রমজানে বাহারি ইফতার

শবনম শিউলি

ইসলাম ধর্মাবলম্বিদের সবচেয়ে পবিত্র মাস রমজান। এই মাসে বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা রোজা পালন করবেন। এরপরে আসবে ঈদ। সারা মাস সিয়াম সাধনা করে ঈদের জন্য অপেক্ষা করার মধ্যেও আছে এক ধরনের ইবাদত। তাই রমজান মাস থেকেই শুরু হয় উৎসব মুখর পরিবেশ। রোজার অপরিহার্য অনুষঙ্গ ইফতারি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ নানা স্বাদের খাবার দিয়ে ইফতার করেন। বাংলাদেশেও আছে বাহারি নাম আর লোভনীয় স্বাদের নানা ধরনের ইফতারি।

রমজান মাসে খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করা সুন্নত। কারণ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইফতার করতেন খেজুর দিয়ে। তিনি ইফতার করতেন কয়েকটি ভেজা খেজুর, তা না থাকলে শুকনা খুরমা/খেজুর, আর পানি দিয়ে। একবার তিনি সফরে থাকা অবস্থায় ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার করেছিলেন। সাহরির ক্ষেত্রেও প্রাধান্য দিতেন খেজুরকে। বিভিন্ন দেশের মানুষ নানাভাবে নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী দিয়ে সম্পন্ন করেন ইফতার।

ইফতারের ইতিহাস

বলা হয়, মোগলরা সঙ্গে করে নিজেদের বাবুর্চি নিয়ে এসেছিলেন। চারশ বছর আগে ঢাকায় মুসলমানের সংখ্যাও ছিল অল্প। তবে মোগলরা আসার পর চিত্রটা খানিকটা বদলে যায়। রোজা পালন তখন উচ্চবিত্ত তথা মোগলদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারা নানা রকম রুটি ও কাবাবে সন্তুষ্ট ছিলেন। ঢাকার মোগল সেনা ছাউনিতে বিখ্যাত ছিল নান-তাফতান, এই নানরুটিগুলো বাদাম দিয়ে তৈরি হতো। আরেকটি জনপ্রিয় খাবার আগ্রার শিরমাল, যা ঢাকায় আসে মোগল সুবেদারদের হাত ধরে। শীতকালে রোজা পড়ে গেলে রুটির সঙ্গে যোগ হতো আকবরি নানখাতাই। সঙ্গে থাকত বিভিন্ন কাবাব। সেকালে ধনী মুসলমানরা তাদের জীবনযাত্রায় প্রায় ৫০ ধরনের খাবার গ্রহণ করতেন। এর মধ্যে বিরিয়ানি, কিমা, পোলাও, বাকরখানি অন্যতম। মোগল যুগেও ছিল মিষ্টিজাতীয় খাবারের জনপ্রিয়তা। সুনাম ছিল ঢাকার চকবাজারের জিলাপির। তখন চকবাজার পরিচিত ছিল বাদশাহি বাজার নামে। এই চকবাজার এলাকা ঘিরেই তখনকার ইফতারির বাজার বসে যেত।

ঘরে বানানো মুড়ির বিভিন্ন পদ, মিষ্টি ও নোনতা সমুচা, কাঁচা ও ভাজা ডাল, ফল-ফলারি, পেঁয়াজু, ফুলুরি প্রভৃতি বাজার থেকে কিনে আনা হতো। ছিল ‘গোলাপি উখরে’ নামের মিষ্টি মিশ্রিত একধরনের খাবার। এছাড়া ভুনা চিড়া, দোভাজা, টেপি ফুলুরি, মাষকলাইয়ের বড় ডাল-বুট, বাকরখানি, কাবাব ইত্যাদি হাজির থাকতো দস্তরখানায়। ঘরে বিভিন্ন ধরনের ইফতারি বানানো হলেও পুরান ঢাকাবাসী প্রতিদিন চকবাজার থেকে কিছু না কিছু ঠিকই আনতেন। তবে চল্লিশের দশকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠতে থাকে ইফতারির অস্থায়ী দোকান।

