শিল্পের নির্মাণ ও সমীকরণ

আজকাল ভাবনাপ্রসূত শিল্পকলা নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে অনেকের ভেতরেই। শিল্পের ধামাধরা কাব্য নিয়ে বেশ পঠনপাঠন হয় বা হচ্ছে কিন্তু শিল্পটা যে একটা বিজ্ঞান, একটা জ্ঞানলব্ধ কৌশল এটা অনেকেই ভাবেন না বা ভাববার চেষ্টাও করেন না। শিল্প হচ্ছে অনেক বেশি সাহিত্য, কিন্ত আবার অনেক বেশি কৌশলগত জ্ঞানও। সাহিত্যের যে শাখা-প্রশাখাতেই সৃষ্টি কৌশল নিয়ে কেউ মেতে উঠুক না কেন তাকে অবশ্যই রূপের অবকাঠামোগত দিক সম্পর্কে জ্ঞান লাভ এবং তার প্রকাশের ধরন সম্পর্কে কৌশলগত দিক বুঝে নিতে হবে। আর তাই তো শিল্পের গুণ এবং গুণের কাঠামোবদ্ধ রীতি নিয়ে আলোচনা অনেক বেশি জরুরি।
শিল্পের তিনটি গুণ থাকে। বিষয়, শৈলী এবং আঙ্গিক। এই তিনটি গুণের মধ্যে দিয়েই শিল্পের প্রকাশ। বিষয়ভিত্তিক চিন্তার উৎকর্ষ সাধনের লক্ষেই শিল্পের গড়ন নির্মাণ এবং অবয়বধর্মী আবহ সৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে নির্মাণ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে একটা রীতি কৌশল সৃষ্টি হয় যাকে আমরা বলে থাকি স্টাইল বা শৈলী। স্টাইল কথাটার অর্থই হচ্ছে শৈলী। একটি ছবির স্টাইল কিন্তু হঠাৎ করে তৈরি হয় না। এই স্টাইল বা শৈলী কোথা থেকে তৈরি হয়। যদি সাহিত্যের বা কবিতা বা গল্পের ক্ষেত্রে আমরা লেখনীশৈলী নিয়ে আলোচনা করি তবে একটি বিষয় প্রতীয়মান হবে যে লেখার স্টাইলটা কিন্তু লেখকের একান্ত নিজস্ব যা তার চিন্তাধারা থেকে সরাসরি উৎসারিত হয়ে থাকে। লেখকের চিন্তার ধরনটাই কিন্তু তার লেখার স্টাইল তৈরি করে দেয়। যেমন একজন লেখকের চিন্তার গড়ন অনুযায়ী তার গদ্য গাথুঁনী তৈরি হয়। কখনো সহজীয়া আবার কখনো খুবই কঠিন একটা ব্যাপার থেকে থাকে। এক্ষেত্রে বিষয় ভিত্তিক ভাব লেখনিকে প্রাণরূপ দান করে থাকে যার মধ্য দিয়ে লেখক নিজে তার ধরনটা সেই ভাব অনুযায়ী নির্ধারণ করে থাকেন। লেখার সরলীকরণ স্টাইল বা শৈলী বিষয়কে অনেক বেশি যোগাযোগ সমৃদ্ধ করে তোলে।
আবার একজন কুমারের ক্ষেত্রেও কিন্তু বিষয়টা একই রকম। তিনি একটি জগ বা মগ বা হাঁড়ি অথবা কলসি যাই তৈরি করুক না কেন পূর্বেই এই সিদ্ধান্তটি তিনি গ্রহণ করেন। তারপর হুইলটি ঘুরানো শুরু করেন এবং ঘূর্ণায়মান মাটির চাকাকে অঙ্গুলি টিপ্পনের কম বেশি চাপের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রকম গড়ন তৈরি করে থাকেন। চাপ বেশি দিবে না কম দিবে এটা কিন্তু একজন কুমার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কিন্তু তার নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়, এবং এটাই তার স্টাইল বা রীতি। অর্থাৎ নির্মাণ শৈলীটা হচ্ছে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার দৃশ্যরূপের একটা আলেখ্য মাত্র; যেখান থেকে সৃষ্টির রস নিঃসরিত হয় বা উৎকলিত হয়। এই শেলীর মধ্যে সৃষ্টির গুণাগুণ থাকে অক্ষুন্ন এবং শৈলীর মধ্যেই প্রকাশিতব্য হয়ে উঠে সৃষ্টির নিজস্বতা এবং সৃষ্টিকারীর স্বকীয় সত্তা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 + 15 =