শরবতের ইতিহাস

হাসান নীল

শুধু তীব্র তাপদাহে স্বস্তি দিতেই ভূমিকা রাখে না শরবত, অতিথি আপ্যায়নের ভূমিকা অনেক। ধনী-গরীব, শ্রেণি-ধর্ম নির্বিশেষে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সবার কাছে সমান কদর পেয়ে আসছে এই মিষ্টি পানীয়। পশ্চাত্য থেকে প্রাচ্য, সর্বত্র এর চাহিদা রয়েছে। শরবত শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘শরবা’ ও ‘শরিবা’ থেকে। শরবা অর্থ পানীয় আর শরিবা অর্থ পান করা। এই দুটি শব্দ থেকে প্রথম আসে ‘শেরবেত’ নামের একটি তুর্কি  শব্দ। তুর্কি শেরবতই ধীরে ধীরে হয়ে যায় শরবত। আভিধানিকভাবে এটি ফারসি ভাষার শব্দ। তবে এখন অনেক দেশই নিজেদের ভাষায় শব্দটি গ্রহণ করে নিয়েছে।

শরবত সম্পর্কিত কয়েকটি প্রচলিত গল্প আছে। ১৪ শতকের শেষের দিকে নিজের জন্মভিটা সমরকন্দ উদ্ধার করতে গিয়ে উজবেকদের তাড়া খেয়েছিলেন মোগল সম্রাট বাবর। এরপর ভারতবর্ষে এসে ঘাঁটি গাড়েন। বসেন দিল্লির মসনদে। ওদিকে মসনদে বসেও সম্রাট বাবরের মন পড়েছিল জন্মভূমিতে। সেখানকার আঙ্গুর, খরমুজ, বরফ গলা জল, হরেক রকম ফল টানতো তাকে। এ সময় বাবর পান করতেন সিরাপ। ফল আর তার নির্যাস, ফুল, শিকড় দিয়ে তৈরি করা হতো সিরাপ জাতীয় এই পানীয়। এটি মূলত ছিল শরবত। বাবর নিজেও মুগ্ধ ছিলেন এর স্বাদে। তার শরবতের স্বাদ বাড়াতে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দিল্লিতে নিয়ে আসা হতো বরফ। ওই বরফ ডোবানো শীতল শরবত পান করে তৃপ্তি পেতেন সম্রাট। শুধু বাবর নয় তার পরবর্তী সম্রাটদের কাছেও শরবত ছিল প্রিয় পানীয়। মূলত এই মোগলদের হাত ধরে ভারতবর্ষে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে শরবত। যার শুরুটা হয়েছিল বাবরের মাধ্যমে।

মনে হতে পারে ভারতবর্ষে বাবরের হাত ধরেই আগমন ঘটেছে শরবতের। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায় অন্য তথ্য। বাবরের শাসনামলের প্রায় ২০০ বছর আগে ভারত শাসন করতেন মোহাম্মদ বিন তুঘলক। তার সময় এই উপমহাদেশে পা রেখেছিলেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা। তার লেখায় শরবতের উল্লেখ করেছিলেন। এ থেকে স্পষ্ট যে মোগলদেরও দুই শতাব্দী আগে ভারতবর্ষে শরবতের প্রচলন ছিল। বাবর ছাড়াও বিশ্বের বড় বড় ব্যক্তিদের নাম জড়িয়ে আছে শরবতের সঙ্গে। এদের একজন হচ্ছেন সম্রাট নিরো। রোম যখন জ্বলছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। সম্রাট নিরোকে এভাবেই চিনি আমরা। অনেকেই জানেন না তারও ছিল শরবত প্রীতি। বিশেষ এক ধরনের শরবত পান করতেন তিনি। বরফের সঙ্গে মধু মিশিয়ে সম্রাট নিরোর জন্য প্রস্তুত করা হতো ওই শরবত। খুঁজলে এরকম অনেক গল্প পাওয়া যাবে শরবতের।

