বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম আলোচিত একটি চলচ্চিত্র ‘রক্তাক্ত বাংলা’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক হাতে গোনা যে কটি চলচ্চিত্রে ওপার বাংলা ও এপার বাংলার শিল্পীদের দেখা গেছে তার একটি সিনেমা এটি। রঙবেরঙ এর মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনে আমরা এবার আলো ফেলার চেষ্টা করব ‘রক্তাক্ত বাংলা’ চলচ্চিত্রে।
মুক্তির আলোয় ‘রক্তাক্ত বাংলা’
মম চলচ্চিত্রের প্রথম প্রযোজনায় এবং মমতাজ আলীর পরিকল্পনা ও পরিচালনায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থায় গৃহীত, মুদ্রিত ও পরিস্ফূটিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র ‘রক্তাক্ত বাংলা’। চলচ্চিত্রটির মূল কাহিনি লিখেছেন রত্না চ্যাটার্জী। চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করেছেন শান্তি কুমার চ্যাটার্জী। স্বাধীনতার পরে ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭২ সালে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণ করেন সাধন রায় ও এম.এ মোবিন এবং শব্দগ্রহণ করেন মোজাম্মেল হক আর চলচ্চিত্রটির সম্পাদনা করেন বুলবুল চৌধুরী।
কী আছে ‘রক্তাক্ত বাংলা’ সিনেমায়?
চলচ্চিত্রটি শুরু হয় গ্রাম বাংলার অপরূপ দৃশ্য দিয়ে। পরের দৃশ্যে দেখা যায়, হাসি নামে একটি মেয়ে ও তার বড় ভাই শাহেদকে যিনি একজন ভাস্করশিল্পী। শাহেদের বোন শাহেদের খুব আদরের, শাহেদ কোনও ভাস্কর্য বানালে হাসি তার ভাইকে ছড়া বানিয়ে গান শুনাতো। একদিন শাহেদের বাড়িতে সন্ধ্যা নামে এক মেয়ে আসে। সন্ধ্যা শাহেদের ভক্ত, সে-ও শাহেদের মতো শিল্পী হতে চায়। সন্ধ্যা শাহেদের ঘরে শাহেদের হাতে তৈরি কিছু মূর্তি ও ভাস্কর্য নাড়িয়ে দেখে, তখনই দুর্ঘটনাক্রমে সন্ধ্যার হাত থেকে মাটির পুতুল পড়ে ভেঙে যায়, যেটি দেখে শাহেদ প্রচণ্ড রেগে যায় এবং সন্ধ্যাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।
২৫শে মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের মানুষের উপর চালায় বর্বরোচিত গণ্যহত্যা; মসজিদ, মন্দির ধর্মীয় উপাসনালয় মানুষের ঘরবাড়ি তাদের নির্মমতা ও অত্যাচারের শিকার। শাহেদের বোন হাসিকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। যা দেখে শাহেদ ভেঙে পড়ে। হাসির মৃতদেহে রক্ত দিয়ে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে আর মানুষের এই নির্মম অবস্থা দেখে শাহেদ মুক্তিযুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। শাহেদ মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন এবং সেক্টর ইনচার্জের দায়িত্ব পায়। শাহেদ ও তার গেরিলা দল বহু আক্রমণে সফল হয়।
দেশ স্বাধীন হলে শাহেদ বুঝে উঠতে পারে না সে কোথায় যাবে কী করবে? ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নেবার সময় এক মেয়ের চিৎকার শুনতে পায় শাহেদ। অন্ধকারে টর্চলাইট জ্বালিয়ে শাহেদ চিনতে পারে সেই মেয়েকে যে মেয়ে তার বাড়িতে পুতুল ভেঙেছিল। সেখানেই উপস্থিত হয় সন্ধ্যার বড় ভাই ডাক্তার মাসুদ, যিনি পূর্বে সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন। মাসুদের কাছে শাহেদ জানতে চায় সন্ধ্যার এই অবস্থার কারণ। জবাবে মাসুদ বলে, সন্ধ্যা পাকবাহিনীর নির্যাতনের শিকার। শাহেদকে দেখার পর থেকে সন্ধ্যা আস্তে আস্তে সুস্থ হতে শুরু করে। শাহেদ দুটি কারণে সন্ধ্যার কাছে ক্ষমা চায়। মাসুদকে শাহেদ প্রতিশ্রুতি দেয়ে সন্ধ্যাকে সুস্থ করার। একদিন শাহেদ ভাবতে ভাবতে তার মৃত ছোট বোন হাসির একটি ভাস্কর বানায়। সন্ধ্যা জানতে চায় কে? শাহেদ বলে, ওর নাম হাসি। সন্ধ্যা মনে করে এটি বুঝি শাহেদের প্রেমিকা। সন্ধ্যার মনে প্রচুর অশান্তি হয়। পরে শাহেদ সন্ধ্যাকে বলে হাসি তার কী হয়। সব শুনে লজ্জায় আর অপমানে আত্মহত্যা করতে যায় সন্ধ্যা। তার আগে শাহেদ চলে এসে অনেক কষ্টে সন্ধ্যাকে আত্মহত্যা থেকে বিরত করে। চলচ্চিত্রটি শেষ হওয়ার পূর্বে একটি লেখা দিয়ে শেষ হয় ‘শেষ নয় শুরু’।
যাদের অভিনয়ে ‘রক্তাক্ত বাংলা’
সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন ওপার বাংলার বিশ্বজিৎ এবং সুলতানা। সিনেমাটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত এক নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেন কবরী। চরিত্রটির নাম সন্ধ্যা। শাহেদের চরিত্রে অভিনয় করেন বিশ্বজিৎ। মাসুদের চরিত্রে অভিনয় করেন গোলাম মুস্তাফা। হাসির চরিত্রে অভিনয় করেন সুলতানা। আরও অভিনয় করেছেন জয়নাল, খলিল, মঞ্জু দত্ত ও সরকার কবিরউদ্দিন। সিনেমাটির শিল্পনির্দেশনায় ছিলেন হাসান আলী। রূপসজ্জায় ছিলেন শহীদ আলী। স্থিরচিত্র তুলেছেন পিয়াসী ফটোগ্রাফার।
সংগীত
এই চলচ্চিত্রটির আবহ সংগীত পরিচালনা করেন সলিল চৌধুরী। এছাড়া গানে কণ্ঠ দিয়েছেন লতা মুঙ্গেশকর, মান্না দে ও সবিতা চৌধুরী। সিনেমাটির ‘দাদাভাই মূর্তি বানাও…’ গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বোনের রক্তাক্ত মুখ অশ্রুসজল শিল্পী যখন তুলে ধরে, বোনের কণ্ঠে পুরোনো গানের অংশ ভেসে আসে, ‘আমি তো চিরদিন কাছে রবো না/ যাব যে সুদূরে খুঁজে পাবে না/ ঝন ঝন ঝন আঁচলে মোর ঘরেরই চাবি/ নেবে যে ভাবী/একটা উপায় বলো না’ এই গানের দৃশ্য হৃদয় বিগলিত করে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে চারদিক যখন অগোছালো, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশে দাঁড়িয়ে অতি স্বল্প পরিসরে এ ধরনের একটা মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বানানো বড় কঠিন কাজ।
রক্তাক্ত বাংলা নিয়ে সমালোচকদের মত
দেশ বিদেশে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা তথ্যচিত্র ব্যবহার; ট্যাংক, কামান আর যুদ্ধ বিমানের দৃশ্য আর বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা এবং গায়কদের গানে সমৃদ্ধ রক্তাক্ত বাংলা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী সিনেমা। রক্তাক্ত বাংলা ‘ফর্মুলা ছবির’ ছক অনুসারেই নির্মিত হয়েছে। সমালোচকদের মতে মুক্তিযুদ্ধের অন্য কয়েকটি ছবির মতো এ ছবিরও সংলাপ ও চিত্রনাট্য দুর্বল। তবে যুদ্ধদিনের ছবির আলাদা আবেদন অবশ্যই আছে। সেদিক থেকে দেখলে এ ছবিগুলো ইতিহাসের দলিল। ‘রক্তাক্ত বাংলা’ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতিবাহী। ছবিটি ইউটিউবসহ বিভিন্ন সাইটে রয়েছে। দর্শকদের স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে ‘রক্তাক্ত বাংলা’।
