শিল্পীকেও সসম্মানে বাঁচতে হবে: কনা

ছোটবেলায় স্থির করেছিলেন বড় হয়ে ‘রুনা লায়লা’র মতো শিল্পী হবেন। সেই স্বপ্ন পূরণের পথে তিনি। বলছি এই সময়ের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কনার কথা। তার ভালো নাম দিলশাদ নাহার কনা। মা-বাবা তাকে ডাকেন ‘কনু’ বলে আর বাড়ির ছোটরা ডাকে ‘কনামনা’। সবকিছু ছাপিয়ে এখন নিজের পরিচয়েই পরিচিত তিনি। এদেশের সংগীতাঙ্গনে কনা একটি ভালোবাসার নাম।

মাত্র চার বছর বয়স থেকেই গানের সঙ্গে সখ্যতা। এখনও চলছে তার গানের চর্চা। ‘জ্যামেতিক ভালোবাসা’, ‘কনা’, ‘সিম্পলি কনা’ এই অ্যালবামগুলো প্রকাশ করে নিজেকে চিনিয়েছেন অনেক আগেই। যারা শুনেছেন তাদের কানে এখনো লেগে আছে তার ‘ধিমতানা’ গানের সুর। ১৫ এপ্রিল কনার জন্মদিন। রঙ বেরঙ তাকে জানাচ্ছে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। ইউটিউবে ‘রেশমি চুড়ি’, ‘দিল দিল দিল’র মতো গান কোটি ভিউ হয়েছে।

কনার কনা হয়ে ওঠার গল্প অনুপ্রেরণা তরুণ শিল্পীদের জন্য। কনার কনা হয়ে ওঠা, বর্তমান সংগীত ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা ও নানা বিষয় নিয়ে এই শিল্পী কথা বলেছেন মৌ সন্ধ্যার সঙ্গে।

নিজেকে শিল্পী হিসেবে প্রতিনিয়তই এগিয়ে নেওয়ার মূলমন্ত্রটা কী?

একজন শিল্পীর কাজ গান গাওয়া। গান নিয়ে ভাবা। গানের ভেতর ডুবে থাকা। আসলে নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার বিশেষ কোনো মূলমন্ত্র নেই। আমি শুধুই গান গেয়ে চলেছি। কোনো ছকবেঁধে কাজ করিনি। সবসময় আমার কাজের ব্যাপারে যত্নশীল ছিলাম। ধীরে ধীরে গানগুলো মানুষ পছন্দ করতে শুরু করেছে। এটাই প্রাপ্তি বা আরও ভালো গানের অনুপ্রেরণা বলতে পারেন।

খুব ছোট বেলা থেকেই আপনি গান করেন। শিল্পী হওয়ার ইচ্ছে কীভাবে তৈরি হয়েছিল?

আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই গানের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায়। কেমন করে সংগীত প্রেম তৈরি হলো ঠিক মনে নেই। ছোটবেলায় তো অতো বুঝতাম না। প্রথমে আব্বু-আম্মু গান শিখতে বলেছে তাই শিখেছি। গানের প্রতি ঝোঁকটা তৈরি হয়েছে দিনে দিনে। গানের স্কুলে যেতাম, গান গাইতাম। সবাই বলতো এই মেয়েটা ভালো গান করে। নিজের ভেতরে আত্মবিশ্বাস তৈরি হতে শুরু করে। তখন থেকেই ইচ্ছেরা পাখা মেলে যে বড় হয়ে শিল্পী হতে হবে।

অনুপ্রাণিত হয়েছেন কার গানে?

অনেকেই আছেন। রুনা ম্যাম তো (রুনা লায়লা) সবসময়ই আমার ‘স্পেশাল ইন্সপায়ারেশন’। উনার গানই আব্বু আম্মু বেশি বেশি করে শুনাতো। আব্বু আম্মুর প্রিয় শিল্পী ছিলেন তিনি। মনের অজান্তেই উনার প্রতি টান তৈরি হয়ে গেছে। নতুন শিল্পীদের গানও আমার ভালো লাগে।

আপনার গানের ওস্তাদ ছিলেন কে?

আমি প্রথম গান শিখেছি সিনথিয়া রহমানের কাছে। এরপর শিখেছি নজরুল একাডেমিতে ও মঈদুল ইসলামের কাছে। আব্বু-আম্মুর অনুপ্রেরণা আমাকে এগিয়ে নিয়েছে অনেক দূর। তারা যদি গান পছন্দ না করতেন, আমাকে গানের স্কুলে ভর্তি না করতেন এবং ওস্তাদের কাছে গান শেখার সুযোগ করে না দিতেন তাহলে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখা হতো না হয় তো।

অনেক দিন থেকেই গান গাইছেন। নিজের জন্য গান নির্বাচন করেন কীভাবে?

