রেকর্ড উৎপাদনেও আলুর দামে রেকর্ড!

মাহবুব আলম

এক সময় বলা হতো ভাতের উপর চাপ কমান, ভাতের বিকল্প আলু খান। এরপর বলা হলো, বেশি করে আলু খান ভাতের উপর চাপ কমান। এটা এই জন্য বলা হতো আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী চালের উৎপাদন কম। অন্যদিকে চাহিদার তুলনায় আলুর উৎপাদন বেশি। সেই সাথে চালের চাইতে আলুর দামও কম। অর্ধেকের বেশি কম। কিন্তু এখন কি অবস্থা? এখন চালের চাইতে আলুর দাম বেশি। এটা সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, আলুর দাম এখন আর মোটা চাল নয়, চিকন চালের দামকেও ছাড়িয়ে গেছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তায় এই দাম উঠেছে প্রতি কেজি ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। যা ডিসেম্বরের শুরুতে ছিল ৭০-৭২ টাকা। তাও আবার এই দাম বৃদ্ধি হয়েছে নতুন আলু ওঠার পর। অর্থাৎ আলুর মৌসুমে। অতীতকাল থেকে এযাবৎকাল পর্যন্ত শুধু আলু কেন যে কোনো পণ্যের দাম মৌসুমে কমে আসে। আর মৌসুম শেষ হলে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এবার আলুর ক্ষেত্রে একেবারে বিপরীত চিত্র। ভরা মৌসুমেও ৩৬ টাকার আলু বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকা কেজি দরে। যা সরকার নির্ধারিত দামের দ্বিগুণের বেশি দামে। সরকার নির্ধারিত দাম ৩৬ টাকা।

ইতিপূর্বে বলেছি, ৩৬ টাকার আলু বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়। প্রকৃতপক্ষে এটা হবে ১১/১২ টাকার আলু বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকা। কারণ গত আলুর মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা এই দামে আলু কিনেছে। তারপরও সরকার ব্যবসায়ীদের আবদার মেটাতে আলুর দাম নির্ধারণ করে ৩৬ টাকা। যা ছিল রীতিমতো অন্যায় ও ভোক্তাদের প্রতি অবিচার। তারপরও সরকার নির্ধারিত দামে ব্যবসায়ীরা আলু বিক্রি করেনি। সরকারের নাকের ডগায় এরা আলু বিক্রি করে ৫০-৫৫ টাকা কেজি দরে। এরপর গত কয়েক মাসে তা বাড়তে বাড়তে ৮০-৮৫ টাকা তুলেছে। অথচ এ বিষয়ে সরকার নির্বিকার। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নির্বিকার। এই দপ্তর নির্বিকার চিত্তে ডিসেম্বরের মাঝ সপ্তাহে এক বিবৃতিতে বলেছে, ওদের চারটি টিম নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু কোথায় এই অভিযান? আর এই অভিযানের ফল কি তা তারা জানায়নি। জানানোর কথাও না।

৩৬ টাকার আলু ৮০-৮৫ টাকায় বিক্রি মানে কালোবাজারি। অথচ একজন কালোবাজারি বা মজুদদারকে গ্রেপ্তার বা শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এতে করে সরকারের মুখোশও খসে পড়েছে। স্পষ্ট হয়ে গেছে সরকার এ বিষয়ে নজর দিতে রাজি নয়। রীতিমতো রহস্যজনক ঘটনা। অবশ্যই, একই ঘটনা ঘটেছে অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও।

এখানে বলা দরকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বলা হয় ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই। কিন্তু এক্ষেত্রে কি বলবেন আমাদের কথিত পুঁজিবাদী অর্থনীতির দাবিদার ও কথিত-ঘোষিত পুঁজিবাদী ও মুক্তবাজারের সমর্থক দল ও ব্যক্তিবর্গ, যেখানে উৎপাদনে রেকর্ড ও চাহিদা কম সেখানে কেন দাম বাড়ে?

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে এবং সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছে। এর পরিমাণ ১ কোটি ৯ লাখ টন। আর আমাদের চাহিদা ৮০-৮৫ লাখ টন। আর এই কারণেই আমাদের কৃষিমন্ত্রী রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আলু রপ্তানির ঘোষণা দেন। অর্থাৎ রেকর্ড উৎপাদনেও মূল্যবৃদ্ধি। এখানে চাহিদা ও সরবরাহ ঠিক থাকার পরও দাম বাড়ানো এ কোন অর্থনৈতিক তত্ত্ব বাস্তবায়ন হচ্ছে দেশে? হ্যাঁ, এও এক অর্থনীতি। এই অর্থনীতি হচ্ছে, লুটেরা অর্থনীতি, কালোবাজারের অর্থনীতি, চোরাচালানির অর্থনীতি। আর এটা সম্ভব হচ্ছে তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে।

কথিত মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের ছাতার নিচে অনেক শক্তিশালী কর্পোরেট সংস্থা ও সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। যারা রাষ্ট্রের কাছে থেকে নানা অন্যায় সুবিধা আদায় করে বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক ধারাকে বদলে দিয়ে রাষ্ট্রকে জিম্মি করে ইচ্ছামতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অর্থাৎ ইচ্ছামতো মুনাফা লুটে।

এটাই এখন এদেশের স্বীকৃত ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। তাই এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সেরা ব্যবস্থার তকমা দেওয়া দল-গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আর রাষ্ট্রকে মৌসুমের শুরুতে সরাসরি কৃষকের থেকে আলু কিনে তা হিমাগারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। সেইসাথে যে বা যারা সিন্ডিকেট করে জনগণের পকেট কাটে; সরকারকে তাচ্ছিল্য করে, রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার চেষ্টা করে তারা কোনোমতেই ব্যবসায়ী নয়, ওরা চোরাকারবারি, দুর্বৃত্ত। ওদের সেইভাবেই ধরে ধরে শাস্তি দিতে হবে। মন্ত্রণালয়ে ডেকে চা নাস্তা খাইয়ে আবেদন নিবেদন বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যার যে জায়গা তাকে সেই জায়গাতেই স্থান দিতে হবে। চোরাকারবারিদের স্থান কারাগার। কারাগারে ওদের স্থান হওয়া উচিত। এটাই জাতির প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা পূরণ হলে আলুর দামে উর্ধ্বগতি, আলুসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের চোরাকারবারিও বন্ধ হবে। এটা দেখার জন্য দেশবাসীর প্রত্যাশা কবে পূরণ হবে কে জানে?

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 × 1 =