আতিয়া আনিসা
এ বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছেন আতিয়া আনিসা। ‘পায়ের ছাপ’ সিনেমার ‘এই শহরের পথে পথে’ গানের জন্য এ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। তার ক্যারিয়ার বছর তিনেকের। এরইমধ্যে যা অর্জন করেছেন তা অন্যদের তুলনায় বেশি। ওই জায়গা থেকে আতিয়া আনিসাকে সংগীতের আকাশে উদীয়মান তারা বলা যায়। সম্প্রতি এ গায়িকার সঙ্গে কথা হয় রঙবেরঙ-এর।
জাতীয় পুরস্কারের খবর পেয়ে কেমন লেগেছিল?
এটি একজন শিল্পীর সর্বোচ্চ সম্মাননা। এতো বড় সম্মাননা ক্যারিয়ারের এতো অল্প সময়ে পাব বিশ্বাসই হচ্ছিল না। স্বপ্নেও ভাবিনি। তখন ঘুমাচ্ছিলাম। আম্মু আমাকে ডেকে তুলে বললেন, কি যেন সুখবর আছে তোমাকে সবাই ফোন করছে। উঠে দেখো। আমার এক কলিগ আমাকে প্রথম খবরটা দিল। কল করে বললো, হোয়াটসআপ চেক করতে। ওখানে দেখলাম বিজয়ীদের তালিকা। দেখে খুব ভালো লাগছিল। স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। সবার অনেক শুভকামনা পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম অনেক বড় সম্মাননা অর্জন করেছি।
প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার মুহূর্তটা কেমন ছিল?
আমি অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলাম। কেননা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এতো কাছে থেকে কখনও দেখিনি এর আগে। ছোটবেলায় একবার সুযোগ হয়েছিল। ২৬ মার্চে আর্মি স্টেডিয়ামে মার্চপাস্ট হয় সেখানে অংশ নেওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। কিন্তু অসুস্থতার কারণে যাওয়া সম্ভব হয়নি। একটা আক্ষেপ ছিল। এরপর যখন জাতীয় পুরস্কারে নাম এলো তখন থেকেই দিন গুনছিলাম। যেদিন পুরস্কার দেওয়া হলো আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম ওনাকে অনেক কিছু বলবো। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই উনি আমার সাথে কথা বলতে লাগলেন। বললেন, গানটা অনেক সুন্দর ছিল। তুমি অনেক ভালো গেয়েছো। ওনার এই প্রশংসা আমাকে অনেক উৎসাহিত করেছে। খুব ভালো লেগেছে। এরপর ওনার সাথে ছবি তোলার সময় আমি জায়গা পাচ্ছিলাম না। সিনিয়র অনেকে ছিলেন। তাদের জায়গা দিতে গিয়ে পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম। খুব খারাপ লাগছিল। ওই আক্ষেপ থেকে পেছন থেকে চিৎকার করে বলেছিলাম, আপা আমি আপনার সাথে ছবি তুলব। তখন উনি আমাকে পেছন থেকে ডেকে একদম পাশে এনে দাঁড় করান। তখন আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম। ওনার হাত শক্ত করে ধরেছিলাম। পরে ভয় পেয়ে যাই। প্রধানমন্ত্রীর হাত এভাবে শক্ত করে ধরেছি! কিন্তু তিনি বললেন, ধরো অসুবিধা নাই। উনি অনেক ভালো মনের মানুষ। ওনার উপদেশ আমাকে ভীষণ অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। আমি আজীবন ওনার কথা মানার চেষ্টা করব।
গানটি এতবড় সম্মান বয়ে আনতে তা ভেবেছিলেন?
সেরকম মনে হয়নি। কিন্তু যখন কণ্ঠ দেই তখন গানটির সাথে আর যারা জড়িত ছিলেন যেমন গীতিকার সাইফুল ইসলাম মান্নু আর সংগীত করেছেন শওকত আলী ইমন। ওনারা বলেছিলেন গানটি খুব ভারী একটি গান। নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে এ গান করা হয়েছে। গল্পটাও তেমন ছিল। একজন নারী কখনও হাল ছাড়ে না। বিভিন্ন বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আসে। এমন থিমের ওপর গানটা বানানো। আমি খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম একজন নারী হিসেবে। তবে সম্মাননা তো অবশ্যই বড় একটি প্রাপ্তি। আর এ ধরনের গান করাটাও একজন শিল্পী হিসেবে অনেক আনন্দের। এটা আমার জীবনে ঘটায় আমি খুবই আনন্দিত।
জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর দায়বদ্ধতা বেড়েছে?
অবশ্যই দায়বদ্ধতা বেড়ে যায়। এটা একটা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। সেটা আমাকে দেওয়া হয়েছে। আমার দায়িত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনো কাজ করতে গেলে আগের চেয়ে অনেক বুঝে শুনে করতে হবে। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। এটা আমার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কথায় আছে না, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। আমার জন্যও বিষয়টা ওরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে। চেষ্টা করে যাব, বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।
আপনার গান শুরুর গল্পটি কেমন?
ছোটবেলা থেকেই আমার মাঝে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সুর ছিল। এজন্য আমি স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ। গান আমার তেমন একটা শেখা হয়নি। তবে একদম শিখিনি যে তা না। আমার ভেতরে যে সুর ছিল সেটা আমার মা খেয়াল করেছিলেন। তার ইচ্ছায়ই পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতে গান শেখা শুরু করি। পরিবারের সবার সমর্থন ছিল। এরপর থেকে আস্তে আস্তে চলতে থাকে। তবে নিরবচ্ছিন্নভাবে গান শেখা হয়নি। কিন্তু সবাই বলে আল্লাহর একটা রহমত আমার মধ্যে আছে। আমার কণ্ঠ তার প্রদত্ত। তো ওই জায়গা থেকে বললে সৃষ্টিকর্তাই আমাকে গুণটি দিয়েছেন।
প্রফেশন হিসেবে শুরুটা কেমন ছিল?