আমি গান নির্বাচন করার সুযোগই পাইনি কখনো। কারণ এতো ছোটবেলা থেকে কাজ শুরু করেছি যে কখনো ক্লাসিক্যাল, কখনো রক, কখনো আধুনিক, কখনো ফোক, যখন যেই ধরনের গান গাওয়ার সুযোগ এসেছে গেয়েছি। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে করতে আমি কোন ধরনের গানের শিল্পী এটা আলাদাভাবে আর ভেবে দেখা হয়নি। সব ধরনের গান গাইতে গাইতে সব গানের জন্যই কণ্ঠটা তৈরি হয়ে গেছে বলে মনে করি আমি।

অনেক গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পারিচালকে সঙ্গে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে আপনার প্রিয় কারা…

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অনেক কঠিন। আর এই নামের তালিকা প্রকাশ করাও ঠিক হবে না। সবকিছু বলতে হয় না। এটাও বলা ঠিক হবে না। কারণ প্রিয় তো অনেকেই আছেন। যাদের গান পছন্দ করি সবসময়। নামের তালিকাটাও বেশ দীর্ঘ হবে। বলতে গেলে কারও নাম হয় তো বাদ পড়ে যাবে। তবে আমি সবসময় অনুধাবন করি গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক; সন্তানের মতো করে তৈরি করেন একটি গান। তারা আমাকে সুযোগ করে দেন বলেই আমি গানের অংশ হতে পারি।

অডিও, সিনেমা নাকি জিঙ্গেল কোনটায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

আমি কখনই আলাদা করে দেখি না। আমার কাছে সব এক। কারণ মূল কাজ তো কণ্ঠেরই। সব জায়গাতে গানই গাইতে হয়। আমার সবই ভালো লাগে। প্রচুর ভয়েস ওভারও দেই আমি। অনেক বিজ্ঞাপনের ভয়েস ওভারও দিয়েছি। কাজটিই আসল সেটা অডিও হোক সিনেমায় হোক কিংবা বিজ্ঞাপনেই হোক।

বর্তমানে সংগীত ইন্ডাস্ট্রি কেমন সময় পার করছে?

যখন আমার ‘সিম্পলি কনা’ অ্যালবাম বের হয় তখন ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা খুব খারাপ ছিল। এখন সেই তুলনায় অনেক ভালো। তখন অডিও গান প্রকাশ করে তেমন লাভ ছিল না। এখন তো ভিডিওর সময় অনেক ভালো যাচ্ছে। কোম্পানিগুলো অনেক গান গাওয়াচ্ছেন। তারা উপার্জন করতে পারছে বলেই ইনভেস্ট করছে। নতুনদের জন্যও অনেক ভালো হয়েছে।

এখন যারা কাজ করছেন সবাই কি তাদের সঠিক প্রাপ্য পাচ্ছেন?

এ বিষয়টি নিয়ে আমি সঠিক বলতে পারব না। সত্যি কথা বলতে নিজের গান নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকি। এ বিষয়ে কয়েকদিন আগেও আমাকে একজন জিজ্ঞেস করেছে। আসলে দেখা যাচ্ছে আমার সঙ্গে একরকম চুক্তি হচ্ছে। আমি ভাবছি অন্যদের সঙ্গেও তারা এভাবেই চুক্তি করছে। আমার প্রাপ্য ঠিক মতোই পাচ্ছি আমি। ইন্ডাস্ট্রি তো অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। কোম্পানিগুলো আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তাদেরকে গুছিয়ে নেওয়ারও সময় দিতে হবে আরও কিছু দিন। আমি আশাবাদী আরও গুছানো হবে সবকিছু। যেমন দেখেন আগে আমরা অডিওর জন্য গান তৈরি করতাম। পরে সেই গান নাটকে ব্যবহার করা হতো কোনো অনুমতি ছাড়াই। এখন আলাদাভাবে নাটকের জন্যই গান তৈরি করা হচ্ছে।

সংগীত ইন্ডাস্ট্রিকে আরও এগিয়ে নিতে কী করা প্রয়োজন?

রয়্যালিটি সিস্টেম বা পেমেন্টের ব্যাপারগুলো কার কতো ভাগ এই ব্যাপারগুলো পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন। শিল্পীর কাজ তো শুধুই গান গাওয়া। কিন্তু সারা জীবন গান গেয়ে শেষ জীবনে যদি শিল্পী না খেয়ে মারা যায় তাহলে তো হলো না! কোম্পানিকেও লাভ করতে হবে, শিল্পীকেও সসম্মানে বাঁচতে হবে। কোম্পানি, টেলকো ও কর্পোরেট যে প্রতিষ্ঠানগুলো সংগীত বিপণনের সঙ্গে আছেন তারা সৎ হলে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাব আমরা।

পাশের দেশে কিশোর কুমারের গানের জন্য তাদের সন্তানেরা এখনো রয়্যালিটি পান…

তাদের কথা আর কি বলবেন। তারা তো রেডিওতে যে গান বাজে সেটারও রয়্যালিটি পান। আমরা যদি শুধু রেডিও থেকেই রয়্যালিটি পেতাম ভাবেন কতো টাকা আসতো। এক সময় হয় তো আমরাও পাবো। এগুলো ঠিক হতে হয়তো আরও সময় লাগবে। তখন আমাদের শিল্পীরা আর দুঃস্থ হবে না। অসুস্থ হলে তাদের তখন আর কারো কাছে হাত পাততে হবে না। কারণ সঠিক রয়্যালটি পেলে এদেশে কোনো শিল্পীই দুঃস্থ থাকবে না।

ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

এখন আমি যে কনা এমনটাই হতে চেয়েছিলাম। এর থেকে আরও বেশি কিছু হলে খুশি হবো। বর্তমানে এখনকার আমার আমিকে নিয়ে আমি খুশি আছি। আমি বরাবরই পরিশ্রম করেছি এখনও পরিশ্রম করি অনেক। ভবিষ্যতে কী আছে সেটা সময়ের হাতেই থাক।

শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চান?

আমি শ্রোতাদের শুধুই ধন্যবাদ দিতে চাই। তারা যেভাবে আমার সঙ্গে আছেন সেইভাবেই যেন সব সময় থাকেন। আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন এই ভালোবাসাটা ধরে রেখে ভালো গান করে যেতে পারি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eighteen − seventeen =