রেখার জীবন ও রূপ রহস্য

নীলাঞ্জনা নীলা

বলিউডে এক অতি পরিচিত নাম রেখা। যিনি একসময় একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন ইন্ডাস্ট্রিকে। ১৯৬৬ সালে ‘রাঙ্গুলা রত্নম’ নামে একটি তেলুগু ছবির মাধ্যমে শিশুশিল্পী হিসেবে তার চলচ্চিত্র জীবন শুরু হয়। নায়িকা হিসেবে ১৯৭০ সালে শাওন ভাদো নামে একটি ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি বলিউডে যাত্রা শুরু করেন। ৪০ বছরের অভিনয় জীবনে রেখা ১৮০টির অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৮১ সালে ‘উমরাহ জান’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

রেখা অভিনেতা জেমিনি গণেশন ও অভিনেত্রী পুষ্পাভ্যাল্লীর কন্যা। তিনি ১০ অক্টোবর ১৯৫৪ সালে মাদ্রাজে জন্মগ্রহণ করেন। রেখা খুব অল্প বয়সেই স্কুল ত্যাগ করেন এবং অভিনয়ে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন। বড় হয়ে রেখা তার বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করেন। রেখা তার বাড়িতে তেলুগু ভাষা কথা বলতেন কারণ তার বাবা ছিলেন তামিল। তামিল ভাষা ছাড়াও রেখা বেশ আরো কয়েকটি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে স্কুল ছেড়ে ছায়াছবিতে কাজ করতে বাধ্য হন তিনি।

রেখার ব্যক্তিজীবন নিয়ে সবসময় ছিল সমালোচনা। সিনেমার পাশাপাশি তার ব্যক্তিজীবন নিয়েও ছিলেন আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। তার জীবনের গল্প অবশ্য সিনেমার গল্পের চেয়েও কম নয়।

ইয়াসির ওসমানের লেখা রেখার জীবনীগ্রন্থে তিনি প্রথম বলেন জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র ‘আনজানা সফর’-এ অভিনয় করতে গিয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। তার বয়স তখন ছিল ১৫ বছর। এ ঘটনা তার জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো সারাজীবন তাড়া করে বলে বলেছিলেন তিনি। একটি সাক্ষাৎকারে রেখা জানিয়েছিলেন তার গায়ের রং ও দক্ষিণ ভারতের বিশেষত্বের কারণে দেখতে খারাপ এক শিশু বলে মনে করা হত। একটা সময় ছিল যখন রেখাকে তার চেহারা নিয়ে অনেকের অনেক মন্তব্য শুনতে হতো। ছোটবেলায় তার গড়ন মোটা থাকার কারণে তাকে ‘কালো হাঁস’ বলে মজা করা হতো। অনেক পরিচালক তাকে বলতো ‘এই আফ্রিকান সুন্দরী নায়িকা হবেন কীভাবে?’। তিনি নিজেকে পরিবর্তন করেছেন অনেক জেদ নিয়ে। ওজন কমানোর জন্য দিনের পর দিন দুধ ও এলাচ খেয়ে থেকেছেন। তার চেহারায় পরিবর্তন আনতে লেগেছে শুধুমাত্র আড়াই বছর। নানা লোকের নানান কথা তার শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি প্রচুর শরীরচর্চার সঙ্গে নিয়ম মাফিক চলা শুরু করে দেন। নিজের ইচ্ছা শক্তিতে নিজেকে বদলে ফেলেন। নিজের বিষয়ে মানুষের ধারণা বদলাতে তিনি দৃঢ সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। পরবর্তী ছবি বাছতে শুরু করেন অর্থাৎ কোন ছবিতে অভিনয় করবেন সেটা বাছ বিচার করতে থাকেন। ১৯৭৬ সালে ‘দো আনজানে’ তার প্রথম পারফরমেন্স ওরিয়েন্টেড ছবি ছিল। ভক্তরা এই চরিত্রে তাকে পছন্দ করেন। ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘ঘর’ এক অত্যাচারিত নারীর ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন। যেখানে এক ধর্ষিতার জীবনের কান্না লুকিয়ে ছিল, কঠোর জীবন সংগ্রামের ছবিও ফুটে উঠেছিল। যা তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সুপারহিট ছবি ছিল। বিনোদ মেহেরার সঙ্গে সমানে সমান টক্কর দিয়ে অভিনয় করেছিলেন। তার স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিনোদ মেহেরা। স্বামীর সেবা ও ভালবাসায় আস্তে আস্তে জীবনের গতিপথে ফিরে আসেন। মূল কাহিনির উপজীব্য বিষয় ছিল এটাই। ঘর ছবিতে অভিনয় করে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয়ের জন্য প্রথম ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিলেন।