এক নজরে মমতাজ আলী
মমতাজ আলী ১৯৩৭ সালের ১৬ জানুয়ারি, ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বালক বয়সেই তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বে চলে যান। জানা যায়, তিনি বোম্বের চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে ১০/১২টি সিনেমাতে অভিনয় করেন। কাজ করেন বোম্বের বিভিন্ন ফিল্ম ইউনিটে। একসময় সহকারী হিসেবে কাজ করেন রাজ কাপুর, দেবেন্দ্র গোয়েলা ও প্রকাশ মেহেরার সাথে। মমতাজ আলী ১৯৫৭ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় এসে এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে সহকারী হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন। এছাড়াও লাহোরে ও ঢাকায় আরো অনেক পরিচালকের সাথেই কাজ করেছেন তিনি। ‘আকাশ আর মাটি’সহ কয়েকটি ছবিতে তিনি অভিনয়ও করেছেন ।
মমতাজ আলী পরিচালিত প্রথম ছবি ‘নতুন নামে ডাকো’ মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালে। তার পরিচালিত অন্যান্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে: নতুন ফুলের গন্ধ, সোনার খেলনা, কে আসল কে নকল, ঈমান, কুদরত, নালিশ, নসীব, উসিলা, নিয়ত, কারণ, বিশাল, নতিজা, সোহরাব রুস্তম অন্যতম।
দেশীয় চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক তথা বিনোদনের ধারাকে সমৃদ্ধ করা নির্মাতাদের অন্যতম একজন, জননন্দিত পরিচালক, প্রযোজক ও পরিবেশক প্রয়াত মমতাজ আলী। তার নির্মিত প্রায় সব চলচ্চিত্রই যেমন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবসাসফল এবং তেমন সিনেমাদর্শক কর্তৃক সমাদৃত ও প্রশংসিত। মমতাজ আলী এমন একজন পরিচালক ছিলেন, যার নামেই সিনেমা হলে ছবি চলতো । তার ছবি মানেই ছিল সুপারস্টার নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে বিশাল আয়োজনের সমারোহ। তিনি ছিলেন সামাজিক অ্যাকশান ছবির সুপারহিট পরিচালক। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের গানগুলোও হতো শ্রুতিমধুর, ভালো লাগার আবেশে ভরপুর, হতো জনপ্রিয় ও দর্শক সমাদৃত। তার ছবিতেই দর্শকরা পেত সুস্থ-বিনোদন ছবির স্বাদ। তোমাকে চাই আমি আরো কাছে, তোমাকে বলার আরো কথা আছে, অমন করে যেও নাগো তুমি, বুকে আগুন জ্বালিও না তুমি, ও দাদা ভাই মূর্তি বানাও, কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো সে কথা তুমি যদি জানতে, খোদার ঘরে নালিশ করতে দিলো না আমারে, পাপ-পূণ্যের বিচার এখন মানুষে করে; এমন আরো অনেক কালজয়ী জনপ্রিয় গান থাকতো মমতাজ আলী পরিচালিত সিনেমায়।
মমতাজ আলী ১৯৯৭ সালের ৮ নভেম্বর, ঢাকায় মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। প্রয়াত এই গুণী চিত্রপরিচালকের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। মমতাজ আলী শারীরিকভাবে চলে গেছেন কিন্তু রয়ে গেছে তার কর্ম ও জীবন। তিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প। চলচ্চিত্র মাধ্যমের কর্মীরা যতবেশি মমতাজ আলীর মতো নির্মাতা এবং মানুষকে অনুসরণ করবেন, তার কর্ম নিয়ে করবেন চর্চা, ততবেশি সমৃদ্ধ হবে আমাদের চলচ্চিত্রমাধ্যম।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা