ইরানী বিশ্বাস
পরিবারে সবচেয়ে কম স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিটি হলেন ওই পরিবারের নারী সদস্য। নারী নিজেকে সর্বংসহা মনে করেন। বাঙালি পরিবারে একটি মেয়ে ছোট থেকে বেড়ে ওঠে ভিন্ন দর্শন নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই তাকে বোঝানো হয়, মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে সংসারে তাকে সব গঞ্জনা মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। বেশিরভাগ পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী ব্যক্তি হচ্ছেন পুরুষ। তাই পুরুষের অসুখ-বিসুখে অবহেলা না করে দ্রুত ডাক্তার দেখানো হয়ে থাকে। যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তান, স্বামী, বাবা, ভাই যারই অসুখ হোক পরিবারের নারী সদস্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে তাকে সারিয়ে তুলতে। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে পরিবারের সকলের সেবা করেন।
এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনো কারণে মানসিক সমস্যায় ভুগছে। প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ১৮ শতাংশের বেশি মানুষ বিষণ্নতায় আক্রান্ত, যাদের বেশির ভাগই নারী।
মেন্টাল ডিজঅর্ডার বা মানসিক সমস্যা। বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, জিনতত্ত্ব এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জটিল ক্রিয়ার ফলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ও কর্মক্ষমতার বিপর্যয়কে মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যা বলে। এটি একটি মানসিক ও ব্যবহারিক পরিবর্তন। যা নিয়ম-নীতি, সমাজ, সংস্কৃতি বা স্বাভাবিক জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অজ্ঞতা আর অসচেতনতা মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যার মূল কারণ। সাধারণত কয়েকটি কারণে মানসিক রোগ হতে পারে। এর মধ্যে ১. দুশ্চিন্তা, অবসাদ ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ২. বংশগত কারণ ৩. বিভিন্ন শারীরিক রোগ ৪. শারীরিক দুর্বলতা ৫. যৌন দুর্বলতা ৬. মাথায় আঘাতজনিত প্রদাহ ৭. অল্প বয়সে পুষ্টিহীনতা ৮. ভিটামিনের অভাব ৯. ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ১০. মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের ত্রুটি ১১. অতি সন্দেহ ১২. অর্থ আয়ের দিকে মনোনিবেশের কারণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।
নারীরা নিজেদের রোগ সম্পর্কে সচেতন নন। তাদের মধ্যে অসুখ লুকানোর প্রবণতা খুব বেশি থাকে। তাই জ্বর, ঠান্ডা-কাশির মতো সামান্য অসুখ কখনোই আমলে নেন না। এমনকি পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ধারনা, কয়েকদিন গেলে এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। পরিবারের নারী সদস্যদের শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে এমনই ধারনা হয়ে এসেছে যুগে যুগে। বিশেষ করে শ্বশুর বাড়িতে সবচেয়ে বেশি অবহেলা করা হয় নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে।
শারীরিক স্বাস্থ্যই যেখানে অবহেলিত, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায়? অবিবাহিত বা বিবাহিত মেয়েদের মানসিক সমস্যা হলে পরিবারের সদস্যরা বদনামের ভয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিতে চায় না। এছাড়া আমাদের দেশে নারী বা পুরুষ কেউ-ই নিজেকে মানসিক রোগি হিসেবে মেনে নিতে চায় না। বর্তমান সময়ে সচেতনতার কারণে অনেক পুরুষ নিজে থেকে কাউন্সিলিং করতে বা চিকিৎসার জন্য মানসিক ডাক্তারের কাছে যায়। তবে নারীদের ক্ষেত্রে এখনও এর প্রচলন হয়ে ওঠেনি।