ইফতার ও বাঙালি মুসলমান

ভাজাপোড়া, মিষ্টান্ন, ফলমূল, সরবত, ছোলা, মুড়ি, হালিম ইত্যাদি ইফতারের মূল আকর্ষণ। সারা বছর এগুলো খাওয়া হয় না, তা নয়। তবে রমজান মাসে এর আয়োজন থাকে বিশেষ। ভাজাপোড়ার মধ্যে আলুচপ, পেঁয়াজু, বেগুনি, পাকোড়া, শিঙাড়া, সমুচা সহ আরও অনেক ধরনের তেলে ভাজা পদ। মিষ্টি জাতীয় খাবারের মধ্যে জিলাপি, বুন্দিয়া, ফালুদা, পায়েস, ফিরনি, সেমাই, দই চিড়া, বিশেষ করে লাচ্ছা সেমাই খেতে পছন্দ করেন অনেকেই। বিভিন্ন ধরনের ফলমূল যেমন খেজুর, পেঁপে, কলা সহ অন্যান্য দেশীয় মৌসুমী ফল এবং আপেল, মাল্টা, আঙ্গুর, বেদানা জাতীয় বিদেশি ফল। পানীয়র মধ্যে আছে নানা শরবত, মাঠা, লাবান, লাচ্ছি, কোমল পানীয়, ফলের জুস ইত্যাদি।

পুরাতন ঢাকায় এক ধরনের খাবার আছে যাকে বলা হয় মুড়ি ভর্তা। সেখানে বিভিন্ন আইটেমের পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন কাবাব। গরু, খাসি আর মুরগির পাশাপাশি এখানে আস্ত কবুতর, কোয়েল পাখির কাবাব পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের পরোটা আর মাংসের আচারও পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতার আইটেম। বিশেষ আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন নামে ইফতার আইটেম বানানো হয়। যেমন ‘বড়বাপের পোলায় খায়’। এছাড়া বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন নামের আর স্বাদের ইফতার আইটেম আর জনপ্রিয় অনেক দোকান আছে। ইফতারের মূল পদগুলো নানা দেশ বা অঞ্চলের খাবার যা আমাদের নিজস্ব পদ হিসেবে মিশে গেছে।

ভারতবর্ষে আরব, পার্সিয়ান, আফগান ইত্যাদি বিভিন্ন জাতির শাসকদের কারণে স্থানীয় খাবারের সাথে তাদের খাবারের রীতি মিশে যায়। যেমন হালিম, বিরিয়ানি, কাবাব – এগুলো পার্সিয়ান এবং মধ্যপ্রাচ্যের খাবার। মোঘলদের সাথে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্য এবং আরব দেশগুলো হতে বহু মানুষের পদধূলি পড়েছিল এই উপমহাদেশে, সাথে এসেছিল তাদের নানা খাবারের রেসিপিও। মধ্যপ্রাচ্যে ইফতারির সময় কাবাব সহযোগে বিরিয়ানি বা পোলাও খাওয়ার চল রয়েছে। সেটার অনুকরণেই এখানে মুড়ির সাথে ছোলা, চপ, পেঁয়াজু, বেগুনি খাবার রীতি শুরু হয়েছে বলে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন।

রমজানে পুরান ঢাকা

রমজান আর চকবাজারের সম্পর্ক বহু পুরানো। এখনও ইফতারির ঐতিহ্য আর স্বাদের কথা বলতে গেলে চলে আসে চকবাজারের নাম। দুপুর ১২টার পর থেকে শুরু হয় ইফতারি বিক্রির আয়োজন। চকবাজারের এখনকার ইফতারির মধ্যে আছে সুতি কাবাব, বড় বাপের পোলায় খায় ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়, শাহি হালিম, দই বড়া, মুরগির রোস্ট, খাসির আস্ত রান, চিকেন কাঠি, কোয়েল পাখির রোস্ট, মুরগির রোস্ট ইত্যাদি। আরও আছে শাহি জিলাপি। শরবতের মধ্যে আছে দুধ, পেস্তা বাদামের শরবত, ঘোল বা মাঠার শরবত, তোকমার শরবত, বেলের শরবত, লেবুর শরবত, তেঁতুল ও গুড় মিশ্রিত টক-মিষ্টি শরবত, ইসবগুল ও বেদানার শরবত, হরেক রকম ফলের শরবত, পুঁদিনা পাতার শরবত ইত্যাদি। আছে ফালুদা, বোরহানি এবং লাবাং।

নানা দেশের নানা ভোজ

সাধারণত পানি ও খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙেন মিসরীয়রা। তবে প্রধান ইফতার আইটেমে থাকে আটা, মধু, কিশমিশ, বাদাম ছড়ানো কেক জাতীয় কোনাফা ও কাতায়েফ। তাছাড়া খেজুর, খুবানি কালোজাম মেশানো ফলের ককটেল খুশাফ, মলোকিয়াও খুবই জনপ্রিয় দেশটিতে। সৌদি আরবের মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইফতারের আয়োজন হয়ে থাকে। ইফতারিতে থাকে খেজুর, বিভিন্ন ধরনের ফল, জুস, তামিজ (এক ধরনের রুটি), বোরাক (মাংসের পিঠা), মানডি (মুরগি ও ভাত দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার) অথবা ভেড়া/মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি খাবসা। এছাড়া কোনাফা, ত্রোম্বা, বাছবুচান্ডর নামক নানা রকম হালুয়া।

