রমজান নিয়ে কিছু তথ্য

তোপধ্বনি মূলত প্রচলিত সামরিক সম্মান। যা বহু বছরের পুরানো রীতি। বিশেষ দিনগুলোতে বাংলাদেশে তোপধ্বনির মাধ্যমে দেশের সূর্যসন্তানদের সম্মান জানানো হয়। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বা বিশেষ দিবসকে তোপধ্বনির (কামান দাগা) মাধ্যমে সম্মান জানানো একটি প্রচলিত রীতি। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন রমজানের সঙ্গে তোপধ্বনির একটা সম্পর্ক রয়েছে। তোপধ্বনি নিয়ে গোলাম মোর্শেদ সীমান্তের এবারের প্রতিবেদন

* সৌদি আরব, মিসর, দুবাইসহ একাধিক মুসলিম দেশে সেহেরি-ইফতারের সময় জানাতে ‘তোপধ্বনি’র রেওয়াজ রয়েছে। অনেক দেশে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার পর কামানের গোলা নিক্ষেপ করে শব্দ করা হয়। রমজানের বিশেষ ঐতিহ্য হিসেবে আরব মুসলমানদের কাছে ‘তোপধ্বনি’ বেশ জনপ্রিয়।

* ১৪৬০ সালে এক জার্মান নাগরিক মামলুক রাজবংশের সুলতান খাসকাদুমকে একটি তোপ (কামান) উপহার দেন। সাত বছর পর ১৪৬৭ সালে পরীক্ষামূলক ভাবে সূর্যাস্তের সময় কামানটি নিক্ষেপ করা হয়। মাগরিবের আজান দিবে এমন একটা সময়। আবার তখন ইফতারের আগ মুহূর্ত। রোজার সময় সমাপ্তির নির্দেশক হিসেবে তোপধ্বনির প্রক্রিয়াটি মিসরের শহরবাসীদের পছন্দ হয়। পরবর্তী সময়ে সেহেরি ও ইফতারের সময় জানাতে মাসব্যাপী এই কার্যক্রম চালাতে স্থানীয় আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সুলতানকে পরামর্শ দেন। সুলতানও রাজি হলেন। পরে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার পরও তোপধ্বনি দেওয়া শুরু হয়। এভাবেই চমৎকার এই পদ্ধতির শুরু।

* মিসরের পর্যটন ও প্রত্নতত্ত্ব মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজধানী কায়রোর ঐতিহাসিক সালাহউদ্দিন দুর্গে সুলতান খাসকাদুমের তোপটি আজও ব্যবহৃত হচ্ছে। জানা যায়, ১৯৯২ সাল থেকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দীর্ঘ ৩০ বছর এটির ব্যবহার বন্ধ ছিল। তবে ২০২১ সাল থেকে রমজান মাসে আবার তোপটি চালু করা হয়।

* সালাহউদ্দিন দুর্গে একটি তোপ রেখেছিলেন মিসরের তৎকালীন শাসক ইসমাইল পাশার সেনারা। তারা এটি দিয়ে অনুশীলন করতেন। একদিন মাগরিবের আজানের সময় তোপটি থেকে একটি গোলা নিক্ষেপ করা হয়। ঘটনাক্রমে তখন পবিত্র রমজান মাস ছিল। এ সময় ইসমাইল পাশার কন্যা শাহজাদি আল হাজ্জাহ ফাতেমা ইফতারের সময় জানাতে তোপধ্বনি করার প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং একইসঙ্গে সেহেরি ও ঈদের চাঁদ দেখার পরও তোপধ্বনির প্রচলন ঘটে।

* সৌদি আরবে মক্কার পবিত্র মসজিদুল হারামের অদূরে উত্তর দিকে একটি তোপ সংরক্ষিত আছে। রমজানে সেহেরি ও ইফতারের সময় মক্কায় সমাগত ওমরাহ যাত্রীদের সম্মানে তোপটি থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হতো। ঈদের চাঁদ দেখার পরও উৎসবের আমেজে এটি ব্যবহার করা হতো। তবে গত এক দশক যাবত মক্কার তোপধ্বনি বন্ধ আছে। তাছাড়া ১৯৩১ সাল থেকে তাবুকেও তোপধ্বনি রীতির চর্চা শুরু হয়। সৌদি ঐতিহাসিক আব্দুল্লাহ আল উমরানি বলেন, বিংশ শতাব্দীর শুরুর কিছুটা পরে সৌদি আববের স্থপতি শাহ আব্দুল আজিজ তায়েফে একটি সেনা ছাউনি স্থাপন করেন। সেখানকার এক কর্মকর্তা সেনাদের সেহেরি ও ইফতারের সময় জানাতে তোপধ্বনি কার্যক্রম চালু করেন।