আজ যে কন্যাশিশুটি বেড়ে উঠছে, আগামী দিনে সে-ই হয়ে উঠবে কোনো এক পরিবারের কর্ত্রী। সংসারের সবার দেখভালের দায়িত্ব তার কাঁধেই বর্তাবে। তাই কিশোরির বয়ঃসন্ধিতে যেমন তার মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দরকার, তেমনি যে নারী, হয়তো মা বা কারো স্ত্রী বিশেষ বয়সে এসে মুখোমুখি হচ্ছেন মেনাপজ সমস্যার, তারও ঠিক সমানভাবে স্বাস্থ্যসেবা দরকার। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে সকল নারীর মানসিক স¦াস্থ্যসেবা প্রয়োজন।
দুনিয়াজুড়ে নারীরা সবচেয়ে বেশি মানসিক সমস্যায় ভোগে। আর এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। একটি মেয়ের বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন ধরনের শারিরিক পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবন প্রবাহিত হয়। এই প্রতিটি শারীরিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানসিক পরিবর্তনও ঘটে থাকে। প্রকৃতিতে যেমন ৬টি ঋতু নানান বৈচিত্র্যে হাজির হয় প্রত্যেকের আলাদা সৌন্দর্য নিয়ে, তেমনি নারীর জীবনেও প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আসে। আর এসব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হয় প্রাপ্তবয়সের দিকে।
কৈশরের প্রথম ধাপে একটি মেয়ের শরীরে বাড়তি অঙ্গ সংযোজন হওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় তার শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন। এই সময়টাকেই বলে বয়ঃসন্ধিকাল। বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যেখানে এসে একটি মেয়ে শিশু, কিশোরিতে পরিণত হয়। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ও ভালো লাগার একটি সময় বয়ঃসন্ধিকাল। বয়সের এই স্টেজগুলোতে সকলকেই একই সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। আমাদের দেশে শিশু বা কিশোরিদের শরীরে এই পরিবর্তন সম্পর্কে আগে থেকে ধারনা দেওয়া হয় না। তাই আকস্মিক শারীরিক পরিবর্তন অনেক সময় মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। অনেকেই এই পরিবর্তন সহজে মেনে নিতে পারে না। ফলে সমস্যাগুলো নিজের মধ্যে চেপে রেখে এক সময় মানসিক সমস্যা তৈরি হয়।
অধিকাংশ নারীর পারিবারিকভাবে দেখে-শুনে বিয়ে হয়। সেক্ষেত্রে যার সঙ্গে বিয়ে হবে বা তার পরিবারের সঙ্গে মেয়েটির খুব বেশি জানাশোনার সুযোগ থাকে না। তাই বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে মেয়েটি উৎকণ্ঠায় দিন কাটায় শ্বশুর বাড়ির মানুষজন কেমন হবে। তাদের সঙ্গে অ্যাডজাস্টমেন্ট হবে কি না। স্বামী ব্যক্তিটিই বা কেমন হবেন। তাকে মানিয়ে নিতে বা মেনে নিতে পারবে কি না। এসব অনেক অজানা বিষয়ে মানসিক উদ্বিগ্নতা থেকে একসময় মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এরপর আছে গর্ভধারণের বিষয়। অনেক মেয়ে আছেন যারা গর্ভধারণে অক্ষম থাকেন। তাদের মধ্যে এক অজানা আতংক সার্বক্ষণিক তাড়িয়ে বেড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর পুনরায় বিয়ে বা শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে অপবাদ শোনা এ যেন চিরাচরিত প্রথা। এছাড়াও রয়েছে গর্ভপাতের মতো ঘটনা। একটি নারী যখন প্রথম মা হওয়ার খবর জানতে পারে তখন থেকে সে নিজের মধ্যে আগত সন্তানকে ঘিরে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। হঠাৎ সেই স্বপ্নের ছন্দপতন কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। অনেকেই তাৎক্ষণিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আবার অনেকে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অসুস্থ হতে থাকে। তাছাড়া নারীর গর্ভধারনের সময় বিষণ্নতা আসতে পারে। বিষণ্নতা অনেক সময় মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি মানসিক যত্ন নেওয়া জরুরি।