মিশরের ফারাউদের নামও জড়িয়ে আছে শরবতের সঙ্গে। তাদেরও শরবত প্রীতি ছিল। মেহমানদের বরফ মেশানো ফলের রস দিয়ে আপ্যায়ন করতো তারা। এ বিষয়টি বাইবেলে উল্লেখ আছে। শরবতের উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। তবে এর বেশিরভাগই ধোপে টেকে না। কেননা নেই সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ। তাই শরবতের উৎপত্তিস্থল ঠিক কোথায় তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর ধোঁয়াশা। তবে ইতিহাসে উল্লেখ আছে প্রথম শরবতের কথা এসেছে ফারসি বই ‘জাকিরেয়ে খোয়ারজামশাহি’তে। ওই বইয়ে ইরানের বিভিন্ন রকম শরবতের বর্ণনা দেওয়া আছে। বর্ণনা করেছেন বিশিষ্ট ইসলামী চিকিৎসক ইসমাইল গড়গানি। তিনি আঙ্গুরের শরবত, ডালিমের শরবত, পুদিনার শরবতসহ হরেক রকম শরবতের কথা উল্লেখ করেছেন।

এবার আসি শরবত তৈরীর মূল কারণে। আগেকার দিনে শরবত তৈরি করা হতো মূলত ফলের নির্যাস সংরক্ষণ করার জন্য। আজকাল যেকোনো খাবার সংরক্ষণের জন্য আমরা রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করলেও আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে এই সুবিধা ছিল না। সে সময় ফলমূল আচার বানিয়ে সংরক্ষণ করতে মানুষ। তবে শুধু আচার খেতে খেতে একঘেয়েমি চলে  আসত। তাই ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতো তারা। ফল শুকিয়ে তার নির্যাস থেকে সিরাপ তৈরি করা হয়। এরপর সিরাপ রেখে দেওয়া হতো বছরের পর বছর। এই সিরাপই পরবর্তীতে শরবতে রূপান্তর করা হয়। তবে প্রাচীনকালে ঘন শরবতের প্রচলন ছিল। খেতে হতো চামচ দিয়ে কেটে। তবে ওই শরবতে পানি মিশিয়ে পাতলা করেও পরিবেশন করা হতো। মুসলিম বিশ্বে শরবতের জনপ্রিয়তা বাড়ার কারণটি ছিল ভিন্ন। ইসলাম ধর্মের বিধি অনুযায়ী দেশগুলোতে মদ্যপান নিষিদ্ধ। ফলে মুসলমানরা মদ ছেড়ে শরবতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ধীরে ধীরে মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শরবত।

জানা যাক দেশ-বিদেশের জনপ্রিয় কয়েকটি শরবত সম্পর্কে। এরমধ্যে একটি হচ্ছে ‘তামারিন্দ শারবেত’। এটি মূলত তেঁতুলের শরবত। যা ওসমানীয় আমল থেকে বিখ্যাত। তবে এর তৈরি প্রক্রিয়া অন্যান্য শরবতের মতো নয়। আট ঘণ্টা তেঁতুল সিদ্ধ করে তাতে ৪১ পদের মসলার সঙ্গে মিশিয়ে বানানো হয় এই শরবত।

ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডানে ‘জাল্লাব’ নামের এক প্রকার শরবতের প্রচলন রয়েছে। এটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় গোলাপ জল, খেজুর ও আঙুরের গুড়। পরিবেশন করা হয় বরফ, পাইন বাদাম ও কিসমিস সহকারে। মিশর, ফিলিস্তিনিতে ক্যারব নামে এক ধরনের ফল পাওয়া যায়। এই ফল দিয়ে তৈরি শরবত ওই দেশগুলোতে দারুণ জনপ্রিয়। শরবতকে বলা হয় ‘ক্যারব জুস’। শুকনা ফল পানির সঙ্গে সিদ্ধ করে চিনি যুক্ত করে তৈরি করা হয় এই শরবত।

