নীলাঞ্জনা নীলা
নারী তার রূপ নিয়ে সচেতন এ নতুন চিত্র নয়। চেষ্টা থাকে নিজের প্রাকৃতিক রূপ ধরে রাখার কিংবা বিভিন্ন উপায়ে নিজের রূপকে আরও সমৃদ্ধ করার। যুগ যুগ ধরে নারীরা তাদের মুখের কিংবা রূপচর্চা করে থাকে। হলুদ বাটা, নিমপাতা বাটা ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপায়ে একসময় রূপচর্চা করা হতো। প্রকৃতি থেকে উপাদান নিয়ে তবেই হতো রূপচর্চা। তবে এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে রূপচর্চা করার পদ্ধতি। নিঃসন্দেহে বাজার থেকে কোনো কিছু কিনে আনার থেকে প্রকৃতি থেকে উপাদান নিয়ে রূপচর্চা করা বেশি উপকারী। বর্তমানে কাজের স্ট্রেস এবং ব্যস্ত জীবন আমাদের প্রকৃতি থেকে উপাদান নিয়ে রূপচর্চা করার জন্য সময় দেয় না। প্রাকৃতিক উপায়ে রূপচর্চা করতে গেলে তা প্রসেস করতে এবং তৈরি করে মুখে এপ্লাই করতে বেশ সময় লাগে। এই সময়ের ভয়ে অনেকে রূপচর্চা করা এড়িয়ে যায়। কিন্তু জীবন যতই ব্যস্ত হোক, স্কিন চায় তার সঠিক যত্ন। স্ট্রেসের জন্য আমাদের ত্বকের অবস্থা হয়ে যায় আরও নাজেহাল। তখন প্রয়োজন হয় আরও বেশি যত্নের। তাই এই ব্যস্ত জীবনে দ্রুত সমাধানের জন্য বর্তমানে রূপচর্চার জন্য বেশ জনপ্রিয় হলো শিট মাস্ক। রূপচর্চার জগতে এখন এটি বেশ পরিচিত একটি নাম।
চটজলদি শিট মাস্ক ব্যবহার করে ত্বকের যত্ন নেওয়া সম্ভব। তবে অনেকে মনে করেন যে কোনো একটি শিট মাস্ক কিনে মুখে ব্যবহার করলেই তা কাজে দিবে। কিন্তু ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। ত্বকের ধরন না বুঝে শিট মাস্ক ব্যবহার করলে ত্বকের উপকারের থেকে বরং ক্ষতি বেশি হবে। তাই শিট মাস্ক ব্যবহার করা শুরু করার আগে অবশ্যই এর সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে। বাজারে এখন বিভিন্ন নামের বিভিন্ন ধরনের শিট মাস্ক পাওয়া যায়। স্লিপিং মাস্ক মর্নিং মাস্ক, ইনস্ট্যান্ট মাস্ক ইত্যাদি দিয়ে চটজলদি যত্ন নেওয়া হয়। শিট মাস্কের প্রচলন মূলত এসেছে কোরিয়া থেকে। আমরা জানি কোরিয়ান স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট বেশ জনপ্রিয়। ব্যস্ততার কারণে অনেকেই নিজের স্কিনের সঠিক যত্ন নিতে পারে না সেজন্যই মূলত শিট মাস্ক ব্যবহার করা হয়। যাতে করে ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে যেকেউ নিজের স্কিনের যত্ন নিতে পারে। স্কিনের ধরন বুঝে নানাধরনের শিট মাস্ক বাজারে পাওয়া যায় কিংবা ঘরেও বানিয়ে নেওয়া যায়। আজ আমরা জানবো সৌন্দর্য জগতের অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় ক্লে মাস্কের ব্যাপারে।
ক্লে মাস্ক