* তুরস্কে রমজানে সেহেরি ও ইফতারের সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে তোপধ্বনি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ড্রাম বাজিয়ে রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগানোর সংস্কৃতিও চালু আছে। তাছাড়া রমজানকে স্বাগত জানিয়ে তোপধ্বনি দেওয়ার সময় মসজিদের মিনারগুলোতে জ্বলে কানদিল নামের বিশেষ বাতি। এগুলো জ্বলতে থাকে সূর্যোদয় পর্যন্ত। তুরস্কে কানদিল জ্বালানোর এই ঐতিহ্য শত বছরের পুরোনো।

* মুসলিম সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, তোপধ্বনি রোজার আনন্দ ও মুসলমানদের আধিপত্যের প্রাচীন প্রতীক। আরব সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য একটি অংশে পরিণত হয়েছে এটি। রমজানে তোপের ব্যবহার এতটাই সমাদৃত হয়েছে যে সৌদি আরব, উপসাগরীয় দেশগুলো এবং আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এটি জনপ্রিয়।

* ইরাকের মুসলমানরা উসমানীয় শাসনামল থেকেই রমজান মাসকে নিয়মিত উদ্যাপন করে আসছে। ইরাকে রমজান মাসকে স্বাগত জানানো হয় তোপধ্বনির মাধ্যমে। এ সংস্কৃতি তারা গ্রহণ করেছে তুর্কিদের কাছ থেকে। তুর্কির উসমানীয় শাসনামলে বাগদাদবাসীকে তোপধ্বনির মাধ্যমে ইফতার ও সেহেরির সময় সম্পর্কে অবগত করানো হতো।

* পৃথিবীর সর্বউত্তরের দেশ হিসেবে অনেক দেশে সূর্যাস্ত হয় না। লংগিয়ারবিয়েন ও নরওয়েতে এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সূর্যাস্ত হয় না। এইসব দেশের মানুষ পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশের সময় অনুসরণ করার মাধ্যমে রোজা সম্পন্ন করে থাকে।

* ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টা রোজা রাখতে হয় বেশ কিছু দেশে। ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রোজা রেখেছেন গ্রিনল্যান্ডের মুসলমানরা। তারা ১৯ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট রোজা রাখেন। এছাড়া প্রতি বছর প্রায় ২০ ঘণ্টা ধরে রোজা রাখেন আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, স্কটল্যান্ডের মুসলমানরা।

* ২০২১ সালে সবচেয়ে কম সময় রোজা রেখেছেন নিউ জিল্যান্ডের মুসলমানরা। ১১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। এছাড়া প্রতি বছর চিলি, অস্ট্রেলিয়া, উরুগুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলমানরা সবচেয়ে কম সময়ের রোজা রেখে থাকেন।

* যেসব দেশে সূর্যাস্ত হয় না সেখানে বছর ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর গোলার্ধে রোজার সময় কমতে থাকে। এসব স্থানে রোজার সময় ২০৩২ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত কমতে থাকবে। ২০৩২ সাল নাগাদ রমজান মাস পুরোপুরি শীতের মধ্যে পড়বে। আর তখনকার সময়টি হবে বছরের সংক্ষিপ্ততম সময়। এরপর পুনরায় রোজার সময় বাড়তে থাকবে এবং গ্রীষ্মের সময়ে এসে পড়বে। ওই সময়টি হবে বছরের দীর্ঘতম সময়।

* জাপানি গবেষক ও বিজ্ঞানী ওশিনরি ওসুমি রোজা নিয়ে বিস্ময়কর তথ্য দিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল লাভ করেছেন। ২০১৬ সালে তিনি ‘অটোফেজি’ নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার জয় করেছেন। তিনি প্রতিবছর রোজা রাখেন। তবে তিনি কেন রোজা রাখেন এ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে এক বিস্ময়কর তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মুসলমানরা যাকে রোজা বলে, আমি তাকে বলি ‘অটোফেজি’। রোজার মাসে খাবার দাবারের ঝামেলা, তাই এই মাসটা আমি অটোফেজি করি। অটোফেজি কি তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অটোফেজি শব্দটি একটি গ্রিক শব্দ। এর মানে নিজে নিজেকে খাওয়া। চিকিৎসাবিদ্যায় নিজের মাংস নিজেকে খেতে বলে না। শরীরের কোষগুলো বাহির থেকে কোনো খাবার না পেয়ে নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে, তখন চিকিৎসাবিদ্যার ভাষায় তাকে অটোফেজি বলা হয়।

