রিমা জুলফিকারের গল্প

নাহিন আশরাফ

নারীরা বারবারই যেন প্রমাণ করছে তারা শুধু ঘরের কাজে পারদর্শী নয় ঘর এবং বাইরে দুদিকেই সমানতালে সামলাতে পারে। এমনি এক সফল নারীর কথা শুনবো আমরা যার নাম রিমা জুলফিকার।

রিমা জুলফিকার ১৯৬৩ সালে মুন্সিগঞ্জ জেলায় দক্ষিণ কোরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলম হোসেন, মা জরিনা হোসেন। ছোটবেলা থেকে রিমা খুব ক্রিয়েটিভ ছিলেন। স্কুলে গান করতেন, কবিতা আবৃত্তি করতেন। নাচ, একক অভিনয়, উপস্থিত বক্তৃতা; সবকিছুতেই রিমা পুরস্কার নিয়ে আসতেন। গার্লস গাইড, রেডক্রিসেন্টের লিডার ছিলেন রিমা। ছোটবেলা থেকেই বিয়েবাড়িতে যেয়ে মেহেদি পরাতেন, বউ সাজাতেন। রিমা নিজের জামা কাপড় নিজেই সেলাই করতেন। এইসএসসির পর রিমার বিয়ে হয় প্রকৌশলী মো. মইনুদ্দিন জুলফিকারের সঙ্গে। দুইসন্তান হওয়ার পরে রিমা গ্রাজুয়েশন করেন এবং পর্যটন ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা করেন ১৯৯০ সালে। ১০০টিরও বেশি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘গৃহসুখন’। ‘গৃহসুখন’-এর স্লোগান ‘প্রশিক্ষণ নিন, আয় করুন।’এ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকার রান্না, ফুড প্রসেসিং, হস্তশিল্প, ড্রেস মেকিং, টেইলারিং, ফ্যাশন ডিজাইন, বিউটিসিয়ান সহ ১০০টির অধিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

তিনি ‘নেসলে ঝটপট রান্না’, ‘রাঁধুনি রান্না এখন খেলা’, ‘ডিপ্লোমা গুঁড়া দুধ মিষ্টি লড়াই’য়ের সঙ্গে কাজ করেন। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-এর বিভিন্ন প্রকল্পে ট্রেনিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

‘গৃহসুখন’ ২০০২ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে তালিকাভুক্ত হয়।

এরপর আর রিমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সুবিধাবঞ্চিত নারীদের নিয়েও রিমা কাজ করেন। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ওয়ার্ল্ড ভিশন, সুইস কন্টাক্ট-এর স্কিল ফুল প্রজেক্ট, ধানমন্ডি কামরাঙ্গীরচর ও রায়ের বাজারে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে অনেক সুবিধাবঞ্চিত নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কারিগর হিসেবে তৈরি করার সুযোগ হয়েছে। ইউএনডিপি, ইউপিপি এবং সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পেরমাধ্যমে কেয়ারের সাথে সুবিধাবঞ্চিত ৫০০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং একবছর ফলোআপ করেছেন।

এইভাবে অসহায় দুঃস্থ নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করেছেন। প্রশিক্ষণ শেষে নারীরা যখন পণ্য উৎপাদন করতেন, সেই পণ্য নিয়ে রিমা জুলফিকার বিভিন্ন দেশে নিয়ে যেতেন তখন আমাদের দেশের পণ্য বিদেশে অনেক সমাদৃত ছিল। হাউজহোল্ড প্রোডাক্টের চাহিদা অনেক বেশি ছিল এবং দেশের বিভিন্ন পণ্য বিদেশে ভীষণ প্রশংসিত হয়েছে। তিনি ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কনফারেন্স, ট্রেনিং ও বাংলাদেশি ট্রেডিশনাল পণ্য নিয়ে মেলা করে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করেন। রিমা শ্রেষ্ঠ নারীর উদ্যোক্তা হিসেবে ২০০৪ সালে ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স থেকে পুরস্কৃত হন। পরপর তিনবার এফবিসিসিআই থেকে শ্রেষ্ঠ পণ্য তৈরি ও বিক্রির জন্য পুরস্কার পান। আন্তর্জাতিক মৈত্রী সম্মেলন ২০১৯ এ বিশেষ অবদানের জন্য কলকাতা থেকে আর্টিস্ট আইরিক্যাল-এর আয়োজনে নারী উদ্যোক্তা হিসাবে ‘গৃহ সুখন’ এর চেয়ারম্যান হিসেবেপুরস্কৃত হন। গৃহ সুখন মহিলা সমিতির উদ্দেশ্য নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রত্যেককে যার যার কর্মক্ষেত্র গড়ে তুলতে পারে। প্রত্যেক নারীর হাত যেন কর্মীর হাতে পরিণত হয়। এতে দেশে বেকারত্বের হার কমবে এবং নারীরা আত্মনির্ভরশীল হবে বলে রিমা জুলফিকার বিশ্বাস করেন। রিমা নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রি করেছেন এবং বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণকরে তাদের পণ্য বিক্রি করার সুযোগ করে দিয়েছেন।

