যে দিবস বলে নারী অধিকারের কথা

ঋষিকা

দিবস পালন করা হয় কোনো বিষয়কে গুরত্বপূর্ণ করে তুলতে। পৃথিবীতে হাজার হাজার দিবস আছে। তার মধ্যে একটি দিবস হলো নারী দিবস। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই নর আর নারী মিলিয়েই এই পৃথিবী। মানুষ কিছু অধিকার জন্মগতভাবেই নিয়ে জন্মায়। তবে অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সেই আদি যুগ থেকেই। কিছু কিছু ব্যাপারে এর পরিবর্তন ঘটলেও এখনও অনেক কিছুই নারীদের অধিকারের বাইরে।

কৃষি ও খাদ্যসংস্কৃতিতে সেই প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে নারীদের অবদান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষণা, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে উদ্যোক্তা হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন নারীরা। কখনো দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন খেলায়, কখনো রাজনীতিতে, কখনো অর্থনীতি কিংবা সামাজিক যেকোনো আন্দোলনে। নারীদের অবদান ও কাজকে সম্মান জানিয়ে সারাবিশ্বে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পূর্বনাম আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস। প্রতি বছর মার্চ মাসের ৮ তারিখে এই দিবসটি পালিত হয়। দিবসটি কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উদ্্যাপনের মুখ্য বিষয় হয়, আবার কোথাও নারীদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা বেশি গুরুত্ব পায়।

নারী দিবসের ইতিহাস

১৮৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। তারা মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামেন। সেই মিছিলে চলে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি নারী সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে নেতৃত্ব দেন জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন। এটিই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন ছিল। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। এরপর ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালন করা হতো। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এই দিবসটি পালন করা হতে শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবী জুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় নিয়ে। বিশ্বের সকল দেশে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

নারী দিবসের প্রতিপাদ্য

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৪-এর থিম ‘অন্তর্ভুক্তিকে অনুপ্রাণিত করুন।’ যখন নারীরা অনুভব করে যে তারা নিজেদের অন্তর্গত এবং গুরুত্বপূর্ণ, তখন তারা আরও শক্তিশালী এবং আরও ক্ষমতায়িত বোধ করে। জাতিসংঘ বলছে, যদি নারীরা ইন্টারনেট ব্যবহার না করেন অথবা অনলাইনে নিরাপদ বোধ না করেন তবে তারা ডিজিটাল দুনিয়ায় জড়িত থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবেন না, যা তাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত সম্পর্কিত পেশা অর্জনের সুযোগ কমাবে। শিল্প-সাহিত্যসহ সব ক্ষেত্রে এবং সমাজের সমস্ত কাজে নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতেই এ দিনটি পালিত হয়। লিঙ্গবৈষম্য দূর করার জন্য এই দিনটি পালিত হয়। প্রতি বছর নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হয় দিনটি।

মূলত তথ্যপ্রযুক্তির উপর্যুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে নারীকে অনুপ্রেরণা জোগাতে এই বছরের নারী দিবসের সেøাগান নির্বাচন করা হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, বর্তমানে আমাদের জীবন শক্তিশালী প্রযুক্তিগত একীকরণের ওপর নির্ভর করে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যেকোনো কাজ যেমন প্রিয়জনকে কল করা, ব্যাংক লেনদেন করা বা একটি মেডিকেল অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করা সবকিছু একটি ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। তা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী ৩৭ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। পুরুষদের তুলনায় ২৫৯ মিলিয়ন নারীর ইন্টারনেটে কম প্রবেশাধিকার রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ চাকরি এই ক্ষেত্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। ফলে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীর কম পদচারণার কারণে উন্নয়ন ও লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

নারী দিবসের রঙ

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ওয়েবসাইট অনুসারে বেগুনি, সবুজ এবং সাদা হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবসের রঙ। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিজেদের ভোটাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সাদা ও সবুজ রঙকে নারী দিবসের রঙ হিসেবে ব্যবহার করতেন ব্রিটেনের নারীরা। তাদের মতে, বেগুনি রঙ দিয়ে ন্যায়বিচার এবং মর্যাদাকে বোঝানো হয়। সবুজ আশার প্রতীক; আর সাদা বিশুদ্ধতার। যদিও এই ধারণা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ১৯০৮ সালে যুক্তরাজ্যের উইমেন’স সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইউনিয়ন এই রঙগুলোকেই নির্দিষ্ট করেছিল। তবে নারীমুক্তি আন্দোলনের জন্য উপযুক্ত রঙ হলো বেগুনি। নারীরা সমাজের জন্য লড়াই করছেন – এ বিষয়টি ফুটিয়ে তুলতে বেগুনি রঙ যথার্থ বলেই বিবেচিত হয়েছে। বেগুনি রঙ হলো অর্জনের প্রতীক। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্যান্টন বেগুনি রঙকে নারী দিবসের রঙ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এই বেগুনি দিয়ে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে বোঝানো হয়। নারীরা হবে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির মতো শক্তিশালী।

নারী ও তাদের অধিকার

সারা বিশ্বে সকল ইতিহাসে দেখা গেছে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা যুদ্ধের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হন নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা। সকল দেশেই নারীদের অপুষ্টির হার পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। বিশ্বজুড়ে যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, অপুষ্টি, দারিদ্র্য এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছে, তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো নারী। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোতে সম্প্রতি নারীদের গর্ভপাতের অধিকার নিয়েও চলেছে আন্দোলন। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই নয়, পশ্চিমের অনেক দেশেও অধিকারের জন্য এখনও লড়ছেন নারীরা। আফগানিস্তান, ইরান, ইউক্রেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো অনেক দেশে নারীরা তাদের নিজ নিজ দেশে যুদ্ধ, সহিংসতা এবং সরকারি নীতি পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করে গেছেন। সেই লড়াই চলছে এখনও। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানে নারীদের জীবনযাত্রার উপরে নেমে এসেছে চরম প্রতিবন্ধকতা। সেখানে নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষা ও চাকরি নিষিদ্ধ করা হয়; এমনকি বাড়ির বাইরে যেতে হলেও বৈধ পুরুষ সঙ্গী নিয়ে যাওয়ার নিয়ম জারি করে তালেবান সরকার। স্কুল বন্ধ করে দিলেও এক পর্যায়ে তা বিধি নিষেধের মোড়কে বেঁধে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেয় তালেবান শাসকেরা। ইরানেও নারী অধিকারের বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গেল বছর সেপ্টেম্বরে ঠিকভাবে হিজাব না পরার অভিযোগে ২২ বছরের তরুণী মাহসা আমিনিকে গ্রেপ্তার করে তেহরানের নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশ। এরপর পুলিশি হেফাজতেই তার মৃত্যু হলে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সেই বিক্ষোভে নারীরা নিজেদের মাথার স্কার্ক বা হিজাব খুলে, আগুনে পুড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। সেই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন ইরানের পুরুষরাও।

দিবস পালনে ভিন্নতা

৮ মার্চের আগে-পরের ৩/৪ দিন এসব দেশে ফুলের বিক্রি বেড়ে হয় প্রায় দ্বিগুণ। চীনের অনেক স্টেট কাউন্সিলের বিবেচনায় ৮ মার্চ নারীদেরকে অর্ধেক দিনের ছুটি দেওয়া হয়। রাশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ইতালিতে দিনটি নারীদের ফুল দেওয়ার মাধ্যমে উদ্্যাপিত হয়। ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর এ ঐতিহ্যের উৎপত্তি অস্পষ্ট; তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এটি রোমে শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়। মার্চ মাসকে নারীদের ইতিহাসের মাস বলে মনে করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। প্রতিবছর আমেরিকান নারীদের কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রেসিডেন্ট একটি ঘোষণাপত্র জারি করেন এই দিনে।

নারী দিবস ও বাংলাদেশ

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) জেন্ডার অসমতাবিষয়ক ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২২’-এ বলা হয়েছে, নারী সমাজের কথা বিবেচনা করে ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। অথচ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৪৮তম। ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র অনুযায়ী ৯৭৬৪টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৪৩৬০টি, ধর্ষণের পর হত্যা ৪৫০টি, দলবদ্ধ ধর্ষণ ২৪০টি, যৌতুকের জন্য মারধর ২৬৭৫টি, যৌতুক না পেয়ে হত্যা ১৫৫টি, অপহরণ ১৮৭০টি, অন্যান্য ১৪টি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে নারীরা। বিভিন্নভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে তারা। উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে নারী নির্যাতন। ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২৩’ শিরোনামে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) প্রকাশিত একটি পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩ সালে ৬২৩ জন নারী ও ৭৬৮ জন শিশু ও কিশোরী যৌন নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। মহিলা পরিষদের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৭৬৬ নারী ও কন্যাশিশু।

দেশে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী নির্যাতন আইন সংশোধন করা হয়েছে। নারী সংক্রান্ত একমাত্র আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সনদ হলো সিডও। এই সনদের মূল বিষয়, নারীর প্রতি সব প্রকার বৈষম্য বিলোপ বা দূরীকরণ। যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক সব ক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এই সনদে স্বাক্ষর করলেও দেশে নারীরা এখনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। তারা পিতার সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন ক্ষেত্রবিশেষে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 − two =