর্যটা আনতে পেরেছেন। মওলানা ভাসানীর চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ প্রমাণ করে দিয়েছেন যে আসাদ একজনই। গেটআপ আর অভিনয় একশো তে একশো।

রিয়াজ ছবিতে তাজউদ্দীন আহমেদের চরিত্রে ছিলেন, তার গেটআপ ভালো হলেও অভিনয়টা সাদামাটা লেগেছে। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মধ্যবয়সী চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। তিনিও বেশ ভালো করেছেন। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শামসুল হকের চরিত্রে সিয়াম আহমেদের উপস্থিতিতে দর্শক কমিক রিলিফ পেয়েছে। সিরিয়াস গল্পের মাঝে সিয়ামের চরিত্রটা হলের দর্শকদের হাসিয়েছে। টিক্কা খানের চরিত্রে জায়েদ খানকেও দেখা গেছে কয়েক সেকেন্ডের জন্য।

 

আরিফিন শুভ পুরোটা সময় নিজেকে প্রমাণ করেছেন। অনেকে আপত্তি করেছিলেন তাকে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে কাস্ট করায়। আপনি সিনেমাটা দেখলে আঁচ করতে পারবেন চরিত্রটা তিনি ছাড়া আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না। প্রতিটি সিকুয়েন্সে তার ডেডিকেশন ও কষ্ট ফুটে উঠেছে। চরিত্রটার সঙ্গে তার মিশে যাওয়া লক্ষ্য করা গেছে। সিনেমার প্রতিটি চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীরা সর্বোচ্চটা দিয়ে নিজের কাজটা করতে চেয়েছেন।

টেকনিক্যাল দিক: সিনেমার কারিগরি দিক মন্দ বলার সুযোগ নেই। ক্যামেরা হাতে মুন্সিয়ানা দেখানোর চেষ্টা করেছেন আকাশদীপ পাণ্ডে। ভারতীয় পরিচালক শান্তনু মৈত্র মিউজিকের দায়িত্ব ছিলেন। সম্পাদনা খারাপ লাগেনি। গ্রাফিক্সের ব্যবহার আরেকটু ভালো করার সুযোগ ছিল অবশ্যই। ৮৩ কোটি টাকা বাজেটের সিনেমায় সেট আরো পরিপক্ব হওয়া উচিত ছিল। গল্পের যে আবহ সে অনুযায়ী সেট নির্মাণ করা হয়নি। মেকআপে দুর্বলতার ছাপ দেখা গিয়েছে। বাংলার বুকে জন্ম নেওয়া সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির জীবনের গল্প বলা সিনেমার টেকনিক্যাল দিকগুলো আরো যত্নসহকারে করার সুযোগ ছিল নিঃসন্দেহে।

সংগীত: ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমায় একটি মাত্র গান ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম গানটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রকে কেন্দ্র করে। ‘অচিন মাঝি’ শিরোনামের গানটি লিখেছেন বাংলাদেশের গীতিকার জাহিদ আকবর। সংগীত পরিচালনা করেছেন ভারতের শান্তনু মৈত্র এবং গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ভারতের শিল্পী রথীজিৎ ভট্টাচার্য। কয়েক দশক আগে গ্রামগঞ্জে মাইক, সাউন্ডবক্সের প্রচলন ছিল না। তখন বিয়ে বা সুন্নাতে খতনাতে গ্রামের মা-চাচিরা গায়ে হলুদ দেওয়ার সময় এক ধরনের আঞ্চলিক গীত গাইতেন। গোপালগঞ্জ জেলার সেই ধরনের আঞ্চলিক গীত ব্যবহার করা হয়েছে। ‘কি কি জিনিস এনেছো দুলাল বিবি সখিনার লাইগা’ শিরোনামের আঞ্চলিক এ গীতটির মূল সংগ্রাহক গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া গ্রামের গৃহিণী রাশেদা বেগম। প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি তার সংগ্রহে রেখেছেন এ গীতটি। দুই বছর আগে রাশিদা বেগমের ভাতিজা আলাল আহমেদের মাধ্যমে গানটি নেন ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রটির সংলাপ তত্ত্বাবধায়ক সাধনা আহমেদ। গানটির সংগীত পরিচালনা করেছেন শান্তনু মৈত্র এবং গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন উর্মি চৌধুরী। সিনেমায় বিয়ের মুহূর্তে গানটি বেজে ওঠে। গানটি আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। এই ছবিতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, রণসঙ্গীতও ব্যবহৃত হয়েছে।