* জি ফ্রস্ট ও এস পিরানি ১৯৮৭ সালে ১৫ জন সৌদি যুবকের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেন, রমজান মাসে যদিও তাদের খাবার গ্রহণ কমে গেছে; কিন্তু শর্করা, প্রোটিন এবং চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ সময় যেহেতু পানি পান থেকেও বিরত থাকতে হয়, সেহেতু দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ঘাম, মল ও মূত্রের মাধ্যমে পানি নিঃসরণ হয়। এ অবস্থায় বিভিন্ন হরমোনের মাধ্যমে কিডনি রক্তে পানি ধরে রাখার চেষ্টা করে। অন্যদিকে, ২০১২ সালে ট্রাবেলসি এবং তার সহযোগীরা দুই ধরনের রোজাদারদের ওপর গবেষণা চালান। যাদের একদল ইফতারের ঠিক আগ মুহূর্তে এরোবিক এক্সারসাইজ; যেমন সাইকেল চালানো ও সাঁতার কাটা অনুশীলন করেছেন এবং আরেক দল ইফতারের পর একই অনুশীলনগুলো করেছেন। তারা দেখেন, রোজা শেষে প্রথমোক্ত দলের শরীরের চর্বি কমলেও পরবর্তী দলে তা অপরিবর্তিত রয়েছে।

* বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমল থেকে সরকারিভাবে তিনবার সাইরেন বাজিয়ে সেহেরির শুরু, মধ্যম ও অন্তের সময় ঘোষণা করা হতো। অন্যদিকে মোগল আমল থেকে ঢাকার মহল্লা পঞ্চায়েতের গোরেদরা স্থানীয় উর্দু ও বাংলা ভাষায় সেহেরির সময় রোজাদারদের জাগিয়ে দিতের। স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই এ কাজে অংশগ্রহণ করতেন। তারা মহল্লায় মহল্লায় ‘উঠঠো রোজদারও সেহেরি খা লও, রাত তিন বাজগিয়া’ বলে ডাকতো।

* ঢাকাইয়ারা ইফতারের আহার পর্বকে ‘রোজাখোলাই’ নামে অভিহিত করে থাকে। তিন দশক পর্যন্ত মসজিদগুলোতে মাইক ব্যবহার কম থাকায় ইফতারের সময় সরকারিভাবে সাইরেন বাজানো হতো। ‘রোজাখোলাই’র পদের সংখ্যা ছিল শতাধিক যার বেশিরভাগ ঘরে তৈরি এবং কিছু দোকান থেকে সংগ্রহ করা হতো। পুরান ঢাকায় জীবনে প্রথম রোজা সূচনাকারী শিশু-কিশোরদের নিয়ে রোজার প্রথম দিন জুলুসের (ধর্মীয় শোভাযাত্রা) প্রচলন ছিল।

* ‘কাসিদা’ শব্দটি আরবি যার অর্থ প্রশংসা বা প্রশস্তিমূলক কবিতা। শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘ক্বাসাদ’ থেকে। ‘ক্বাসাদ’ অর্থ পরিপূর্ণ। ‘ক্বাসাদ’ পরবর্তীতে ফারসি শব্দ কাসিদায় রূপান্তর হয়। বুড়িগঙ্গার পানির উপর দিয়ে অন্ধকারে ভেসে আসছে উর্দু সংগীত। মাইকে সেহেরির আহ্বান। আর সংগীতের মৃদু বাজনা মিশে যাচ্ছে নৌকাচলার শব্দের সঙ্গে। এর সাথে বর্তমান প্রজন্ম অনেকেই অপরিচিত। কালের খেয়াতে হারিয়ে গিয়েছে এ রীতি। আগের প্রজন্মের কাছে বিষয়টি চিরচেনা। যারা পুরান ঢাকার বাসিন্দা, রমজানে শেষ রাতের দিকে এই আহ্বান শোনার জন্য তারা অপেক্ষায় থাকেন আজও। যে সংগীত আর দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া হলো, তাকে ‘কাসিদা’ বলে। ঊনিশ শতকের পর ঢাকায় রমজান মাসে সেহেরির সময় কাসিদা পাঠ করে রোজাদারদের ঘুম ভাঙানোর প্রথার সূচনা হয়। বর্তমানে পুরান ঢাকায় রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে কাসিদার চর্চা অব্যাহত রয়েছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × 5 =