লেভারকুজেনের রূপকথা

নিবিড় চৌধুরী

বিকৃত আর অপমান করে এখন থেকে কেউ আর বেয়ার লেভারকুজেনকে ‘নেভারকুজেন’ ডাকার দুঃসাহস দেখাবে না। জার্মান ফুটবলের শীর্ষ লিগ জিততে না পারায় শত বছর ধরে যে অপবাদ সইতে হয়েছে ক্লাবটিকে অবশেষে সেটির ইতি ঘটল। নিজেদের ১২০ বছরের ইতিহাসে প্রথম বুন্দেসলিগা জিতল লেভারকুজেন। এখন থেকে তারা ‘নেভারকুজেন’ নয়, ‘উইনারকুজেন’ জার্মান ফুটবলের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন।

২০১২-১৩ মৌসুমের পর থেকে বায়ার্ন মিউনিখের সিন্দুকে বন্দী শিরোপা কেড়ে নিল লেভারকুজেন। মিউনিখ থেকে ১১ বছর পর বুন্দেসলিগা গেল নতুন এক শহরে। রাইন নদীর পূর্ব দিকের বাণিজ্যিক শহর লেভারকুজেনে। শিরোপা জয়ের রাতটি কখনো ভোলার নয় শহরটির অধিবাসীদের। এমন একটি মুহূর্তের জন্যই যে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসের মাকোন্দো গ্রামের সাত প্রজন্মের বুয়েন্দিয়া পরিবারের একেকজন সদস্যের মতো দিন কাটছিল তাদের!

সেই নিঃসঙ্গতার ইতি হলো। লিগের ২৯তম রাউন্ডে ফ্লোরিয়ান উইর্টজের হ্যাটট্রিকে ভের্ডার ব্রেমেনকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে। সেই ম্যাচে শেষ বাঁশি বাজতেই নিজেদের মাঠ বে অ্যারেনায় নেমে আসে ক্লাবটির হাজারো সমর্থক। সবার গায়ে লেভারকুজেনের লাল-কালো রঙের জার্সি। কারও কারও হাতে বুন্দেসলিগার ডামি ‘শিল্ড’, টিফো, পতাকা। আনন্দ উচ্ছাসে খেলোয়াড় ও সমর্থকেরা মিশে গেল এক স্রোতে। হাতে প্রিয় ক্লাবের স্কার্ফ উঁচিয়ে গাইল রক ব্যান্ড কুইনের ‘উই আর দ্য চ্যাম্পিয়ন’।

দাপুটে জয়ে সমর্থকদের সামনে অপরাজিত থেকে শিরোপা নিষ্পত্তি, সেটিও ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোর মধ্যে সবার আগে আর দুইয়ে থাকা বায়ার্নের চেয়ে ১৬ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে; এমন এক অবিশ্বাস্য মৌসুম কাটানোকে ‘অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয় ইতিহাস’ না বলে কী উপায় আছে! এ যেন এডগার রাইস বারোজের কোনো অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি অথবা হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের রূপকথার গল্প। যুগের পর যুগ অপেক্ষা শেষের গল্পটাকে যুগের পর যুগ স্মরণ করে যাবে লেভারকুজেনবাসী।

২০২২ সালের অক্টোবরের লেভারকুজেনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন জাবি আলোনসো। সে সময় ক্লাবটি ছিল অবনমন অঞ্চলে। দায়িত্ব নেওয়ার দুই বছরের মধ্যে লিগ জেতানো; রূপকথার গল্প যে এভাবেই লিখতে হয়, সেটি দেখালেন এই ২০০৫ সালের ইস্তাম্বুল জয়ের নায়ক। সেবার এসি মিলানের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে প্রথমার্ধে ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়া লিভারপুলকে ম্যাচের শেষ গোলটি করে সমতায় ফেরান আলোনসো। এই স্প্যানিশ ‘দ্য রেড বিয়ার্ডের’ অধীনেই এবার ৩১ বছর পর কোনো শিরোপার স্বাদ পেল লেভারকুজেন। খেলোয়াড় হিসেবে বায়ার্নের হয়ে তিনটি লিগ জিতেছিলেন। স্পেনের হয়ে ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো। রিয়াল মাদ্রিদের হয়েও জিতেছেন ঘরোয়া লিগের সবকিছু। আর এবার কোচ হয়ে প্রথম কোনো ক্লাবের দায়িত্ব নিয়েই শিরোপা। আলোনসোকে এখন সর্বজয়ী বলায় যায়। লম্বা সময় ধরে জার্মান ফুটবলে বায়ার্নের আধিপত্য। তবে সাবেক ক্লাবের একচ্ছত্র দাপট ভাঙতে পারাকে জার্মানির ফুটবলের জন্যই ভালো মনে করছেন আলোনসো, ‘অন্য দলের জয় হয়তো বুন্দেসলিগা ও জার্মান ফুটবলের জন্য স্বাস্থ্যকর।’

