মৃত্যুর ষোলো বছর পর ফিরলেন মান্না

রোজ অ্যাডেনিয়াম

ঢাকাই সিনেমার সুপারস্টার ছিলেন চিত্রনায়ক মান্না। তার পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার। তবে তার আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল এই মান্না নামেই। দীর্ঘ সময় রাজত্ব করেছেন বাংলা সিনেমায়। তার নামেই হলের আসন পূর্ণ হয়ে যেতো। সপ্তাহের পর সপ্তাহ জুড়ে সিনেমা চলতো। ১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল জন্ম নেওয়া প্রিয় এই মানুষটির জীবন সমাপ্তি ঘটে ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, মাত্র ৪৩ বছর বয়সে। তাকে হারিয়ে অন্ধকারে ছেয়ে যায় ঢালিউডের আলো ঝলমলে আকাশ। মান্নার কোটি কোটি ভক্তরা তাকে হারিয়ে চোখের জলে বুক ভাসান। এরপর পার হয়ে গেছে অনেক সময়। জন্মদিন-মৃত্যুদিনে নায়ককে স্মরণ করেছেন তার ভক্তরা। অনেকে আক্ষেপ করেছেন তাদের নায়ক যদি আবারও ফিরে আসতেন, কতই না ভালো হতো!

ফিরে এলেন মান্না

প্রযুক্তির কল্যানে অনেক কিছুই হচ্ছে এখন। প্রযুক্তি ব্যবহার করে মৃত্যুর প্রায় ১৬ বছর পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সহায়তায় ঢাকাই সিনেমার সুপারস্টার চিত্রনায়ক মান্নাকে পর্দায় ফেরানো হয়েছে। আগের ঠিক সেই মান্না না হলেও তারই মতো অবিকল একজনকে দর্শক আবারও দেখেতে পাচ্ছেন পর্দায়। বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনিভিত্তিক সিরিজ ‘ব্ল্যাকস্টোন’এ খলনায়কের ভূমিকায় হাজির করা হয়েছে মান্নাকে।

মান্না এখন খলনায়ক

অ্যাকশনধর্মী ‘ব্ল্যাকস্টোন’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে ১ এপ্রিল। ব্ল্যাকস্টোন বেশ প্রশংসাও পেয়েছে দর্শকের। এআইয়ের মাধ্যমে হলিউডি সিনেমায় প্রয়াত তারকাদের দেখা গেলেও ঢাকাই সিনেমা, সিরিজে প্রয়াত তারকার ফেরা এই প্রথম। প্রথমবারের মতো ঢালিউডের কোনো প্রয়াত তারকাকে পর্দায় ফেরানো হয়েছে। মান্নাকে উৎসর্গ করে সিরিজটি নির্মাণ করেছেন তরুণ নির্মাতা শাহরিয়ার গালিব। ব্ল্যাকবক্স স্টুডিওর ইউটিউব চ্যানেলে সিরিজটির প্রথম পর্ব মুক্তি পেয়েছে। ২২ মিনিটের এই পর্বের শেষভাগে মান্নার দেখা মিলেছে ১০ সেকেন্ডের মতো। এতে গ্রেগঅন নামের এক খলচরিত্রে আছেন মান্না। যিনি এক রহস্যময় পাথরখণ্ডের খোঁজে মহাবিশ্ব থেকে পৃথিবীতে নেমে আসেন। নির্মাতা শাহরিয়ার গালিব এক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এআই ব্যবহার করে হলিউড সিনেমায় প্রয়াত শিল্পীদের ফিরিয়ে আনতে দেখি। হলিউডের সিনেমা দেখেই আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। দেশে এটা তেমন দেখিনি।’

কী আছে এই সিরিজে?

সিরিজের গল্পে দেখা যায়, মহাকাশ থেকে ঝরে পড়া এক রহস্যময় পাথরখণ্ডের স্পর্শে এক তরুণের জীবন বদলে যায়। সেই পাথরখণ্ডের খোঁজে পৃথিবীতে মান্নার চরিত্রের (গ্রেগঅন) আগমন। সিরিজের নির্মাতা বলেন, ‘মহাকাশ থেকে একটা পাওয়ারফুল পাথর এসে পৃথিবীতে পড়ে। সিনেমার প্রধান চরিত্রের নজরে পড়ে সেই পাথর। সেটি ছুঁয়ে ফেলার পর তার ওপর একটা ম্যাজিক্যাল শক্তি ভর করে। এরপর তার দৈনন্দিন জীবনের সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। এক ধরনের ঘোরের ভেতরে থাকে সে। এভাবেই তার সঙ্গে বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে এগিয়েছে সিরিজের কাহিনি।’ সিরিজটি প্রযোজনা করেছেন রবিউল করিম। এতে অভিনয় করেছেন মোহাম্মদ রাফি, ইয়াসিন আরাফাত, ভৌমিক সরকার ও শাহরিয়ার কবির। দৃশ্যধারণ হয়েছে চট্টগ্রামে।

এআই কী?