খেজুর ও দুধ এই দুটি আইটেম ইফতারের ক্ষেত্রে খুবই জনপ্রিয় দুবাইয়ে। রোজা ভাঙার পর খেয়ে থাকেন হারিরা নামক ভেড়ার মাংস ও মসুর ডাল দিয়ে তৈরি করা বিশেষ এক ধরনের স্যুপ। এছাড়া আছে মালফুফ। এছাড়া মিষ্টান্ন হিসেবে থাকে চিজ দিয়ে তৈরি পেস্ট্রি যার নাম ‘কুনাফেহ’। তাদের এই আয়োজনকে সম্মিলিতভাবে ‘মেজে’ বলা হয়। তবে এলাকাভেদে এদের খাবারে বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাও দেখা যায়। মালয়েশিয়াতে সাধারণত রোজা ভাঙা হয় শুকনা খাবার বা খেজুর দিয়ে। ইফতারের আইটেমে থাকে স্থানীয় একটি খাবার নাম বারবুকা পুয়াসা। তুরস্কের ইফতারের লিস্টে থাকে বিখ্যাত পাইড রুটি, খেজুর, জলপাই, বিভিন্ন ধরনের পনির, পাস্তিরমাহ (মসলাই গরুর মাংস), সসেজ, ফলমূল, সবজি ও মধু। খাবার টেবিলে অবশ্যই থাকবে স্যুপ। তাছাড়া রমজান মাসে তাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে বিশেষ ধরনের একটি কাবাব। খেজুরের পাশাপাশি পুঁইশাক, আলু ও অন্যান্য সবজি প্রাধান্য পায় আফগানিস্তানের ইফতার আইটেমে।

ইরাকে গরু, মহিষ বা ছাগলের দুধ দিয়ে রোজা ভাঙেন বেশিরভাগ মানুষ। খেজুরের সঙ্গে পান করেন বিশেষ ধরনের শরবত। তাছাড়া মিষ্টি, কাবাব, মুরগির মাংসের নাওয়াশিফ, খেজুর-বাদাম-নারকেল-চিনি-জাফরান মেশানো বিস্কুট ক্লেইচা খুবই জনপ্রিয় তাদের কাছে। ইন্দোনেশিয়াতে ইফতারকে বলা হয় বুকা। অর্থ শুরু করা। ইন্দোনেশিয়ানরা সাধারণত তেল ও মসলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলেন ইফতারে। তাদের ইফতার আইটেমে থাকে ফল এবং ফলের রস, বিভিন্ন ধরনের ফ্রুট ককটেল, ডাবের পানি ইত্যাদি। একটু ভারী খাবারের মধ্যে থাকে কিস্যাক (সিদ্ধ চাল দিয়ে তৈরি খাবার), সোতো পাং কং (সামুদ্রিক মাছ দিয়ে তৈরি খাবার), পাকাথ (সবজি বিশেষ) ইত্যাদি।

পাকিস্তানে ইফতারে অবশ্যই থাকবে রুটি ও মাংস। তাছাড়া আরও যা যা থাকে সেগুলো হলো ফল, ফলের সালাদ, ফালুদা, জুস, বিভিন্ন ধরনের শরবত, রোল, টিক্কা, তান্দুরি কাটলেট, কাবাব, নুডলস কাবাব, সফিয়ানি বিরিয়ানি ইত্যাদি। ভারতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশি হলেও সেখানের মুসলমান এলাকাগুলোতে বাহারি ইফতারের আয়োজন হয়ে থাকে। সাধারণত এই দেশের লোকজন তাদের মুঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে ইফতার করতে পছন্দ করেন। হায়দ্রাবাদে হালিম, তামিলনাড়ু ও কেরালায় ইফতার হয় ননবো কাঞ্জি নামক এক ধরনের খাবার দিয়ে আর কলকাতায় দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের কাবাবের চল। তাই তাদের ইফতারে খেজুর ও বিভিন্ন ধরনের ফলের পাশাপাশি দেখা যায় চিকেন শর্মা, বটি কাবাব, কাটলেট ইত্যাদি মুখরোচক খাবার।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খাদ্য কথন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × three =