মেঘ দেখে কেউ করিস না ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে

সালেক সুফী: বাংলাদেশ-শ্রীলংকা চলতি টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে আজ টস জয়ী বাংলাদেশ ব্যাটিং করার ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু দুই স্বল্প অভিজ্ঞ লংকান পেসার প্রথম ঘণ্টায় কালবৈশাখী ঝড় তুলে লণ্ডভণ্ড করে দিলো বাংলাদেশের রক্ষণদুর্গ। তামিম,  জয় ফিরলো শূন্য হাতে। প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টায় শান্ত-মোমিনুল উবে গেলো। সাকিব ফিরলো সোনার হাঁস নিয়ে।

২৪ রানে ৫ উইকেট হারানো বাংলাদেশের তীরহারা ঢেউয়ের সাগরে তখন দুই সাহসী মাঝি মুশফিক-লিটন ধরলো হাল। উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার পণ করে তারা এগুলো সাহসী ছন্দে। ওদের বীরোচিত ব্যাটিং শুধু বিপদ পেরিয়ে বাংলাদেশের তরী সঠিক পথেই ফিরিয়ে নেয়নি, দিন শেষে বাংলাদেশকে পৌঁছে দিয়েছে স্বস্তির বন্দরে। দিন শেষে ২৭৫/৫ করে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে চালকের আসনে।

দিনশেষে আবারো টেস্ট ক্রিকেট বলে দিলো সকাল দেখে বিকেল আঁচ করা বোকামি। কেউ কি সকাল দেখে বুঝেছিল মুশফিক-লিটনের যুগল সেঞ্চুরি বাংলাদেশকে মেঘলা সকাল শেষে আলোকিত দিন উপহার দিবে। দিনশেষে ১৩৫ রানে ব্যাট করছিলো লিটন। এটি ওর ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান,  তৃতীয় টেস্ট সেঞ্চুরি। আর মুশফিকের ৯ম সেঞ্চুরির ইনিংসটি এখন ১১৫ দাঁড়িয়ে। যেভাবে মুশফিক খেলছেন কেউ কি আজ বলবে, মুশফিকের কোনো বিকল্প নাই?  দুজনের অজেয় জুটিতে যোগ হয়েছে ২৫৩ রান। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস যত বড়ো হবে ততই চাপ সৃষ্টি হবে অতিথি দলের উপর।

ইতিহাস বলে ঢাকার উইকেটে স্পিন ধরবেই। চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে সাকিব-তাইজুলকে মোকাবিলা করা সহজ হবে না। রয়েল বেঙ্গল টাইগার্সদের অভয়ারণ্য মিরপুরের শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। এখানে খেলা শেষ ৮টি টেস্ট ম্যাচের পাঁচটি জিতেছে বাংলাদেশ। স্পিন ফাঁদ তৈরি করে আইসিসি ডিমেরিটস পেয়েছে।

নতুন তৈরি উইকেটটিতে হয়তো ময়েশ্চার ছিল। কাসুন রঞ্জিতা আর ফার্নান্দোর প্রথম ৬ ওভার কিছুটা সুইং ছিল। তবে এমনভাবে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে বাংলাদেশ ব্যাটিং সেটি কাক্ষিত ছিল না। যেন বৈশাখী ঝড়ে কাঁচাআম পাকাআম টুপটাপ ঝরছিল। মাঠে আসা আইসিসি চেয়ারম্যান আজ বাংলাদেশ টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের আনাড়িপনা দেখেন। যেভাবে আউট হয়েছে বাংলাদেশ টপ অর্ডার, রিপ্লে দেখে যে কেউ লজ্জা পাবে।

দুর্বল পায়ের কাজের খেসারত দিয়ে কাসুনের ইনসুইং বলে শূন্য রানেই ফিরলো জয়। পা বাড়িয়ে ডিফেন্ড হয়তো করা যেত। ব্যাট-প্যাডের মাঝদরজা খোলা ছিল। অভিজ্ঞ তামিম ফের্নান্ডোর লেগ স্ট্যাম্পে পড়া একটু লাফিয়ে ওঠা বল ভুল খেলে সহজ ক্যাচ তুলে শূন্য রানে বিদায় নিলো। ৬/২ কেঁপে উঠলো টাইগার শিবির।

এমনিতেই উষ্ণ আবহাওয়ার অস্বস্তি, তারপর শুরুতেই যুগল আঘাত সামাল দেওয়ার মতো ধৈর্য, দক্ষতা বা কৌশল নেই শান্তর। জয়ের মতোই ব্যাট-প্যাডের দুয়ার খুলে উইকেট হারালো শান্ত। নড়বড়ে ফর্মে থাকা মোমিনুল ছিটকে গেলো। মোমিনুল আড়াআড়ি যেতে থাকা বল খেলবো কি খেলবো না ভেবে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলো। এমনকি সাকিবকে পরিকল্পনা করে প্রথম বলে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেললো রঞ্জিতা। ভাগ্য সহায় ছিল না। আম্পায়ার্স কল না হলে সাকিব রক্ষা পেতো।

৭ম ওভারে ২৪/৫ উইকেট হারানোয় যখন অনেকেই বাংলাদেশের ভেঙে পড়ার শঙ্কায় ছিল। ঝরাপালকের ধ্বংসস্তূপে ঘুরে দাঁড়ানোয় বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। দেয়ালে পিঠ রেখে উঁচু মানের ব্যাটিং করে মুশফিক-লিটন দলকে টেনে তুললো গভীর গিরিখাত থেকে। লাঞ্চ অবধি দ্বিতীয় ঘণ্টা কথাই নেই। লাঞ্চ এবং চা বিরতির মাঝেও অবিচ্ছিন্ন জুটি নতুন মাইল ফলকে পৌঁছালো। ওদের স্বচ্ছন্দ ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে ওরা দুইজন যেন ভিন্ন উইকেটে খেলছে। প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দিয়ে দুইজনই প্রতি আক্রমণ করে রানের গতি সচল রেখেছে। যতই সময় গেছে প্রবল আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে দুজন ব্যক্তি মাইলস্টোন আর স্বস্তির দলীয় সংগ্রহের দিকে আগুয়ান হয়েছে।

ওদের ব্যাটিং দেখে ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময় দক্ষিণের তীরহারা নদীতে নৌকায় ভাসার স্মৃতি মনে পড়ছিলো। তখন স্বাধীন বাংলা বেতারের গান ‘তীর হারা এই ডেউয়ের সাগর পাড়ি দিবো রে’ আমাদের সাহস জাগাত। অথই সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকা দুই মাঝি তেমনি করে আজ ডেউয়ের সাগর পাড়ি দিলো। মুশফিককে বাকযুদ্ধে তাতিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব কেউ নিলে অবাক হবো না।

মুশফিক-লিটনের মাইলফলক জুটি ছিল বাহারি স্ট্রোকস সমৃদ্ধ। ওদের উঁচু মানের ব্যাটিং অতিথি দলকে হকচকিয়ে দিয়েছিলো। লিটনের ব্যাটিং যদি হয় বাউন্ডলে কবি নজরুলের একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, মুশফিকের ব্যাটিং ছিল কবিগুরুর সোনার তরীর স্বচ্ছন্দ প্রবাহ। যেখানে বাংলাদেশ দিনশেষে পৌঁছেছে বলবো না ম্যাচ থেকে ছিটকে গেছে শ্রীলংকা। তবে চালকের আসনে বাংলাদেশ বলতেই পারি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

thirteen + eighteen =