ক্লে মাস্ক সাধারণত মিহি পলি, খনিজ উপাদান দিয়ে বানানো হয়, যা স্কিনের জন্য উপকারী। বাজারে দুই ধরনের ক্লে মাস্ক পাওয়া যায়। এক হলো বেনটোনাইট ক্লে আরেকটি ক্যাওলিন ক্লে। বেনটোনাইট ক্লে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। কারণ এটি ব্যবহারের পর খুব দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায়। এটি অগ্ন্যুৎপাতের ছাই থেকে তৈরি করা হয়। আবার অন্যদিকে ক্যাওলিন একটু ধীর গতিতে কাজ করলেও এর কার্যকারিতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
কাদের জন্য ক্লে মাস্ক
অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি অবহেলা করে। অনেকের ধারণা যেকোনো একটি মাস্ক মুখে ব্যবহার করলেই হলো। কিন্তু এটি একদম সঠিক নয়। যেকোনো ধরনের মাস্ক ব্যবহার করার আগে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে ক্লে মাস্ক যেহেতু অনেক শক্তিশালী হয়। এর ক্ষেত্রে আরও বেশি সাবধানতা প্রয়োজন।
ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করতে
অনেকের ত্বক ডিহাইড্রেশনের কারণে কিংবা রোদে পুড়ে গিয়ে নিজস্ব উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে। ক্লে মাস্ক একদম ত্বকের ভেতরে ঢুকে দূষিত পদার্থ বের করে ত্বককে পুনরায় উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন কারণে ত্বক অনেক সময় তার সজীবতা হারিয়ে মলিন হয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রেও ক্লে মাস্ক কাজ করে।
তৈলাক্ত ভাব দূর করতে
এটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ত্বকের তেল চিটচিটে ভাব দূর করতে। ব্রণ থেকে শুরু করে ত্বকের যাবতীয় সমস্যা হয়ে থাকে তৈলাক্ত ত্বকে। যাদের ত্বক অতিরিক্ত তৈলাক্ত তারা ঘুম থেকে উঠে নাকের পাশে তেল জমা দেখতে পায়। তৈলাক্ত ত্বকে ব্রণ সেরে যাওয়ার পরেও অনেক সময় দাগ বসে যায়। ক্লে মাস্ক স্কিনের তেল দূর করতে যাদুর মতো কাজ করে। এছাড়া তৈলাক্ত ত্বকের কারণে সৃষ্টি হওয়া ত্বকের যেকোনো সমস্যা এটি দূর করে দেয়। তৈলাক্ত ত্বকে অনেক সময় ব্যাকটেরিয়া থাকে, সেই ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে ক্লে মাস্ক।
বলিরেখা দূর করতে
বয়সের কারণে অনেকের মুখে বলিরেখা পড়ে থাকে। আবার অনেকের বিভিন্ন কারণে বয়স হবার আগেই মুখে বলিরেখা দেখা যায়। এসব বলিরেখা সাধারণত অনেক জেদি হয়ে থাকে, সহজে দূর হতে চায় না। নিয়মিত ক্লে মাস্ক ব্যবহারের ফলে জেদি বলিরেখা দূর হয়।
ওপেন পোরস
অনেকের মুখের পোরস অনেক বড় হয় যা চোখে পড়ে। সাধারণত পোরস এতো ছোট হয় যা চোখে পড়ার কথা নয়। কিন্তু যাদের ওপেন পোরস হয় তাদের পোরস দেখা যায়। যা অনেক বিব্রতকর। নিয়মিত ক্লে মাস্ক ব্যবহার করলে ওপেন পোরস ভিজিবিলিটি কমে যায়। ক্লে মাস্ক সেবাম প্রোডাকশন দূর করে
ইনস্ট্যান্ট ব্রাইটেনিং
অনেক সময় যেকোনো প্রোগামের আগে স্কিন মলিন হয়ে থাকে। কিন্তু ক্লে মাস্ক ব্যবহারের ফলে ডালনেস দূর হয়ে ইনস্ট্যান্ট ব্রাইটেনিং পাওয়া যায়।
কারা ক্লে মাস্ক ব্যবহার করবে না
