রিপন নাথ একজন শব্দ প্রকৌশলী। বিগত দুই দশক যাবত ইন্ডাস্ট্রিতে সমানতালে কাজ করছেন তিনি শব্দগ্রাহক হিসেবে। একবার নয় দুইবার নয় চার চার বার অর্জন করেছেন শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তাকে নিয়ে লিখেছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত
ব্যাচেলর, আমার আছে জল, চন্দ্রগ্রহণ, মনপুরা, প্রজাপতি, টেলিভিশন, চোরাবালি, তারকাঁটা, জালালের গল্প, আইসক্রিম, সম্রাট: দ্য কিং ইজ হিয়ার, অজ্ঞাতনামা, আয়নাবাজি, স্বপ্নজাল, দেবী, ঢাকা অ্যাটাক, হালদা, বিজলী, বাঙালি বিউটি, ফাগুন হাওয়ায়, ডুব, সিতারা, সাপলুডু, ন ডরাই, কাঠবিড়ালী, হাওয়া, দেশান্তর, অপারেশন সুন্দরবন, অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন, দামাল; সবগুলো সিনেমার পর্দার পিছনের নায়ক এই ভদ্রলোক। গত এক যুগের সেরা বাংলা চলচ্চিত্রের তালিকা করলে উঠে আসবে এই তালিকার প্রায় সবগুলো সিনেমাই। তাই বলাই যায় রিপন নাথ নিজের দুই যুগের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কাজ করেছেন খুবই বুঝে শুনে। যুক্ত ছিলেন ভালো নির্মাণের সঙ্গে। প্রতিটি সিনেমায় প্রশংসিত হয়েছে রিপন নাথের কাজ। সকলেই আলাদা করে কথা বলেছেন তার কাজ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ওটিটি উত্থানের পর রিপন নাথও নিজেকে প্রমাণ করেছেন ভিন্ন ভাবে। আশফাক নিপুণের ‘মহানগর’ কিংবা শাওকীর ‘তাকদীর’ সবখানেই ছিলেন রিপন নাথ। সাউন্ড ডিজাইনে তারচেয়ে ভালো কেউ নেই বলার সুযোগ নেই। কিন্তু তার সঙ্গে নির্মাতাদের একটা আলাদা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গিয়েছে।
ইতিমধ্যে শব্দগ্রাহক হিসেবে রিপন নাথ একটা ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন তা অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। যার কারণ তার নামের সঙ্গে যুক্ত থাকা কাজগুলো। এত চমৎকার চমৎকার প্রজেক্টে কাজ করেছেন তিনি। নিজের দক্ষতার জানান দিয়েছেন বারবার। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী থেকে অমিতাভ রেজা, তৌকীর আহমেদ থেকে গিয়াস উদ্দিন সেলিম কিংবা আশফাক নিপুণ, শাওকী, রায়হান রাফি সবাই শব্দগ্রাহকের দায়িত্ব তার হাতেই দিয়ে নির্ভার থাকেন। তিনি নিজের কাজটা করবেন যত্ন সহকারে তারা তা বুঝে যান প্রথম কাজেই।
রিপন নাথের শব্দগ্রাহক হিসেবে অভিষেক হয় হুমায়ুন আহমেদের হাত ধরে। ২০০৮ সালে নিজের লেখা উপন্যাস থেকে হুমায়ুন নির্মাণ করেন ‘আমার আছে জল’ সিনেমাটি। তরুণ রিপন নাথ সম্পূর্ণ সাউন্ড ডিজাইনের ডিপার্টমেন্টটা সামাল দেন পরিপক্বতার সঙ্গে। হুমায়ূন আহমেদ নিশ্চয়ই আঁচ করতে পেরেছিলেন এই তরুণের সম্ভাবনা রয়েছে। দরকার শুধু একটা সুযোগ। তিনি তা দিয়েছিলেন। তারপর কেটে গিয়েছে ১৫টা বছর। রিপন নাথের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজেকে প্রমাণ করেছেন বারবার ভিন্ন ভিন্ন কাজে। নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টায় সবসময়ই মুখিয়ে থাকতেন। অবশ্য সিনেমায় প্রথম কাজ করেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ব্যাচেলর’ সিনেমায় ২০০৪ সালে। তিনি সেখানে ছিলেন সহকারী শব্দগ্রাহক হিসেবে। তারপর অমিতাভ রেজার ডকুমেন্টারি ফিল্মে কাজ করেছেন।
ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন মিউজিশিয়ান হবেন। ওস্তাদজির কাছে নিয়মিত তালিম নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে মনে হলো কিছু একটা করতে হবে। নিজের মেজো ভাই স্বপন নাথের কাছের বন্ধু ছিলেন শব্দ প্রকৌশলী রতন পাল। তার সঙ্গে কাজ করতে চাওয়ার ইচ্ছে জানান ভাইকে। তারপর স্বপন নাথ পরিচয় করিয়ে দেন রতন পালের সঙ্গে।