আমার পুরো জার্নিটাই স্বপ্নের মতো। কারণ ছোটবেলা থেকেই প্লেব্যাকে আগ্রহ ছিল। স্বপ্ন ছিল বড়পর্দায় আমার গান বাজবে। আর আমি তো প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এসেছি। সেরাকণ্ঠে ছিলাম। সেসময় যতবার গান গেয়েছি বিচারকগণ বলেছেন আমার কণ্ঠ প্লেব্যাকের জন্য উপযুক্ত। এই প্রতিযোগিতার পর আমি প্লেব্যাকে সুযোগ পাব। সেটাই হয়েছে। প্রথম কল আমাকে ইমরান মাহমুদুল ভাইয়া দেন। ওনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমার প্রথম গানই ছিল প্লেব্যাক। ‘যদি একদিন সিনেমা’র জন্য ‘চুপকথা’ গানটি গেয়েছিলাম। ইমরান ভাই একরকম ঝুঁকি নিয়ে আমার ডেমো ভয়েস নিয়েছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে সেটি ছবির নির্মাতা মোস্তফা কামাল রাজ ভাই পছন্দ করেন। এরপর আরও অনেক সিনেমায় সুযোগ পাই। আমাদের শোবিজে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাডওয়ার্ড; তিনটিই প্লেব্যাক ক্যাটাগরিতে আমি পেয়েছি।
প্লেব্যাক, স্টেজ ও অডিও কোন মাধ্যমে স্বচ্ছন্দ্য?
তিনটিই গানের জায়গা। গান যেখানে আছে আমি সেখানেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তিনটিতে তিন রকম আনন্দ। শুরু থেকেই নিজের মৌলিক গান নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছি। পারফর্মার হয়ে থাকতে চাইনি। যাদের গান শুনে বড় হয়েছি তাদের অনুসরণ করে চেয়েছি মৌলিক গান দিয়ে যুগ যুগ টিকে থাকতে। এছাড়া স্টেজে গাওয়ার নেশাটাও আছে। সবকিছু গানকে ঘিরেই হচ্ছে।
মৌলিক গান করা বেশ চ্যালেঞ্জের। কী মনে হয়?
এটা সম্পূর্ণ ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। আর ভাগ্যটা নির্ভর করে আপনার কর্মের ওপর। বাকিদেরটা আমি জানি না। তবে আমার ক্ষেত্রে বলবো ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই আমি গানের ক্ষেত্রে নিবেদিত। নিজেকে সবসময় কাজে রেখেছি। আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। উড়ে এসে জুড়ে বসিনি ইন্ডাস্ট্রিতে। তিন বছরের ক্যারিয়ারে আমার মৌলিক গানের সংখ্যা ষাটের অধিক। এরমধ্যে কয়েকটা ভাগ্যক্রমে মানুষের মাঝে পৌঁছেছে। একটি হলো ‘চল নিরালায়’। আমি শুধু আমার কাজটিই করে গেছি। কী হবে সেটা ভাবিনি।
দশ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
ভবিষ্যত পরিকল্পনা আমার কখনও করা হয় না। বর্তমানকেই বেশি প্রাধান্য দেই। তবে লক্ষ্যের কথা যদি বলেন, আমি এখন যেভাবে কাজ করছি সেভাবেই করে যেতে চাই সুস্থভাবে।
সংগীতের বাজার নাকি মন্দা, আসলেই কী তাই?
ভালো খারাপ সবসময়ই আছে। ভালো গান যেমন হচ্ছে, ফ্লপ গানও তেমন হচ্ছে। এ বছর আমাদের অনেক ভালো গান বেরিয়ে এসেছে। গত বছর পরাণ সিনেমার গান, হাওয়ার গান। এ বছর প্রিয়তমার গান, সুড়ঙ্গের গান ভালো হয়েছে। তো আমরা গানই ফোকাস করি। এটাই সবার জন্য ভালো।
আজকাল অসুস্থ গানও বেশ ছড়াচ্ছে। এটা কী রুচির অবক্ষয়?
শ্রোতার রুচি নষ্ট হোক আর যাই হোক সুস্থ গানগুলোই কিন্তু টিকে থাকবে। অন্যগুলো না। কাজেই ভালো গানটাই সামনে আসা উচিত। আর যেগুলোকে অসুস্থ বললেন সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া উচিত। কেননা আমরাই এগুলো ভাইরাল করি।
স্পটিফাই নিয়ে কতটা আশাবাদী?
আমি শতভাগ আশাবাদী। কেননা এটি একটি বৈশ্বিক প্লাটফর্ম। এর মাধ্যমে সুস্থ গানকে সামনে আনা যাবে।
বর্তমান ব্যস্ততা কী নিয়ে?
টিভি শো নিয়ে বেশ ব্যস্ততা রয়েছে। পরাণ ছবির ‘চলো নিরালায়’ গানটির পর প্রচুর টিভি শো থেকে ডাক পাচ্ছি। যেহেতু আমি টিভি থেকে এসেছি ওই জায়গাগুলোতে আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল, ফলে প্রায়ই টিভি থেকে ডাক পাই। পাশাপাশি স্টেজ শো থেকে ডাক পাচ্ছি। এছাড়া প্লেব্যাক ও নাটকের গানের ব্যস্ততা রয়েছে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সুরের মূর্চ্ছনা