শারীরিক যন্ত্রণাকারী ব্যাধি ও অসুস্থতায় ফিজিওথেরাপি

ময়ূরাক্ষী সেন

ফিজিওথেরাপি হলো এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে শারীরিক যন্ত্রণাকারী ব্যাধি ও বিভিন্ন অসুস্থতার চিকিৎসা করা হয়। এতে বিভিন্ন ফিজিক্যাল টেকনিক ব্যবহার করে করা হয়। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার লক্ষ্য হলো শরীরের বিভিন্ন অংশের যন্ত্রণা বা ব্যাথা ঔষধ ব্যবহার না করে কমানো, সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং পুনরুদ্ধার করা। এটি ক্ষয়ক্ষতি, ব্যাথা, অসুস্থতার পূর্ববর্তী চিকিৎসা ও প্রতিবন্ধী চিকিৎসা করতে পারে। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সাধারণত অসুস্থতার ধরন ও মাত্রা উভয়ের উপর নির্ভর করে করা হয়।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা একটি নিরাপদ ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি। অনেক সমস্যার জন্য ঔষধ ব্যবহার করা হয়, যা অনেক সময় দুর্বলতা এবং পার্শ্বপ্রভাব বাড়িয়ে দেয়। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা করলে এই সমস্যার সাথে সাথে নিরাপদ ও প্রাকৃতিক সমাধান পাওয়া সম্ভব হয়। এর মাধ্যমে শারীরিক ব্যাথা কমায় এবং স্বাভাবিক কাজ ফিরে আসতে সহায়তা করে। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা একটি প্রচীন চিকিৎসা পদ্ধতি, যা অসুস্থতার উপশম এবং ব্যাথা বা যন্ত্রণা কমাতে সাহায্য করে। এর সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ও দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করে। কিছু প্রধান কারণ:

যন্ত্রণা ও ব্যথা কমানো: ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা যন্ত্রণাকারী ব্যাধির জন্য উপযোগী। এসব পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে শরীরের যন্ত্রণা কমানো যায় এবং ব্যথা বা ব্যাধি কমানো হয়।

ম্যাসাজ করে কমানো: ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে স্থায়ী অথবা সামঞ্জস্যপূর্ণ অসুস্থতার পূর্ববর্তী চিকিৎসা করা যেতে পারে। যেমন ম্যাসাজ করা হয়। এটি শরীরের যন্ত্রণা ও অসুস্থতাকে কমাতে সাহায্য করে।

প্রতিবন্ধী চিকিৎসা: যখন কোনো শারীরিক সমস্যা আছে এবং ঔষধ ও অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি প্রতিবন্ধী হয় তখন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা একটি বিকল্প হতে পারে।

শারিরীক সুস্থতার অপরিহার্য শাখা হচ্ছে ফিজিওথেরাপি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি বড় অংশ রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসন। আর এই পুনর্বাসনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট। বর্তমানে সারা বিশ্বে এ বিষয়টি এতই সমাদৃত হয়েছে যে, মানুষ ব্যাথা হলে ফিজিওথেরাপিস্টের সাথে যোগাযোগ করে। পেশাগত উন্নতির জন্য অনেকের মধ্যে যে সংস্থাটি বেশি কাজ করে আসছে সেটি হলো – ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন ফর ফিজিক্যাল থেরাপি, সংক্ষেপে একে বলে ডাব্লিউসিপিটি। এদের মতে ফিজিওথেরাপি এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা রোগীর সার্বিক অবস্থার উন্নতি সাধন করে, যথাপোযুক্ত চলন ক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা আনে এবং সারাজীবন এই অবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষ যতদিন বাঁচে ততদিনই সুস্থ থাকতে চায়। কিন্তু দেহ আছে বলেই তো রোগের উৎপত্তি। রোগ হওয়ার পরেই তো মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে আর তাই তার দরকার হয় সুস্থতার। সুস্থতার সন্ধানে মানুষকে যখন যেখানে যেতে বলা হবে সে তখন সেখানেই যায়। ফিজিওথেরাপি যেহেতু একটি বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি তাই মানুষের রোগ নির্ণয়সহ অন্যান্য সুস্থতার পেছনে ফিজিওথেরাপিস্টগণ অনেক ভূমিকা রাখেন।

যান্ত্রিক জীবনে মানুষ যখন নিজেকে যন্ত্রের মতো ব্যস্ত রাখে, স্বভাবতই তার যান্ত্রিক জীবনে দুর্ঘটনা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ফলে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে হাড়, জোড়া, মাংসপেশী, নার্ভ টেনটন, লিগামেন্ট, বাত ব্যথা, প্যারালাইসিস সহ বিভিন্ন আঘাতজনিত সমস্যায়। এই সকল সমস্যা থেকে পুরোপুুরি নিজেকে সুস্থ্য করতে অবশ্যই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অপরিহার্য।

