নায়ক রাজ রাজ্জাকের প্রয়াণ দিবস আজ

নায়করাজ রাজ্জাকের জন্ম কলকাতায়। সেখানেই মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর ভাগ্যান্বেষণে, শরণার্থী হয়ে আসেন ঢাকায়। উদ্দেশ্য ছিল এখানকার সিনেমায় অভিনয় করা। কিন্তু সেই সুযোগ এক দিনে আসেনি।

মঞ্চনাটক নিয়েই দিন কাটছিল রাজ্জাকের। স্কুলের নাটকে অভিনয় শুরু, কলেজে পড়ার সময় চলে যান মুম্বাইয়ে, ৯ মাসের একটি অভিনয় কোর্স করে ফিরে আসেন কলকাতায়। নাটকের নেশা তত দিনে আরও গভীরভাবে চেপে বসেছে। একদিকে দর্শকদের বিস্তর প্রশংসা, অন্যদিকে পরিবারের ঘোর আপত্তি। অনেকটা বাধ্য হয়ে পরিবারের মতে বিয়েটা করতে হলো। তাতে যদি নাটক নিয়ে পরিবারের আপত্তিটা কমে! কিন্তু শুধু অভিনয় দিয়ে তো আর সংসার চলে না। তাই শুরু করলেন ব্যবসা। ফ্যান উৎপাদনের কারখানা খুললেন। সকালবেলাটা কারখানায় সময় দিতেন তিনি, আর বিকেলবেলাটা বরাদ্দ থাকত নাটকের রিহার্সালের জন্য। এর মধ্যে দু-একটি সিনেমায়ও ছোট চরিত্রে মুখ দেখিয়ে ফেলেছেন রাজ্জাক।

দিনগুলো ভালোই কাটছিল। দুর্দিনের পয়গাম নিয়ে এল ১৯৬৪ সাল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বাড়িঘর পুড়ল, কারখানা ধ্বংস হলো। ভীষণ ভেঙে পড়লেন রাজ্জাক। তত দিনে বড় ছেলে বাপ্পার জন্ম হয়েছে। রাজ্জাক সিদ্ধান্ত নিলেন, কলকাতায় আর নয়, বোম্বে গিয়ে অভিনয়ের সুযোগ খুঁজবেন। পীযূষ বসু পরামর্শ দিলেন, ‘বোম্বে না গিয়ে বরং পূর্ব পাকিস্তানে যা। ওটা নতুন ইন্ডাস্ট্রি। একটা চান্স নিতে পারিস।’ পরামর্শটা মাথায় ধরল রাজ্জাকের। তবে তাঁর এ প্রস্তাবে সায় দিল না পরিবারের কেউ। সিদ্ধান্তে অনড় রাজ্জাক। ভাইদের কাছে নিজের ভাগের সম্পত্তির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে রওনা দিলেন ঢাকার উদ্দেশে। ভরসা বলতে পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের সঙ্গে এক দিনের পরিচয়, আর পীযূষ বসুর দেওয়া একটি চিঠি।

এক সাক্ষাৎকারে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার বর্ণনা দিয়ে রাজ্জাক বলেছেন, ‘প্রথমে এলাম বাসে করে বসিরহাট। তখন রায়টের পরে তো, ওদিক থেকে অনেক মুসলমান আসছে, এদিক থেকে হিন্দুরা যাচ্ছে। বর্ডার ওপেন ছিল। এরপর বর্ডার পার হয়ে শিমুলিয়া। আমাদের দেশের এক ভদ্রলোক, কাজী সাহেব, উনি এক্সচেঞ্জ করে এসেছিলেন। তাঁর বাড়িতে উঠলাম রাতে। পরদিন সকালে এলাম খুলনা, সেখান থেকে যশোর। যশোর থেকে ট্রেনে করে ফুলবাড়িয়া স্টেশন।’

পাশেই তখন স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে। সেখানে অসংখ্য উদ্বাস্তু মানুষের ভিড়। স্ত্রী-সন্তান আর তাদের মতোই কয়েকজন ঠিকানাহীন সঙ্গীকে নিয়ে সেখানে আশ্রয় নিলেন রাজ্জাক। একজন পরামর্শ দিলেন মিরপুরে যাওয়ার, সেখানে রিফিউজিদের জন্য ব্যবস্থা আছে। গেলেন সেখানে। একটা ঘর পেলেন। রাতের বেলা শুরু হলো প্রবল ঝড়-বৃষ্টি। ছোট বাচ্চা নিয়ে রাতভর স্বামী-স্ত্রীর আপ্রাণ সংগ্রাম। এভাবে তো থাকা যায় না! সকালে উঠেই গেলেন আব্দুল জব্বার খানের সঙ্গে দেখা করতে। আলাপ হলো। কমলাপুরে ৮০ টাকায় একটা বাড়ি ভাড়া করলেন—দুটো রুম, কিচেন আর একটা কুয়া। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সেখান থেকে শুরু হলো রাজ্জাকের দ্বিতীয় জীবন।

তবে যে কারণে তাঁর ঢাকায় আসা, সেই অভিনয়ের কী হবে! ঢাকায় তখন উর্দু সিনেমার রমরমা। বাংলা সিনেমা একেবারেই কম চলে। এ দেশের বিখ্যাত সব পরিচালক একের পর এক উর্দু সিনেমা করছেন। তাঁদের মধ্যে রাজ্জাকের জায়গা কোথায়! কাজ না পেয়ে বেশ কিছু মঞ্চনাটকে অভিনয় করলেন। কিন্তু সেখানকার অবস্থাও তত সুবিধার নয়। নির্মাতা কামাল আহমেদ তখন ‘উজালা’ নামে একটি সিনেমা বানাচ্ছেন। সেই সিনেমার চতুর্থ সহকারী পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হলেন রাজ্জাক। ঢাকার ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর প্রথম কাজ। এরপর ‘পরওয়ানা’, তাতেও সহকারী পরিচালক। কিন্তু টাকা তেমন পাচ্ছেন না।

রাজ্জাক তখন অভিনয়ে সুযোগ পাওয়ার সন্ধানে হাউসে হাউসে ঘুরছেন। কেউ ভরসা দিল, কেউ তাড়িয়ে দিল। কলকাতা থেকে যে অর্থ নিয়ে এসেছিলেন, তা-ও প্রায় শেষের পথে। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো করে ‘ঘরোয়া’ নামের একটি টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় শুরু করলেন।

রাজ্জাকের ভাগ্য বদলে দিল জহির রায়হানের সঙ্গে পরিচয়। বছর দুয়েকের মাথায় ‘বেহুলা’য় প্রথম নায়ক হওয়ার সুযোগ পেলেন তিনি। সুপারডুপার হিট হলো সিনেমাটি। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাককে। কালক্রমে হয়ে ওঠেন ঢাকাই সিনেমার একচ্ছত্র অধিপতি, নায়করাজ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eleven − seven =