এআই এর পূর্ণরূপ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। চিন্তাশক্তি, বুদ্ধি কিংবা বিশ্লেষণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি মানুষের। কিন্তু একটি যন্ত্রকে মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, সেটিকে চিন্তা করানো কিংবা বিশ্লেষণ করানোর ক্ষমতা দেওয়ার ধারণাটিকে সাধারণভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলা হয়। কোনো যন্ত্রকে দিয়ে মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তার কাজ করানোর চিন্তা এক সময় ছিল কল্পনা। কিন্তু এখন সেটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হতে শুরু করেছে। তার প্রধান কারণ, পৃথিবীর মানুষ ডিজিটাল বিশ্বে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে যে, হঠাৎ করে অচিন্তনীয় পরিমাণ ডেটা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই ডেটাকে প্রক্রিয়া করার মতো ক্ষমতাশালী কম্পিউটার আমাদের হাতে চলে এসেছে। এই ডেটা বা তথ্যকে প্রক্রিয়া করার জন্য বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদরা এমন একটি পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন যেটি মানুষের মস্তিষ্কের মতো করে কাজ করে। সাধারণভাবে এটা নিউরাল নেট নামে পরিচিত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানত সিসি প্লাস, জাভা, ম্যাথ ল্যাব, পাইথন, প্রোলগ ইত্যাদি প্রোগ্রাম ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করা হয়। কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীতার ভিত্তিতে ডেভেলপারগণ তাদের পছন্দসই প্রোগ্রাম ব্যবহার করে থাকেন। এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেকোনো মানুষের মুখাবয়ব, কণ্ঠস্বর প্রায় হুবহু অনুকরণ করা যায়।

পর্দায় মান্নাকে ফেরানো

কেন নায়ক মান্নাকে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ফেরানো হলো? পরিচালক শাহরিয়ার গালিব এক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সিরিজটি অ্যাকশনধর্মী হওয়ায় মান্নাকে উপযোগী মনে হয় আমার। মান্নার মতো দেখতে একজন শিল্পীকে নির্বাচন করি, তার চুলের স্টাইলও মান্নার মতো। তাকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছি। এরপর সেই ফুটেজে এআই সফটওয়্যারের মাধ্যমে মান্নার মুখায়ব বসানো হয়েছে। এতে সময় লেগেছে দুই দিন। এআই প্রযুক্তি খুব ব্যয়বহুল। মান্নার ১০ সেকেন্ডের ক্লিপটি তৈরিতে শুটিং, সম্পাদনাসহ প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। মান্নার পরিবারের অনুমতি না নেওয়ায় ১০ সেকেন্ডের বেশি মান্নাকে পর্দায় রাখতে পারিনি। কোনো প্রয়াত তারকাকে উৎসর্গ করে ১০ সেকেন্ডের মতো দৈর্ঘ্যরে ক্লিপ রাখা যায়। আমরা এই ক্লিপ থেকে কোনো আয়ও করিনি। পরিবারের অনুমতি পেলে আগামী পর্বে আরও বেশি সময় ধরে মান্নার দেখা মিলতে পারে।’

সিনেমায় এআই প্রযুক্তি

কয়েক দশক আগে থেকেই হলিউডে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু হয়েছে। এআই ব্যবহার করে সিনেমা নির্মাণ, চিত্রনাট্য লেখা, অভিনয়, কণ্ঠাভিনয় থেকে চলচ্চিত্রের প্রায় সব কাজই করা যায়। এআইয়ের ব্যবহার এখন আরও বেড়েছে। এআইকে কাজে লাগিয়ে প্রয়াত অভিনয়শিল্পীদের পর্দায় ফেরানো আরও সহজ হয়ে গেছে। ‘স্টার ওয়ারস’ সিরিজের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ক্যারি ফিশারের মৃত্যুর পর তার পুরানো ফুটেজের সঙ্গে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার করে তাকে সিরিজে হাজির করা হয়েছে। ডিপফেক প্রযুক্তিতে ‘ইন্ডিয়ানা জোনস’ সিনেমায় ৮০ বছর বয়সী হ্যারিসন ফোর্ডের বয়সও কমিয়ে ফেলা হয়েছিল। টালিগঞ্জে ‘অতি উত্তম’ সিনেমায় উত্তম কুমারকে হাজির করেছেন নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি। হলিউডের দেখানো পথে এআইয়ের মাধ্যমে ‘মহারাজা ডেনিমস’ নামে একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এআইয়ের মাধ্যমে ভারতীয় এক সিনেমায় প্রয়াত দুই শিল্পী বাম্বা বাক্য ও শাহুল হামিদের কণ্ঠে গান করেছেন এ আর রাহমান।

প্রথম এআই সংবাদপাঠক

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংবাদ পাঠ করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপরাজিতা। ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘চ্যানেল ২৪’ এর সন্ধ্যা ৭টার বুলেটিনে যুক্ত হয়ে সংবাদ উপস্থাপন করে অপরাজিতা। গত কয়েক বছর ধরেই প্রযুক্তি দুনিয়ায় দাপট দেখাচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আগামীতে কৃত্রিম মেধা ব্যবহার করে কোন কোন ক্ষেত্রে বিপ্লব আসবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা।

সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে সংবাদ সঞ্চালনার বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে ‘ফেদা’ নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দিয়ে সংবাদ পাঠ করায় কুয়েত নিউজ। ২০২৩ সালের ৯ জুলাই ভারতের একটি বেসরকারি টেলিভিশন, ওড়িশা টেলিভিশন লিমিটেড (ওটিভি) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দিয়ে সংবাদ পাঠ করায়। যার নাম ছিল লিসা। যা নিয়ে ভারত-বাংলাদেশে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়।

শেষকথা

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার খুব একটা ব্যবহার দেখা না গেলেও বিজ্ঞাপনচিত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হয়। নির্মাতা পিপলু খান ইতিমধ্যে বিজ্ঞাপনচিত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু করেছেন। বিশেষ করে স্বাধীন নির্মাতাদের জন্য এইআই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। মান্নাকে নিয়ে এমন সিরিজ নির্মাণ ভালোভাবেই নিয়েছেন মিডিয়া বোদ্ধারা। এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরো অনেক ভালো কিছু হোক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × two =