সুদানে ‘হেলো মুর’ নামে এক প্রকার শরবত পাওয়া যায়। দেশটির মানুষের কাছে এটি ভীষণ প্রিয়, বিশেষ করে ইফতারে। গাঢ় বাদামি রঙের এই শরবত তৈরি করা হয় ভুট্টার দানা ও মসলা দিয়ে। সিরিয়ার আরও একটি জনপ্রিয় শরবতের নাম ‘কামার আল-দ্বীন’। এই শরবত তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এপ্রিকট নামের এক ধরনের ফল। কামার আল দ্বীন শরবত তৈরি হয় মূলত এপ্রিকটের দানা দিয়ে। পরিবেশন করা হয় চিনি ও গোলাপ জল মিশিয়ে।

উপমহাদেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় ‘মহব্বত কা শরবত’। এর উৎপত্তি স্থল দিল্লি। দিল্লির জামে মসজিদের আশপাশের এলাকা থেকে প্রচলন ঘটেছিল এই শরবতের। এটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় তরমুজ ও গোলাপ। গোলাপি রঙের এই শরবতের রঙ, সুবাস এবং এর উপর ভেসে থাকা তরমুজের টুকরাই আকর্ষণের কারণ। দিল্লির গণ্ডি ছাড়িয়ে বর্তমানে বাংলাদেশেও এটি বেশ জনপ্রিয়। ঢাকার বিভিন্ন স্থানেই এই শরবত বেশ সমাদর পেয়ে থাকে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে খেজুর ও দুধের শরবতের বেশ চাহিদা রয়েছে। এই শরবত তৈরিতে প্রয়োজন হয় খেজুর ও দুধ। দুধের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা খেজুর ভিজিয়ে রাখতে হয়। খেজুর নরম হয়ে গেলে তা ভালো করে মিশিয়ে নিতে হয়। এরপর বরফ দিয়ে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। প্রচলিত আছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) খেজুর ও দুধ দিয়ে ইফতার করতেন। এ কারণে ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের মাঝে খেজুর দুধের এই শরবতের চাহিদা বেশি। ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে ‘ইস কপিউর’ নামের এক ধরনের শরবত পাওয়া যায়। দেশ দুটিতে এর ভীষণ জনপ্রিয়তা। কপিউর হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের নারকেল। এরসঙ্গে মেশানো হয় কমলার রস। গোলাপি নির্যাসও মেশানো হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় নারকেলের নির্যাস বা দুধ। ইস কপিউরকে ‘মাকাপুনো’ বলেও ডাকা হয়।

ভারতবর্ষে প্রথম বাজারজাত করা হয় শরবত ‘রুহ আফজা’। এর উদ্যোক্তা ছিলেন হাকিম হাফিজ আবদুল মজিদ। ১৯০৬ সালে গাজিয়াবাদের হামদর্দ ল্যাবরেটরিতে থেকে ফল-ফুল আর ভেষজ দ্রব্যের নির্যাস থেকে সুস্বাদু এই শরবত তৈরি করেন তিনি। রুহ আফজায় মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন হাকিম আব্দুল মজিদ। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রিতিসের দর্শন অনুযায়ী এটি করেছিলেন তিনি। রুহ আফজার নাম ছড়িয়েছিল মূলত রোজার মাসে। ইফতারে পানীয়টি সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিত। ফলে জনপ্রিয়তা পেতে সময় লাগেনি। অল্পদিনেই ভারতীয় মুসলমানদের প্রিয় হয়ে উঠে। জায়গা নেয় ইফতারের আয়োজনে।