রেখা ও অমিতাভ বচ্চন বেশ কয়েকটি ছবি একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। দু’জনের অনস্ক্রিন কেমিস্ট্রি প্রতিদিনই খবরের কাগজের গসিপে পরিণত হয়েছে। সেই কাহিনি নিয়মিত প্রকাশিত হতো কাগজে-পত্রিকায়। রেখা ১৯৭৮ সালে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ‘মুকাদ্দর কা সিকান্দর’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। এই ছবিই সেই দশকের সব থেকে বড় হিট ছবি ছিল। এরপরেই অভিনেত্রীর এক নম্বর স্থানটি দখল করেন রেখা।

১৯৯০ সালে রেখা ব্যবসায়ী মুকেশ আগরওয়ালকে বিয়ে করেন। বিয়ের এক বছর পর মুকেশ আগরওয়াল আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই সময়ে তিনি আমেরিকায় ছিলেন। রেখার ঘনিষ্ঠ মানুষেরা সেই সময়কে রেখার জীবনের অত্যন্ত কঠিন সময় বলেই মনে করেছেন। রেখার প্রথম স্বামী মুকেশ আগারওয়াল মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। ব্যাপারটা ঠিক জানতেন না রেখা। এক পর্যায়ে মুকেশ আত্মহত্যা করেন। স্বামীর মৃত্যুর জন্য রেখাকেও দায়ী করে অনেক সংবাদমাধ্যম। কিন্তু সবকিছু পিছনে ফেলে নতুনভাবে জীবন শুরু করেন রেখা। ১৯৭৩ সালে মিডিয়াতে খবর রটে রেখা অভিনেতা বিনোদ মেহরাকে বিয়ে করেছেন। এ নিয়ে বিনোদের মা রেখার সাথে বাজে ব্যবহার শুরু করেন। এমনকি পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার সময়ে রেখাকে ধাক্কাও মারেন তিনি। পরবর্তীতে বিনোদের মধ্যস্থতায় ব্যাপারটি মিটমাট হয়।

রেখার জীবনে এমন অনেক গল্প যেন শেষ হবার নয়। কিন্তু আজও তার গ্ল্যামারের কাছে দাঁড়াতে পারবেন না অনেক তারকা। যেকোনো অনুষ্ঠানে শুধু শাড়ি পরে গিয়েই যেন ঝলমল করতে থাকেন তিনি। রেখার দিক থেকে চোখ ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ে। তার ‘আঁখো কি মস্তি’ আজও ঘায়েল করে পুরুষকে। রেখা মানেই প্রজন্মের পর প্রজন্মের হৃদয়ে দোলা। এই বয়সেও যেন একফোঁটা কমেনি রূপ লাবণ্য।