প্রসবের পর ও মেনাপজ বা মাসিক বন্ধ হওয়ার সময় হরমোনের তারতম্যের কারণে নারীর বিষণ্নতাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ সময় সঠিক চিকিৎসা না দেওয়া হলে পরবর্তীতে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। নারীরা সাধারণত বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, হিস্টিরিয়া বা স্মরণশক্তি কমে যাওয়ার মতো সমস্যায় বেশি ভোগেন। প্রজনন চক্রের প্রভাবে অনেক সময় মানসিক সমস্যা হয়ে থাকে। এছাড়া থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যার কারণেও অনেক সময় নারীর মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। নারীদের মধ্যে বিষণ্নতার হার পুরুষের তুলনায় দ্বিগুন। তাই আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর ৪০ শতাংশই বিষণ্নতার কারণে ঘটে থাকে।
আগের তুলনায় কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে। কর্মস্থলে পুরুষ আধিপত্যের কারণে অনেক সময় নারীর মানসিক চাপ থাকতে পারে। পুরুষ পরিবেষ্টিত কর্মস্থলে নারীদের লিঙ্গবৈষম্য, সমসুযোগের অভাব, যৌন হয়রানি, কাজের চাপ ইত্যাদি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এ কারণে প্রতিনিয়ত নারীদের মানসিক চাপের পরিমাণ বেড়ে যায়। যা বিভিন্ন অসুখের জন্ম দেয়। মানসিক রোগির মেজাজ বা মুড পরিবর্তন চক্রের মধ্যে আবর্তিত হতে পারে। কখনো উত্তেজনা বা উন্মত্ততায় মন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে। আবার কখনো অহেতুক দুঃখে মন অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়তে পারে। এটা কিছু সময়ের ব্যবধানে যেমন হতে পারে, তেমনি কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক মাস ধরেও চলতে পারে। এই পরিবর্তন যে মানসিক সমস্যার লক্ষণ, তা অনেক সময় অতি নিকটজনেরাও বুঝে উঠতে পারে না।
করোনার করালগ্রাসে বিশ্ব বিপর্যস্ত হয়েছিল। স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ হারিয়ে অনেকেই মানসিক বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। ফলে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ে মানসিক রোগির সংখ্যা। এরমধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি। সরকারি হিসাবে পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও ঢাকার জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে করোনার আগের তুলনায় এখন মাসে প্রায় ৮০০ থেকে এক হাজার রোগি বেশি আসছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, চাকরি হারানো, ব্যবসায় ধস কিংবা প্রিয়জনের মৃত্যুর সময় কাছে থাকতে না পারার বেদনায় অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
এক জরিপে দেখে গেছে, করোনায় সময় নারীর মানসিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাকরি বা কাজ হারিয়ে দিশাহীন পুরুষ ঘরের স্ত্রীকে মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে। অনেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আবার দীর্ঘদিন বাইরে বের হতে না পেরে একই রুটিনে অভ্যস্ত হওয়া নারীরা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
দুনিয়াজুড়ে পুরুষের তুলনায় নারী সবচেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে। একজন নারীর শারীরিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থসেবা অত্যাবশ্যক। মানসিক চিকিৎসার জন্য আলাদা কোনো হাসপাতাল নয়। কারণ এই হাসপাতালে প্রবেশ করা এবং বের হওয়া অনেকের জন্য লজ্জাজনক বলে অনেকেই এখানে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। যদি অন্যান্য রোগের চিকিৎসার মতো প্রত্যেক হাসপাতালে মানসিক চিকিৎসার জন্য বিভাগ নিশ্চিত করা হয়, তাহলে সকলেই মানসিক চিকিৎসায় উৎসাহী হবে। সুতরাং প্রত্যেকটি সরকারি হাসপাতালে এবং কমিউনিটি হাসপাতালে অন্যসব রোগের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