বাংলাদেশের হারাতে বসা একটি শরবত ‘মলিদা’। এটি বরিশালের ঐতিহ্যবাহী শরবত। একসময় গ্রামগঞ্জে মলিদার প্রচলন থাকলেও আজকাল তেমন একটা চোখে পড়ে না। চালের গুঁড়া, গরুর দুধ, নারিকেল দিয়ে তৈরি হতো এই শরবত। সত্তর আশির দশকে বরিশালের মানুষ পরিচিত ছিল এর সঙ্গে। বাড়িতে যেদিন মলিদা বানানো হতো সেদিন ভোর থেকেই আয়োজন শুরু হতো। এটি সবচেয়ে বেশি পান করা হতো ইফতারের সময়। এছাড়া অতিথি আপ্যায়নেও ব্যবহার হতো। তবে আজকাল মলিদার খুব একটা চল নেই। মাঝে মাঝে দু’একটি বাড়িতে কালেভাদ্রে বানানো হয়। এছাড়া দেশে লেবু, তেঁতুল, বেল, কালো জাম, কাঁচা আমসহ বিভিন্ন ফলফলাদির শরবত ভীষণ জনপ্রিয়।

আমের শরবত: কাঁচা আম-পুদিনা-ভাজা মশলার পারফেক্ট কম্বিনেশন। স্বাদের দিক থেকে অসামান্য। কাঁচা আম পুড়িয়ে শাঁস বের করে নিয়ে চটকে মাখুন। সঙ্গে খানিকটা পুদিনাপাতার কুচিও মিশিয়ে দিন। সাধারণ লবণের পরিবর্তে বিটলবণ ব্যবহার করুন। চিনি-গুড় মিশিয়ে শরবতে মিষ্টত্ব যোগ করুন।

বেলের শরবত: যাদের শরীর বেশি ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয় তারা বেলের শরবত খাবেন। এটি খুবই উপকারী পানীয়। বেল যদি মিষ্টি না হয় তখন প্রয়োজনে চিনির বিকল্প উপাদান মিছরি, যষ্টিমধু, খেজুরের পাউডার, গুড় ইত্যাদি দিয়ে শরবত তৈরি করা যেতে পারে।

গাজরের শরবত: বিশেষ করে বাচ্চা ও বয়স্ক যারা রোজা রাখেন তাদের জন্য উপকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ পানীয় গাজরের জুস। গাজরের জুস বা স্মুদিতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ থাকে।

আপেলের শরবত: আপেল ভালোভাবে পরিষ্কার করে কেটে নিন। খোসা ও বিচি বাদ দেবেন। এবার আপেলের টুকরাগুলো ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নিন। ব্লেন্ড হয়ে গেলে ছেঁকে নিন যাতে শরবত পরিষ্কার দেখা যায়। পানি ও পরিমাণমতো চিনি মিশিয়ে আধা ঘণ্টার মতো ফ্রিজে রেখে দিন। এরপর ফ্রিজ থেকে বের করে বরফ কুচি ও পুদিনা পাতা দিয়ে পরিবেশন করুন।

ডালিমের শরবত: ডালিমের খোসা ছাড়িয়ে রসালো বিচিগুলো বের করে নিন। এরপর ব্লেন্ডারে দিয়ে রস বের করে নিন। এতে কিছু পানি এবং লেবুর রস দিয়ে মিশ্রিত করে নিন। রসে পরিমাণ মতো চিনি ও লবণ দিয়ে নেড়ে নিন। এরপর একটি জগে ছেঁকে নিয়ে ঠাণ্ডা করার জন্য ফ্রিজে রেখে দিন। ইফতারের সময় বের করে গ্লাসে ঢেলে পরিবেশন করুন।

আখের শরবত: আখ টুকরো করে কেটে খোসা ছাড়িয়ে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে ছেঁকে নিলেই তৈরি সুস্বাদু আখের রস।

লেবু-চিনির শরবত: একেবারে বেসিক একটা শরবত যে কত উপাদেয় হতে পারে, তা বাড়িতে তৈরি লেমোনড না চাখলে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন না পুরোপুরি।

ছাতুর শরবত: গরমকালে আপনার আদর্শ ব্রেকফাস্টও হতে পারে। উপাদান সামান্য ছাতু, টক দই (বাদ দেওয়া যায়), সামান্য লেবুর রস, লবণ, চিনি (বাদ দেওয়া যায়) আর পানি। সবটা একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। উপরে একটু ভাজা মশলা ছড়িয়ে দিন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খাদ্য কথন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

11 − 4 =