এভাবেই মিডিয়ায় ঢুকে পড়া রিপন নাথের। স্ট্রাগল, স্ট্রাগল, স্ট্রাগল…শুরুর সময়টা এমনই ছিল। প্রায় পাঁচ বছর রিপন নাথ স্ট্রাগল করেছেন নিজের সঙ্গে। কর্মজীবন শুরু বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিকের ধ্বনিচিত্রে। সেখানে ছিলেন প্রায় ১০ বছর। প্রথম কাজ অমিতাভ রেজার একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম। প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্রের কাজও অমিতাভ রেজার সঙ্গে; সানসিল্কের একটা বিজ্ঞাপন।
২০১৩ সালের জুলাই মাসে ‘সাউন্ডবক্স’ নামের একটি স্টুডিও চালু করেন তিনি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই গড়ে তোলেন ‘সাউন্ডবক্স স্টুডিও’। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজিয়েছেন স্টুডিওটি। এখানে রয়েছে চৎড়ঃড়ড়ষং ঐউঢ, অত্যাধুনিক গরপৎড়চযড়হব ্ ঝড়ৎৎড়ঁহফ ঝড়ঁহফ ঝবঃঁঢ় যার মাধ্যমে একটি ফিল্মের পূর্ণাঙ্গ সাউন্ডের কাজ করা সম্ভব। এবছর দশ বছরে পা দিবে রিপন নাথের সাউন্ড বক্স।
২০১২ সালে রেদোয়ান রনির ‘চোরাবালি’ সিনেমায় কাজ করার মাধ্যমে প্রথম শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন রিপন নাথ। তারপর অমিতাভ রেজা চৌধুরী ‘আয়নাবাজি’ ও দীপংকর দীপনের ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমার অনবদ্য কাজ করার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। সর্বশেষ তানিম রহমান অংশুর ‘ন ডরাই’ সিনেমায় কাজ করে আবারও শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। দেশের পাশাপাশি ভারতের সিনেমায়ও কাজ করেছেন রিপন নাথ। আশিষ রায়ের ‘সিতারা’ সিনেমায় শব্দপ্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন।
হঠাৎ একদিন রাঁধুনির একটি বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম রিপন নাথকে। তারপর জানলাম, তিনি শুধু যে শব্দগ্রাহকের কাজ করেন তাই নয়, অভিনয়টাও ভালো করেন। ইফতেখার আহমেদ ফাহমির ‘আমাদের গল্পের চার বন্ধুর কথা’ বলা যেতে পারে। তাহসান, রওনক, ইরেশের সঙ্গে আরেকজন ছিলেন। তিনিই হচ্ছেন রিপন নাথ। অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘একটা ফোন করা যাবে প্লিজ’ নাটকে প্রথম অভিনয়ে আসেন তিনি।
অমিতাভ রেজা চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে রিপন নাথকে নিয়ে বলেছেন, আমি তো জীবনের প্রথম থেকেই ওর সঙ্গে কাজ করছি। আমার সিনেমাসহ প্রায় সব বিজ্ঞাপনের কাজ ওর করা। টেলিভিশন প্রডাকশনও যা বানিয়েছি সব করেছে ও। সে জানে আমি কী চাই। রিপনের সীমাবদ্ধতা একটাই। যেহেতু সে একা এবং একমাত্র এ পেশায়, তার হাতে প্রচুর কাজ। এ কারণে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না। এফডিসির বাইরে আমরা যারা ছবি বানাচ্ছি, রিপন নাথ তাদের ‘ওয়ান অ্যান্ড অনলি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার’। অনেক বছর ধরে সে আমাদের আস্থার জায়গা। আসলেই রিপন নাথ এই সময়ের সকল নির্মাতাদের আস্থার নাম।
রিপন নাথ সবগুলো কাজ শৈল্পিক ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। শব্দের মাধ্যমে অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আবহ তৈরি করতে তিনি পটু। কোয়ালিটি কাজ করা যেন তার কাছে দুধভাত। এ সময়ের আলোচিত, জনপ্রিয় কিংবা নামী প্রায় সব চলচ্চিত্রে সাউন্ডের কাজ করেছেন রিপন নাথ। মোটাদাগে বলা যায়, রিপন নিজের প্রতিভা এতটাই সূক্ষ্ম ভাবে বিকাশ করেছেন কাজের মাধ্যমে নির্মাতারা অন্য কাউকে কাজ দিয়ে ঝুঁকি নিতে নারাজ। সিনেমা তৈরি করে তার হাতে ছেড়ে দেন। তারপর সম্পূর্ণ সিনেমাটা আবার নির্মাতাদের হাতে তুলে দেন রিপন নাথ। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেলে’ ও ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’, মোহাম্মদ রাব্বি মৃধার ‘পায়ের তলায় মাটি নেই’ সিনেমা গুলো মুক্তির অপেক্ষায়। সিনেমা গুলোতে শব্দগ্রাহক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। রিপন নাথ অন্তরালের মানুষ হিসেবে কাজ করতে থাকুক এটাই প্রত্যাশা। তবে একটা অনুরোধ অনেক কাজের ভিড়ে নিজস্বতা যাতে হারিয়ে না যায় রিপন নাথের।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে