রংতুলিতে আঁকা সিনেমার ব্যানার

ঢাকার মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকার ১৭ নম্বর সড়কের ১০০৮ নম্বর বাসা। বিশাল আয়তনের সেই বাসায় ৯ দিন ধরে একটি সিনেমার ব্যানার এঁকে সম্পন্ন করেছেন মো. শোয়েব ও তাঁর দল। গতকাল সকালে যখন আলাপ হয়, তখন তাঁর মুখে স্বস্তির হাসি। জিজ্ঞেস করলাম, কত দিন পর আবার আঁকলেন? জানালেন, ২০০৬ সালের পর এই প্রথম। অর্থাৎ মাঝখানে চলে গেছে ১৭ বছর। এই প্রায় দুই দশক একসময়কার সিনেমার ব্যানার মাধ্যমের কিংবদন্তিসম শিল্পী মো. শোয়েব কোনো সিনেমার ব্যানার আঁকেননি! জানতে চাইলাম, কারণ কী? তিনি খুলে বসলেন তাঁর অভিজ্ঞতার ঝাঁপি। আর আমি ভাবতে বসলাম পৃথিবীর সিনেমার ইতিহাসে ভুলে যাওয়া এক দারুণ অধ্যায়ের কথা, যা ছিল আমাদের নিজস্ব।

বিশাল ক্যানভাসে উজ্জ্বল রঙে আঁকা নায়িকার বিলোল কটাক্ষ। নায়কের সুপুরুষোচিত অবয়ব। খলনায়কের ক্রূর অভিব্যক্তিসহ সিনেমার বিভিন্ন কলাকুশলীর বিচিত্র দেহভঙ্গি। সঙ্গে লেখা সিনেমার নামসহ অন্যান্য তথ্য। হলের উঁচু জায়গায় টানানো বলে সহজেই চোখে পড়ে। সেসব দেখে দর্শকের সারি বড় হয়। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যাঁরা বড় হয়েছেন এ দেশের গ্রাম কিংবা শহরে, তাঁদের এ দৃশ্য ভুলবার নয়। এ ব্যানার দেখে কতজন যে বাবার পকেট কেটে কিংবা মায়ের কাছে বায়না ধরে সিনেমা দেখার টাকা জোগাড় করেছেন, তার হিসাব সিনেমার কোনো লিখিত ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষদের কাছে, গল্পের সূত্রে।

একসময় সিনেমার চরিত্র ও বিশেষ দৃশ্য নিয়ে ছবি আঁকা হতো হলের দেয়ালে। সেই চিত্রের শিল্পী হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছেন পিতল রাম সুরসহ আরও কয়েকজন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সিনেমার দেয়ালচিত্র আঁকিয়ে যেসব শিল্পী ভারত থেকে এ দেশে আসেন, তাঁরা শুরু করেন ব্যানার আঁকার প্রচলন। সেই সূত্রে পঞ্চাশের দশক থেকে এ ভূখণ্ডে শুরু হয় সিনেমার ব্যানার আঁকার চল। সেটা ২০০০ সালের প্রথম দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সে সময় সিনেমার ব্যানার এঁকে বিখ্যাত হন মো. শোয়েব। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনিও প্রায় বেকার হয়ে পড়েন।

সম্প্রতি হৃদি হকের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে ‘১৯৭১: সেই সব দিন’ নামের একটি সিনেমা। এই সিনেমার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা প্রচারের অংশ হিসেবে সিনেমার ব্যানারের কথা ভেবেছেন। সেই ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন গবেষক ও শিল্পী শাওন আকন্দ। সেই মিলিত চিন্তাভাবনা থেকে ‘১৯৭১: সেই সব দিন’ সিনেমাটির জন্য ব্যানার এঁকেছেন মো. শোয়েব।

‘১৯৭১: সেই সব দিন’ সিনেমাটির সঙ্গে যুক্ত আছেন অভিনেতা সাজু খাদেম। জানতে চাইলাম, সিনেমার জন্য ভুলে যাওয়া এ মাধ্যমের কথা ভাবলেন কেন? সাজু খাদেম জানালেন, সিনেমার প্রচারের জন্য এটি ঐতিহ্যবাহী শিল্পমাধ্যম। ব্যানার পেইন্টারদের ছবি আঁকার যে মুনশিয়ানা, তা কোনো না কোনোভাবে দর্শকদের হলে টেনে আনত। সিনেমা বিষয়টি ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। কিন্তু সিনেমার ব্যানার ‘লার্জার দ্যান সিনেমা’। এর শক্তির কথা বিবেচনায় রেখে ‘১৯৭১: সেই সব দিন’ সিনেমার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা সিনেমার ব্যানারের কথা ভেবেছেন। শাওন আকন্দ জানান, একটা মিলিত চিন্তার ফসল এই ব্যানার। এখন এর কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও রং-রেখার এই বর্ণিল দৃশ্যমাধ্যম মানুষকে আকর্ষণ করেছে যুগে যুগে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twelve − four =