লোকসম্রাট আব্বাস উদ্দীন আহমদের জন্মদিন আজ

ঈদের আগের দিন বিটিভে বেজে ওঠে কাজী নজরুল ইসলামের রচিত গান “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’’। গানটি শ্রোতাদের কাছে  শ্রুতিমধুর করে তুলেছিলেন তিনি হচ্ছেন আব্বাস উদ্দিন। আজ-ও এই গান ছাড়া ঈদের আগের দিনটা অপূর্ণ থেকে যায়। এমন অসংখ্য গান সৃষ্টির কারিগর আব্বাসউদ্দীন আহমেদ। তিনি একজন বাঙালি লোক সঙ্গীতশিল্লী, সঙ্গীত পরিচালক এবং সুরকার। সংগীত অঙ্গনে ভাটিয়ালী ও পল্লীগীতির গায়ক হিসাবে আব্বাস উদ্দিনচিরদিন অমর হয়ে থাকবেন তিনি নিঃসন্দেহে।

আমাদের দেশজ গানের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের ১২০তম জন্মদিন আজ। ১৯০১ সালের আজকের দিনে পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতার নাম জাফর আলী আহমদ এবং মায়ের না বেগম লুৎফন নেসা। পিতা জাফর আলী আহমেদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের আইনজীবী।

আব্বাসউদ্দীনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের এক প্রাইমারি স্কুলে। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ হাইস্কুল থেকে আব্বাসউদ্দীন ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। কিন্তু এখানে বেশিদিন থাকা হয়নি।রাজশাহী কলেজ ছেড়ে ভর্তি হন কাছের শহর কুচবিহার কলেজে। ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তিনি কোলকাতায় চলে যান এবং সঙ্গীত চর্চায় মনোনিবেশ করেন।

তিনি ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বসবাস করেন। প্রথমে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে এবং পরে কৃষি দপ্তরে স্থায়ী পদে কেরানির চাকরি করেন। এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রিত্বের সময় তিনি রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। চল্লিশের দশকে আব্বাস উদ্দিনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আব্বাস উদ্দিন আহমদ এর পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী। কিন্তু সবকিছু ছেড়ে আব্বাস উদ্দিন ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের দিনই ভারতের কোলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৫ সালে ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংগীত সম্মেলন, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন।

তিনি প্রথম জনসম্মুখে গান করেন তার শিক্ষাঙ্গনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। তার প্রথম রেকর্ডকৃত গান হল -‘ওকি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে…’ এবং ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে…’। গান চর্চার সঙ্গে সঙ্গে এক পর্যায়ে তার সাথে পরিচয় হয় কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। কাজী নজরুল ইসলামের সহায়তায় কলকাতায় গিয়ে তিনি গ্রামােফান রেকর্ডে গান করেন । তার রেকর্ডকরা গানের সংখ্যা প্রায় সাতশো। এছাড়া ইন্দুবালা, জগত ঘটক, কাজী মোতাহার হোসেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আঙ্গুরবালা সহ অসংখ্য শিল্পীর সাথে পরিচয় ঘটে। কাজী নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় বেশ কিছু গান রচনা করেছিলেন তিনি। লােকসঙ্গীতকে শহুরে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে তার অবদান অতুলনীয়। তার কণ্ঠে লােকগীতির নানা রূপই শ্রুতিমধুর হয়ে উঠতো। ভাটিয়ালী , ভাওয়াইয়া , জারি , সারি , মুর্শিদী , দেহতত্ত্ব , বিচ্ছেদি , চা , ক্ষিরােল প্রভৃতি নানা শ্রেণীর অজস্র লােকগীতি গেয়েছেন তিনি । বিখ্যাত দোতারা বাদক কানাইলাল শীল আব্বাসউদ্দিনকে লােকগীতি প্রচারে ও প্রসারে বিশেষ সহায়তা করেন ।

শুধু গানই নয় আব্বাসউদ্দিন আহমেদ বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেনে। উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হলো ‘বিষ্ণুমায়া ’ (১৯৩২), ‘মহানিশা’ (১৯৩৬), ‘একটি কথা’ এবং ‘ঠিকাদার’ (১৯৪০)। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন। এছাড়াও আরও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত করা হয় এই গুণী শিল্পী কে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 × 2 =