অভিনয় দক্ষতার পাশাপাশি নায়িকার রুপের প্রশংসাও অব্যাহত বলিপাড়ায়। তার এই রূপ রহস্য নিয়ে তিনি নিজেই বলেন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। খাদ্যাভ্যাসে সময় মতো পানি পানকে খুব গুরুত্ব দেন সত্তরের দশকের দাপুটে অভিনেত্রী রেখা। পাশাপাশি শাকসবজি সমৃদ্ধ খাওয়া দাওয়াই পছন্দ তার। জাঙ্ক ফুড থেকে চিরকালই দূরে থেকেছেন তিনি। ভাজাপোড়া খাবার ছুঁয়েও দেখেন না। ঘুম থেকে অ্যরোমা থেরাপি সবকিছুই নিয়মমতো চলে, অনিয়ম পছন্দ নয় তার। আর নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমকে অনেক গুরুত্ব দেন এই অভিনেত্রী। একই সঙ্গে রূপচর্চায় ব্যবহার করেন বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক থেরাপি। প্রতিদিন তিনি স্পা সেশনের জন্য বেশ খানিকটা সময় দেন। এজন্য তিনি বিশেষ ধরনের তেল ব্যবহার করেন।

বলিউড নায়িকাদের মধ্যে যোগ ব্যায়ামের জন্য রেখা বিখ্যাত। বহুদিন আগে ইয়োগা নিয়ে একটা সিডিও বেরিয়েছিল তার। প্রতিদিন কমপক্ষে আধ ঘণ্টা ধরে ইয়োগা করেন। নিত্যদিনের যোগভ্যাসই রেখাকে তরুণ আর সতেজ রাখে। এই যোগের কল্যাণেই ষাটোর্ধ্ব এই অভিনেত্রী এখনও আইফা-র মতো মঞ্চে গিয়ে সমান দক্ষতায় ‘সলামে ইশক’ গানের তালে নাচতে পারেন! রেখা এমন ধরনের খাদ্যাভ্যাস দিনের পর দিন পালন করেন। কোনও পার্টি বা অনুষ্ঠান থাাকলেও সেরকমই হয়। প্রতিদিন তার খাবার পাতে দুটি রুটি থাকেই। সঙ্গে থাকে, তেল ও মশলা ছাড়া সবজির তরকারি। এক বাটি দই। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যে তিনি রাতের খাবার সেরা ফেলেন। নিরামিষাশী রেখা ফল খাওয়াকে বেশ গুরুত্ব দেন। বেদানা, ব্লুবেরি, পেস্তা ও বাদাম জাতীয় বিভিন্ন জিনিস খেতে পছন্দ করে থাকেন। সবজির মধ্যে ব্রকোলি তার বিশেষ পছন্দ।

এছাড়াও ত্বক সতেজ রাখতে অ্যাভোকাডোকে গুরুত্ব দেন রেখা। মধু, টক দই আর ডিমের সংমিশ্রণে তৈরি একটি বিশেষ প্যাক রেখা নিজের চুলের যত্ন নিতে লাগান বলে জানা যায়। কখনওই চুলে হেয়ার ড্রায়ার, স্ট্রেইটনার, বা কার্লার্স লাগাতে পছন্দ করেন না রেখা। ত্বকের যত্ন বিভিন্ন সময়ে রেখাকে সাক্ষাৎকারে বলতে শোনা গিয়েছে যে তিনি ১০ থেকে ১২ গ্লাস পানি প্রতিদিন পান করেন। যা তার ত্বককে সুন্দর রাখতে সাহায্য করে। আর তাতেই ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে বলে জানিয়েছেন রেখা। আমরা সবাই দিনের আলোতে কাজে বের হই, তাই সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। তাই প্রত্যেক দিন সকালে সানস্ক্রিন লোশন লাগানোর অভ্যাস করুন। শুধু বাইরে বেরোলেই নয়, বাড়িতে থাকলেও সানস্ক্রিন লাগান। কারণ জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোই ত্বক বুড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ হতে পারে।

এছাড়া তিনি আরো বলেন সুন্দর ও সুস্থ থাকতে হলে ভেতর থেকে সুস্থ থাকতে হবে। আমাদের মন ভালো না থাকলে যত যাই করা হোক না কেন মুখে তা প্রকাশ পেয়ে যাবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

thirteen + three =