মুসলিমা খাতুন: শিক্ষার গুরুত্ব এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব আজ দেশীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের অর্ন্তভূক্তি, অবস্থান এবং স্কুল ঝরে পড়া রোধে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুদের মানসিক উন্নয়ন ও আচরণগত পরিবর্তন এনে তাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা গ্রহণকে উৎসাহিত করে এবং শিক্ষার বৃহত্তর পরিমণ্ডলে প্রবেশের পথকে সহজ করে তুলে। গবেষণায় দেখা গেছে, দূর্গম ও অনগ্রসর সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে বেশ উৎসাহব্যঞ্জকভাবে এবং আনন্দের সাথে গ্রহণ করছে। প্রাক-প্রথমিক শিক্ষা একটি শিশুর মানসিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এ সকল বিষয় পর্যালোচনা, বিচার বিশ্লেষণ করেই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সরকারের প্রাক-শিক্ষার গুরুত্ব এবং ইতিবাচক ফলাফল শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতিমূলক ভিতকে সুদৃঢ় করে এবং এর মধ্য দিয়েই সার্বিক শিক্ষা গ্রহণের পথকে অনেকটাই নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। নি:সন্দেহে এ উদ্যোগ সময়পোযোগী ও বাস্তবসম্মত।
প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শিক্ষায় অংশীদারীত্বমূলক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়া হয়েছে। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী প্রায় ৯০ শতাংশ শিশুরা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে, যদিও সরকার ৫-৬ বছরের সকল শিশুর জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নতমানের শিক্ষা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যদিও শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষার বিষয়টি সরকারের কাছে একটি চ্যালেঞ্জ।
বর্তমানে ৫ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রস্তুতিমূলক এক বছর মেয়াদী শিক্ষা কার্যক্রম প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বিপুল সংখ্যাক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
বাংলাদেশ প্রচলিত প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার মান এবং সেবার ক্ষেত্রটিতে ক্ষেত্র ভেদে পার্থক্য আছে। অনেক স্কুলের কাঠামোগত মান উন্নত নয়, সুযোগ সুবিধার অপর্যাপ্ত। পর্যাপ্ত শিক্ষক, শিক্ষা ও খেলার সামগ্রি, বই, শ্রেণিকক্ষ, পরিস্কার পচ্ছিন্নতা ও নিরাপদ পানির সংস্থান এবং ওয়াসরুম/টয়লেটের সুযোগ সুবিধা অপর্যাপ্ত। এ সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা ও সেবা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর এবং ইতিমধ্যেই অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। একটি শিশুবান্ধব শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সার্বজনীন এবং বৈষম্যহীন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সে বিবেচনায় বস্তি এবং পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, বিভিন্ন ভাষাভাষী নৃগোষ্ঠীর শিশু, অবহেলিত বা বঞ্চিত শিশুদের সামগ্রিকভাবে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় এনে সব শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক শিক্ষা নিশ্চিত করাই সরকারের লক্ষ্য। তথাপি গুনগত মানসম্পন্ন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সকলের সমন্বিতভাবে কতগুলি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
চলমান প্রাক-প্রাথমিক স্কুলগুলোকে শিশুবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং নতুন নতুন প্রাক-প্রাথমিক স্কুল স্থাপন করতে হবে; গুণগত মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দক্ষতার সাথে সার্বিক তত্ত্বাবধান, পরিবীক্ষণ এবং মুল্যায়নসহ; মানসম্পন্ন সেবা প্রদানের সুবিধার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। সফলতার সাথে জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুসরণ করতে হবে এবং মাঠ পর্যায়ে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি শিশু এবং অভিভাবকদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির জন্য যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং তা আরো সম্প্রসারিত করতে হবে। সর্বোপরি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক, শিক্ষার উপকরণ সামগ্রী এবং শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ সুবিধা সরবরাহ বাড়াতে হবে।
আমরা জানি শিশুরা জন্ম থেকেই প্রকৃতি এবং পারিবারিক অবস্থা থেকে অনেক কিছুই শিখে থাকে। প্রাকৃতিক ও ব্যবহারিক জীবন থেকে শিশুরা যা শিখে থাকে, তাই তাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তোলে এবং তাদের ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে। শিশু বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তাদের অনুসদ্ধিৎসু মন চার পাশের জীবন ও চলমান বিষয়ে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তাই শিশুর বাসস্থান, বিদ্যালয় এবং পরিবেশ নিয়ে যে জগতে শিশুর অবস্থান, সেখানে যত বেশি শিশুবান্ধব সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করা যাবে, ততই তারা বেশি বিকশিত হবে এবং শিশুর সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। এক্ষেত্রে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম পরিপ্রেক্ষিতে প্রাক-প্রাথমিকসহ সার্বিক অর্থে শিক্ষা প্রসারে জনসচেতনতার বিষয়টি জরুরি। কাজেই এ সংশ্লিষ্ট জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমসহ সমাজের গণ্যমাণ্যদের কাজ করতে হবে।
গণমাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সুফল তুলে ধরে ব্যাপক প্রচার চালানো এজন্য জরুরি। একই সাথে শিশু শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদেরই পালন করতে হবে। যেসব শিশুরা এখনও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উপকারিতা এবং ভব্যিষ্যৎ সুফল সম্পর্কে অবহিত নয়, তাদের কাছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব এবং সরকার প্রদত্ত সেবার বার্তাটি পৌঁছে দিতে হবে। শিশু শিক্ষার আলো প্রতিটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের মানসোন্নয়নের কর্তব্য পালনে আমাদের সকলের দায়িত্ব নিতে হবে, ভবিষ্যত আদর্শ জাতি গঠনে যার বিকল্প নেই।
লেখক: ফ্রিল্যান্স রাইটার