রক্তস্নাত বলিউডে জীবনের গল্প

এল সি ডি অর্থাৎ লাফ, ক্রাই, ড্রামা—এই নিয়ে রাজকুমার হিরানির সিনেমা। এমন কোনো দৃশ্য হিরানি চিত্রনাট্যে রাখতে চান না, যেটা হাসাচ্ছে না, কাঁদাচ্ছে না কিংবা ন্যূনতম নাটকীয়তা তৈরি করছে না। এভাবেই তিনি তুলে আনেন সমাজের এমন কিছু সমস্যা, যা নিয়ে সিনেমা বানানোর কথা কম লোকই ভাবেন। ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’-এ চিকিৎসাক্ষেত্রের অব্যবস্থাপনা, ‘থ্রি ইডিয়টস’-এ শিক্ষাক্ষেত্রের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, ‘পিকে’তে ধর্মের নামে অধর্ম। এবার ‘ডানকি’তে হিরানি নজর দিয়েছেন সেই সব দরিদ্র মানুষদের দিকে, যারা ভাগ্যবদলের আশায় অবৈধ পথে পাড়ি জমাতে চায় উন্নত দেশে।

এ সমস্যা কতটা গুরুতর, সেটার আঁচ পাওয়া যাবে ডানকির শেষে। পরিচালক বলতে চাইছেন, মাত্র ১৪০ বছর আগেও সীমান্তের এই কড়াকড়ি ছিল না পৃথিবীতে। তারপর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার নাম করে দেশগুলো সীমারেখা টানল। এল ভিসার নিয়ম, সঙ্গে বৈষম্যও। শিক্ষা ও সম্পদের এই বৈষম্যের বলি কেবল গরিব মানুষেরা। প্রতিবছর ১ মিলিয়নের বেশি ভাগ্যান্বেষী মানুষ অবৈধ পথে সীমান্ত টপকানোর চেষ্টা করে। বেশির ভাগই সীমান্তরক্ষীর গুলিতে, ক্ষুধায় কিংবা ক্লান্তিতে মারা পড়ে। আর যারা পৌঁছাতে পারে কাঙ্ক্ষিত দেশে, অনেকেই আর ফিরতে পারে না জন্মভূমিতে। ওই দেশেই কোনোরকমে বেঁচে থাকে ব্রাত্যজন হয়ে।

‘পাঠান’ ও ‘জওয়ান’-এর পর ডানকিতে এ বছর তৃতীয়বারের মতো ফৌজের চরিত্রে শাহরুখ। পাঠানে তিনি বিদেশি অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন, জওয়ানে তাঁর সংগ্রাম ছিল দেশের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তবে দুটি সিনেমাই নির্মাণে বড্ড বেশি বাণিজ্যিক, লার্জার দ্যান লাইফ। ডানকিতে তিনি বাদশার সিংহাসন থেকে নেমে মিশেছেন শরণার্থীদের মিছিলে। ভুক্তভোগীদের একজন হয়ে দেখিয়েছেন সমস্যার গভীরতা। প্রশ্ন তুলেছেন অভিবাসন নীতির বৈষম্যের বিরুদ্ধে।

গল্প যেমন: উন্নত জীবনের আশায় ভারতের পাঞ্জাবের কয়েক বন্ধু লন্ডন যেতে চায়। ঘটনাক্রমে হার্ডি (শাহরুখ) জড়িয়ে পড়ে তাদের সঙ্গে। ভিসা না পেয়ে হার্ডির নেতৃত্বে অবৈধ পথে একাধিক দেশের কাঁটাতার পেরিয়ে লন্ডনে পৌঁছায় তারা। তবে যে স্বপ্ন নিয়ে তাদের এত সংগ্রাম, লন্ডনে পৌঁছে দেখা যায়—সবই শুভঙ্করের ফাঁকি।

হতাশ করল: ডানকির প্রধান দুর্বল জায়গা এর চিত্রনাট্য। একে তো এমন আন্তর্জাতিক সমস্যাকে গল্পে তুলে আনা, একই সঙ্গে ২৫ বছরের ব্যবধানের দুটি সময়ের গল্প দেখানোর চ্যালেঞ্জ আর একাধিক সাব-প্লট সামলাতে হিমশিম খেয়েছেন নির্মাতা ও সহলেখকেরা। দু-একটি জায়গা ছাড়া চিত্রনাট্য চমকহীন। গল্পের শেষে কী হতে পারে, সেটা আগেই আন্দাজ করে ফেলা যায়। প্রেম ও আবেগের আতিশয্যে  মূল বিষয় অনেকটা আড়ালে পড়ে গেছে।

ভালো লাগল: নায়কের হাতে অস্ত্র আর রক্তের বন্যা ছাড়া ইদানীং ভারতীয় সিনেমার গল্প জমছে না। এত মৃত্যু আর সহিংসতার ভিড়ে ডানকি নিতান্তই আটপৌরে, বাস্তবঘেঁষা। শাহরুখ এ সিনেমার নায়ক বটে, তবে তিনি শুধুই পথপ্রদর্শক; শক্তির চেয়ে বুদ্ধিতেই যার বেশি ভরসা। ভিনদেশের আদালতে দাঁড়িয়ে দেওয়া তাঁর সংলাপ মনে দাগ কাটে। স্বল্প উপস্থিতিতে ভিকি কৌশল আসল চমকটা দেখিয়ে গেছেন। ভালো লাগবে বিক্রম কোচার, তাপসী পান্নু, বোমান ইরানি, অনিল গ্রোভারকে। সব মিলিয়ে বলা যায়, বক্স অফিসের ইঁদুরদৌড়ে ডানকি পিছিয়ে থাকলেও ক্ষতি নেই, এ সিনেমার অভিঘাত দর্শকদের মনে ক্ষত জিইয়ে রাখবে বহুদিন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − 7 =