ফিজিওথেরাপি যেহেতু চিকিৎসা বিজ্ঞানের অঙ্গ তাই একজন ফিজিওথেরাপিস্টকে জানতে হয় স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের প্রায় অনেক বিষয়। এরা অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, প্যাথলজি, সাইকোলজি, ফার্মাকোলজি, কাইলোসিওলজি, অর্থোপেডিক্স, রিউমাটোলজি সন্মন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে একজন রোগীকে বন্ধুসুলভ আচরণ করে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলেন একজন ফিজিওথেরাপিস্ট। একজন ব্যাথার রোগীর কথাই ধরা যাক, তিনি ব্যাথার জন্য দিনের পর দিন কষ্ট করে আসছেন। কিছু রোগীর অভিযোগ থাকে ঔষধ খেলে ভালো থাকি আর ঔষধ বন্ধ করলে ব্যাথা আবার আগের মতো ফিরে আসে। তার মানে রোগীর মেকানিক্যাল সমস্যার কারণে ব্যাথা হচ্ছে। এমন রোগী ম্যানুয়াল ও ম্যানুপুলেশন থেরাপি নিয়ে অনেক তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশেই ফিজিওথেরাপিস্ট ফার্স্ট কন্টাক্ট প্র্যাকটিশনার হিসেবে কাজ করে আসছে। আমাদের দেশে প্যারালাইসিস রোগীর কথা একবার ভাবেন। স্ট্রোক করার পর তাকে চিকিৎসায় দেওয়া হয় ঔষধের মাধ্যমে যাতে করে তার মেডিক্যাল স্ট্যাবিলিটি ফিরে আসে। অর্থাৎ তার রক্তচাপ, পালস, শরীরের তাপমাত্রা ইত্যাদি সঠিক পরিমাপে আসলে রোগীর পরবর্তীতে একই সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু রোগীর এক পাশের প্যারালাইসিস অংশ নাড়াচাড়া করতে কষ্ট হয়। অথবা অনেকে পারেই না।

এমতাবস্থায় একজন ফিজিওথেরাপিস্ট বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আস্তে আস্তে হাত ও পায়ের শক্তি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করে থাকেন। তারপর দেওয়া হয় শরীরের ভারসাম্যের প্রশিক্ষণ ও হাঁটার শিক্ষা যা রোগীকে স্বনির্ভর করে। হাতের ক্ষেত্রেও যত্ন নেওয়া হয় ফাংশনাল কাজকর্মের। সবার জীবনে বার্ধক্য অবধারিত আর এ সময় মানুষ বিভিন্ন ব্যাথায় আক্রান্ত হয়। দেখা দেয় শারীরিক দুর্বলতা। এসব অসহায় মানুষের সুস্থ্যতার জন্য ফিজিওথেরাপি খুব গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত বিশ্বে এমন সুযোগ সুবিধা সবাই পায়। কারণ বৃদ্ধ বয়সে প্রায় প্রত্যেকেই পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। একজন মানুষ অসুস্থ হওয়ার পরে যদি ভালো চিকিৎসা নেয় তাহলে এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে।

একজন রোগীর পুরোপুরি চিকিৎসা সহ পুনর্বাসন করতে দরকার একটি মেডিক্যাল টিম, যে টিমে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত থাকবে সবাই। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে অনেক বড় বড় বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা ডিসিপ্লিনারি টিমে ফিজিওথেরাপিস্ট নাই। যার ফলে একজন রোগীর সঠিক চিকিৎসায় একটি বড় অংশ বাদ পড়ে যাচ্ছে। কারণ একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিমে থাকা একজন ফিজিওথেরাপিস্ট বিভিন্নভাবে অ্যাসেসমেন্ট করে রোগীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার উন্নতি করে, যা রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ হতে সহায়তা করে। তাই বলা যায় একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট তার দক্ষতা দিয়ে যে ফিজিওথেরাপি প্রদান করেন তা রোগীর জন্য একান্ত জরুরি।

৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বের প্রায় ১২১টি দেশে একযোগে ফিজিওথেরাপি দিবস পালন করা হয়। ১৯৫১ সালের ৮ সেপ্টেম্বরে ‘ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন ফর ফিজিক্যাল থেরাপি’ যাত্রা শুরু করে। ধীরে ধীরে তা আন্তর্জাতিক বিস্তৃতি লাভ করে এবং বিভিন্ন দেশে তাদের সদস্য হিসেবে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থার পাশে থেকে পেশার উন্নয়নে সক্রিয় হয়। ১৯৯৬ সালে ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন ফর ফিজিক্যাল থেরাপি ৮ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি পালন করে আসছে।

গত বছর ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন ফর ফিজিক্যাল থেরাপি তাদের নাম পরিবর্তন করে ‘ওয়ার্ল্ড ফিজিওথেরাপি’ নামকরণ করে। ওয়ার্ল্ড ফিজিওথেরাপি একটি বিশ্বব্যাপী সংস্থা এবং এটি আন্তর্জাতিক স্তরে সদস্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করে পেশার উন্নয়নে পরামর্শ দিয়ে থাকে। এ সংস্থার মূল লক্ষ্য হলো সবার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে সর্বাধিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, বৈজ্ঞানিক প্রমাণভিত্তিক ফিজিওথেরাপি অনুশীলন, প্রচার ও সমর্থন করা এবং ফিজিওথেরাপি শিক্ষার সর্বোচ্চ সম্ভাব্য মান বিকাশ ও বিতরণ করা।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নতুন কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি নয়। প্রাচীন গ্রিসে হিপোক্রেটিস ম্যাসাজ ও ম্যানুয়াল থেরাপির মাধ্যমে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার সূচনা করেছিলেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × 3 =