ক্লে মাস্ক সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় অয়লি স্কিনের জন্য। এটি স্কিনের ভেতর থেকে তেল বের করে নিয়ে আসে। কিন্তু যাদের স্কিন অতিরিক্ত শুষ্ক তাদের ক্লে মাস্ক ব্যবহার না করাই ভালো। তবে ক্লে মাস্ক ব্যবহার করলে ক্যাওলিন ক্লে ব্যবহার করা উচিত, কারণ এটি স্কিনকে তেমন রুক্ষ করে না। রুক্ষ স্কিনে ব্যবহার করলে ক্লে মাস্ক ব্যবহার করে পানি দিয়ে তুলে ফেলার পর শুকিয়ে যাওয়ার আগেই ভালো করে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। যাদের স্কিন অনেক বেশি সেনসিটিভ তাদের ক্লে মাস্ক ব্যবহার করার পর জ্বালা পোড়া অনুভব হতে পারে। তাই অবশ্যই ক্লে মাস্ক ব্যবহার করার আগে স্কিনের ধরন বুঝে ব্যবহার করতে হবে।
বাজারে এখন বিভিন্ন রঙের ক্লে মাস্ক পাওয়া যায়। রঙ ভেদে এটির কার্যকারিতাও বদলে যায়। যেমন মুখের ব্রণ দূর করার জন্য কালো ক্লে ব্যবহার করা উচিত। এটি মুখের ভেতর থেকে ব্রণের দাগ দূর করে। যুগ যুগ ধরে স্কিনের যত্নে মুলতানি মাটি ব্যবহার করা হয়। লাল ক্লে সাধারণত মুলতানি মাটি ও গোলাপ জল দিয়ে বানানো হয়, এটি স্কিনের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। আবার সাদা ক্লে স্কিনকে হাইড্রেটিং রাখে।
ক্লে মাস্ক কেন ব্যবহার করব
ঘর থেকে বের হলেই স্কিনে বাসা বাঁধে ধুলাবালি। আর এই জমে যাওয়া ধুলা থেকেই হয় স্কিনের নানারকম সমস্যা। স্কিনের ভেতর জমে যাওয়া ময়লা অনেক সময় শুধু ফেস ওয়াশ ব্যবহার করে দূর করা সম্ভব হয় না, প্রয়োজন হয় ডিপ ক্লিনজিংয়ের। এছাড়া ক্লে মাস্ক ব্যবহারের ফলে স্কিন প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়। স্কিনকে একদম গভীর থেকে পরিষ্কার করতে ক্লে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
ক্লে মাস্ক ব্যবহারের নিয়ম
ক্লে মাস্ক সপ্তাহে এক কিংবা দুইদিন ব্যবহারই যথেষ্ট। এক টেবিল চামচ ক্লে মাস্ক তিন টেবিল চামচ পানির সঙ্গে মিশিয়ে মিহি পেস্ট তৈরি করে নিন। পানির বদলে গ্রিন টি, গোলাপজল অথবা অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার করতে পারেন। কখনো লেবুর রস বা ভিটামিন সি জাতীয় তরল মেশাবেন না। এতে মাস্কের কার্যকারিতা কমে যাবে। ত্বকে ব্রণের উপদ্রব থাকলে কয়েক ফোটা টি ট্রি অয়েল মিশিয়ে নিতে পারেন। ত্বকে আর্দ্রতার ঘাটতি থাকলে ব্যবহার করতে পারেন আমন্ড অয়েল। যাদের ত্বক শুষ্ক, তারা গ্লিসারিন বা মধু ব্যবহার করে পেস্ট তৈরি করে নিতে পারেন। মাস্ক তৈরির পাত্র এবং চামচ যেন ধাতব না হয়। কাচ, সিরামিক, কাঠ বা মাটির পাত্র ও চামচ ব্যবহার করুন। মুখ পরিষ্কার করে সমানভাবে পুরো মুখে পেস্টটি মেখে নিন। অবশ্যই চোখ, ঠোঁট এবং চুলের আশপাশের ত্বক এড়িয়ে চলুন। ১০-১৫ মিনিট মাস্কটি মুখে রাখুন। এর পর ধুয়ে ফেলুন। যাদের ত্বক শুষ্ক, তাদের মনে রাখতে হবে, মাস্কটি যেন একেবারে শুকিয়ে না যায়। মাস্ক শুকিয়ে ত্বকে টান টান ভাব আসার আগেই তা ধুয়ে ফেলুন।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আরশী