রিমা জুলফিকার মনে করেন তার সফলতায় পরিবারের অনেক ভূমিকা রয়েছে। শুধু তিনি নন এই বিশ্বজুড়ে যত সফল নারী আছে সবার পেছনেই পরিবারের একটি বড় অংশ সহযোগিতা করেছে বলে সম্ভব হয়েছে। নারীদের পথ চলা সবসময় কঠিন, বিশেষ করে আমাদের দেশে। এই পথ চলার সাথী হিসেবে যদি পরিবার ও কাছের বন্ধু-বান্ধবরা না থাকে তাহলে পথ যেন আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। সফলতার চাবিকাঠি হিসেবে পরিবার ও কাছের মানুষদের পাশে থাকা অনেক বেশি প্রয়োজন। তবে অনেক ক্ষেত্রে নারীরা তার আশেপাশের মানুষদের সহযোগিতা পায় না। তাই বলে কি সেই নারী থেমে যাবে? একদম নয়। এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে যাদের পাশে কেউ ছিল না, নিজেদের পথ তারা একাই পাড়ি দিয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন অনেক বেশি ইচ্ছা শক্তি। ইচ্ছা শক্তি দ্বারা যে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলা যায়। অনেক নারীরা স্বপ্ন দেখতে ভয় পান, আকাশে ডানা মেলে উড়তে ভয় পান। কিন্তু এই ভয়কে জয় করতে হবে। বড় স্বপ্ন দেখতে জানলে তবে সফলতার মুখ দেখা যাবে।

রিমা জুলফিকার বলেন, কোনো পেশায় আসার আগে জানতে হবে আগ্রহের বিষয় কোনটা এবং কোন কাজটা সে ভালো মতো করতে পারবে। কারণ কাজের প্রতি ভালোবাসা ও আগ্রহ না থাকলে সে কাজ দীর্ঘদিন করে যাওয়া অনেক বেশি কঠিন। অনেক সময় আমরা আরেকজনের গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে তার পেশা বেছে নেই। কিন্তু অন্যের দেখাদেখি পেশা বেছে নিলে সেই পেশায় দীর্ঘদিন লড়াই করে যাওয়া সম্ভব হয় না। সফল হতে না পারলে চলে আসে হতাশা। তিনি আরো বলেন, যেকোনো নারী নিজের ইচ্ছাশক্তি ও দক্ষতার মাধ্যমে সফল হতে পারে। কিন্তু সবার আগে কোন কাজে নিজের পারদর্শিতা দেখাতে পারবে সেই কাজটি খুঁজে বের করা জরুরি। যেকোনো পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করার আগে পড়ালেখা করা অনেক বেশি জরুরি। সেই পেশার খুঁটিনাটি সব জেনে বুঝে পা দিতে হবে। যেকোনো কাজের ক্ষেত্রেই খুব অল্প সময়ে সফলতার মুখ দেখা যায় না। অনেকেই রাতারাতি সফল হতে চায় এবং হতে না পেরে হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু যেকোনো পেশায় সফল হতে চাইলে ধৈর্য ধরতে হবে এবং প্রতিনিয়ত লেগে থাকতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: িইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

six − 5 =