নির্মাণ: উপমহাদেশের অন্যতম গুণী নির্মাতাদের একজন শ্যাম বেনেগাল। তিনি কালজয়ী কিছু কাজ করেছেন বায়োগ্রাফিক্যাল সিনেমা ঘরানায়। নির্মাতা হিসেবে তিনি চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের সবকিছুই তুলে ধরার। কলকাতার বেকার হোস্টেলের জীবন, বঙ্গবন্ধুর বিয়ে, শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য সন্তানদের জন্ম, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, সোহরাওয়ার্দীর সাথে ঘনিষ্ঠতা, বার বার গ্রেপ্তার হওয়া, ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বারের বাড়ি, ছয় দফা ঘোষণা ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি হায়েনাদের আত্মসমর্পণ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে তার ফিরে আসার ঘটনা, স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়ন, নির্বাচন, বাকশাল গঠন, শেখ কামাল ও শেখ জামালের বিয়ে, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বিদেশ গমন এবং শেষমেশ ৭৫’র ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর দুঃখজনকভাবে নিহত হবার ঘটনা দিয়ে শেষ করেন ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ ছবিটি। নির্মাতা হিসেবে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো আরেকটু ভালো করা যেত। কিছু চরিত্র নির্বাচনে আরেকটু নজর দেওয়া যেত।

নেগেটিভ দিক: আরিফিন শুভ নিঃসন্দেহে সেরা পারফর্ম করেছেন সিনেমায়। কিন্তু শুভর ভয়েস নিয়ে খানিকটা আক্ষেপ তৈরি হয়েছে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বপূর্ণ মনে হয়নি আরিফিন শুভর ডায়ালগ ডেলিভারি। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল অসাধারণ পরিমিতিবোধের। তিনি দ্রুতগতিতে কথা বলেননি। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ হলেও দাঁড়ি, কমা মেনেই কথা বলেছেন অনবদ্য ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে। কিন্তু শুভর ক্ষেত্রে ৭ই মার্চের ভাষণের সেই আবহটা পাওয়া যায়নি। সিনেমা মুক্তির পর বেশ কিছু তথ্যগত ভুল দেখা গিয়েছে। যেহেতু সিনেমাটিতে হিস্টোরিকাল পিরিয়ড রয়েছে বেশ কিছু সেহেতু পরিপূর্ণ রিসার্চ করে সকলের সামনে উপস্থাপন করা প্রয়োজন ছিল, তাহলে আলোচনার জন্ম হতো না। সিনেমার ভিএফএক্স নিয়ে সমালোচনার জায়গা আছে। কিছু দৃশ্যে অরিজিনাল ফুটেজ ব্যবহার করার দরকার ছিল বলে মনে হয়েছে।

পজিটিভ দিক: জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের ৪৮ বছর পর তার জীবনী নিয়ে সিনেমা বানাতে পেরেছি আমরা এটা অবশ্যই প্রাপ্তির বিষয়। সবকিছুর মিশেলে একটা পরিপূর্ণ ফিচার ফিল্ম হয়ে উঠতে পেরেছে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমা। মুক্তির পূর্বে যে ধরনের ভয় আর শঙ্কা ছিল তা তিন ঘণ্টা দৈর্ঘ্যরে সিনেমাটি দেখে তা হাওয়ায় উড়ে গেছে, অতল জলে ডুবে গেছে অস্বস্তির বাতাবরণ। সিনেমাটি মাস্টারপিস হয়নি, তবে ভালো লাগার অনেকগুলো জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তা বলতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সিনেমালজি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

six − 5 =