শাসক ও শোষকের অবস্থান: ক্ষমতার মঞ্চে কে কোথায় দাঁড়িয়ে

একটি রাষ্ট্রকে যদি মঞ্চ হিসেবে কল্পনা করা হয়, তবে সেই মঞ্চে আলো পড়ার কথা ছিল জনগণের মুখে। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় সেই আলো পড়ছে ক্ষমতার মুখোশে আচ্ছাদিত কিছু মানুষের ওপর। মঞ্চের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে তারা—যারা নিজেদের শাসক বলে পরিচয় দেয়, অথচ আচরণে, সিদ্ধান্তে এবং নীরবতায় শোষকের ভূমিকাই পালন করে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আজ সবচেয়ে বড় সংকট কোনো একক দুর্নীতি, কোনো নির্দিষ্ট প্রকল্প কিংবা কোনো বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত নয়। প্রকৃত সংকটটি হলো—শাসক ও শোষকের অবস্থান একাকার হয়ে যাওয়া। আর এই অবস্থানগত বিভ্রান্তিই ধীরে ধীরে রাষ্ট্রকে নাগরিকের হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটি সীমিত সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর কবলে।

শাসকের অবস্থান

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শাসকের অবস্থান হওয়ার কথা জনগণের কাতারে—মানুষের পাশে, মানুষের ভেতরে। শাসক মানে রাজা নন, মালিক নন; শাসক মানে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মী, যাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তের জন্য জবাবদিহি করতে হয়। সংবিধান তাঁকে ক্ষমতা দেয়নি—দায়িত্ব অর্পণ করেছে।

কিন্তু বাস্তবে শাসকের অবস্থান বদলে গেছে। তিনি আর মানুষের পাশে দাঁড়ান না; বরং দাঁড়ান ক্ষমতার চূড়ায়, নিরাপত্তার বলয়ে, প্রশাসনিক দেয়ালে ঘেরা এক ভিন্ন জগতে। মানুষের জীবনসংগ্রাম সেখানে পরিসংখ্যান মাত্র, আর মানুষের কষ্ট সেখানে “চ্যালেঞ্জ” হিসেবে চিহ্নিত হয়।

শোষকের উত্থান: নীরব, কিন্তু নিশ্চিত

শোষক হঠাৎ করে ক্ষমতার মঞ্চে উঠে আসেনি। সে এসেছে ধীরে ধীরে, সুপরিকল্পিত পথে। প্রথমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করা হয়েছে, এরপর জবাবদিহির কাঠামো শিথিল করা হয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত নীতিনির্ধারণ সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে কিছু নির্বাচিত মানুষের মধ্যে। সাধারণ নাগরিক টেরই পায়নি—কখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তার হাতছাড়া হয়ে গেছে।

আজ শোষক রাষ্ট্রকে দেখে একটি লাভজনক প্রকল্প হিসেবে। তার কাছে উন্নয়ন কোনো মানবিক প্রয়োজন নয়—এটি একটি ব্যবসায়িক পরিভাষা। বাজেট মানে সেবার পরিকল্পনা নয়—বরং সুযোগের তালিকা। আর আইন? আইন তার কাছে ন্যায়ের মানদণ্ড নয়; প্রয়োজনে তা ঢাল, প্রয়োজনে অস্ত্র।

ক্ষমতার মঞ্চে জনগণের অনুপস্থিতি

সবচেয়ে বেদনাদায়ক সত্যটি হলো—ক্ষমতার মঞ্চে জনগণের কোনো অবস্থান নেই; তারা কেবল দর্শক।

কৃষক মাঠে কাজ করে, কিন্তু কৃষিনীতি নির্ধারণে তার কণ্ঠ শোনা যায় না। শ্রমিক কারখানা সচল রাখে, কিন্তু শ্রমনীতিতে তার কোনো প্রতিফলন নেই। তরুণেরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি, অথচ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তারা সবচেয়ে কম প্রতিনিধিত্ব পায়।

রাষ্ট্র তাদের কাছ থেকে কর নেয়, ভোট নেয়, ধৈর্য দাবি করে—কিন্তু তাদের মতামত প্রায়ই রাষ্ট্রের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

আইন ও ন্যায়: দুই ভিন্ন পথ

আইন হওয়ার কথা ছিল দুর্বলের আশ্রয়। কিন্তু বাস্তবে আইন অনেক সময় শোষকের নিরাপত্তা বলয়ে পরিণত হয়েছে। দুর্বল পক্ষ প্রতিবাদ করলে আইন দ্রুত সক্রিয় হয়, অথচ ক্ষমতাবান লুট করলে আইন কাগজের ভেতর হারিয়ে যায়। তদন্ত হয়, কমিটি গঠিত হয়, প্রতিবেদন লেখা হয়—এরপর সবকিছু নীরবে থেমে যায়।

এই নীরবতা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি সচেতনভাবে লালিত সংস্কৃতি—যেখানে দায় এড়ানোই সবচেয়ে মূল্যবান দক্ষতা হিসেবে বিবেচিত হয়।

নীরবতার রাজনীতি

সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো—এই পুরো ব্যবস্থাটি নীরবতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই সবকিছু জানে, তবু বলে না। কারণ কথা বলা মানে ঝুঁকি, আর নীরব থাকা মানে সুবিধা। এই নীরবতাই শোষণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।

এখানে নীরব শাসক নিরপেক্ষ নন; তিনি শোষণের নিরাপত্তা প্রহরীর ভূমিকা পালন করেন।

ইতিহাসের সামনে শেষ প্রশ্ন

ইতিহাস এক অদ্ভুত বিচারক। সে ক্ষমতার ভাষণ শোনে না, উন্নয়নের পোস্টারও দেখে না। ইতিহাস কেবল একটিই বিষয় বিবেচনা করে—কে, কোন সময়ে, কার পাশে দাঁড়িয়েছিল।

আজ বাংলাদেশের ক্ষমতার মঞ্চে সেই প্রশ্নটিই ঝুলে আছে—

শাসক কি জনগণের পাশে দাঁড়াবেন,

নাকি শোষকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের কাঠগড়ায় যাবেন?

মাঝামাঝি কোনো অবস্থান নেই।

নীরবতাও একটি অবস্থান।

এই সত্য স্বীকার করার সাহসই নির্ধারণ করবে—এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কার হাতে থাকবে:

জনগণের হাতে, না শোষকদের হাতে।

লেখক, সংগ্রাহক ও গবেষক: হক মো. ইমদাদুল, জাপান

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × five =