প্রথমবার লিগ জেতার জন্য লেভারকুজেনের চেয়ে বেশি অপেক্ষা আর কোনো ক্লাবকে করতে হয়েছে কি? উত্তরে অবশ্য ‘হ্যাঁ’ বলতেই হবে। নিজেদের ১৪০ বছরের ইতিহাসে লেস্টার সিটি প্রথম প্রিমিয়ার লিগ জিতেছিল ২০১৫-১৬ মৌসুমে, ইতালিয়ান কোচ ক্লদিও রেনেইরির অধীনে। তবে অপরাজিত শিরোপা জিততে পারেনি লেস্টার। সেই কীর্তি আছে শুধু আর্সেনালের। আর্সেন ওয়েঙ্গারের অধীনে ২০০৩-০৪ মৌসুমে আর্সেনাল লিগ জিতেছিল অপরাজিত থেকে। লিগের বাকি ৫ ম্যাচ জিতে সেই ‘ইনভিনসিবল আর্সেনালের’ কীর্তিতে ভাগ বসাতে পারবে কি লেভারকুজেন?

সেসব ভবিষ্যতের কথা। তার আগে মাঠে, ড্রেসিংরুমে বুন্দেসলিগা জয়ের রীতি অনুযায়ী বিশাল বিশাল গ্লাসে বিয়ার পান ও নাচে-গানে আরও দুই দিন কাটাল লেভারকুজেনের খেলোয়াড়েরা। মৌসুমের শেষ রাউন্ডে বেঅ্যারেনায় অগসবুর্গের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে আনুষ্ঠানিক উদ্?যাপনে মাতবে লেভারকুজেনিয়ানরা। তখন না আরও সাজসাজ রব পড়বে শহর জুড়ে।

শুধু আলোনসোকে নয়, এপ্রিলের মধ্যে শিরোপা নিষ্পত্তি করে ফেলা লেভারকুজেনের খেলোয়াড়দেরও দিতে হবে বড় কৃতিত্ব। এ মৌসুমে বুন্দেসলিগায় সর্বোচ্চ ১৩ অ্যাসিস্ট তাদেরই লেফ্ট ব্যাক আলেহান্দ্রো গ্রিমালদোর। এ তালিকার সেরা দশের মধ্যে চারজনই লেভারকুজেনের। তার মধ্যে উইর্টজের কথাটা বলতে হয় আলাদাভাবে। ১১ গোল ও ১০ অ্যাসিস্ট করে দুই তালিকাতেই সাতে এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। এ মৌসুমে উত্তর লন্ডন ছেড়ে দুজন জার্মান ফুটবলে এসেছিলেন। একজন ইংল্যান্ডের হ্যারি কেইন। আলিয়েঞ্জ অ্যারেনায় এসেও শিরোপা না জিততে পারার ‘অভিশাপ’ খণ্ডানো হলো না। আর সুইজারল্যান্ডের গ্রানিত জাকা জিতলেন লিগ। আর্সেনালে ৭ বছর কাটানোর পরও লিগ জিততে না পারা মিডফিল্ডারই বে অ্যারেনায় এসে শিরোপা জিতে বললেন, ‘জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত’।

২০০১-০২ মৌসুমে ট্রেবল জেতার খুব কাছে গিয়েও পারেনি লেভারকুজেন। এবার সেই স্বপ্নের খুব কাছে তারা। বুন্দেসলিগা জিতেছেন। ট্রফি ক্যাবিনেটে এই মৌসুমের ইউরোপা লিগ ও জার্মান কাপ জমা করতে পারলেই আরেকটি ইতিহাসের অধ্যায় লেখা হয়ে যাবে আলোনসোর নামে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

13 − one =