শিশুর সুস্থতায় মায়ের দুধ

ময়ূরাক্ষী সেন

পৃথিবীতে আসার সাথে সাথে শিশু মায়ের বুকে আশ্রয় নেয়। বলা হয়, মায়ের বুক শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। শিশুকে সুস্থভাবে বড় হতে সাহায্য করে মায়ের বুকের দুধ। মায়ের দুধ একটি শিশুর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এখন আর অজানা নয়। পৃথিবীজুড়ে ১ থেকে ৭ আগস্ট পালন করা হয় ‘মাতৃদুগ্ধ  দিবস’। ১৯৯০ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স ইনোসেনটি গবেষণা কেন্দ্র থেকে ১ আগস্ট এই দিবসটি ঘোষণা আসে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, শিশুকে মায়ের দুধ পালন করতে উৎসাহিত করা।

রোগ প্রতিরোধের জন্য শিশুকে অনেক রকমের টিকা প্রদান করা হয়। কিন্তু বলা হয়, একটি শিশুর প্রথম টিকা তার মায়ের দুধ। গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর চার মিলিয়ন নবজাতকের মৃত্যু ঘটে। তার মধ্যে অধিকাংশের মৃত্যু হয় জন্মের ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে। এদের মধ্যে ৩১ শতাংশ শিশুকে যদি জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ পান করানো যেত তাহলে তাদের মৃত্যু ঘটতো না। গবেষণায় দেখা গেছে, ১০০ মিলিলিটার মায়ের দুধে থাকে জলীয় অংশ থাকে ৮৯ দশমিক ৯৭ গ্রাম, খাদ্যশক্তি  ৭০ কিলোক্যালরি, ৭ দশমিক ৪ গ্রাম শর্করা, ৪ দশমিক ২ গ্রাম চর্বি ও ১ দশমিক ৩ গ্রাম আমিষ।

মায়ের দুধের উপকারিতা

শিশু জন্মের পর মায়ের বুকে প্রথম যে দুধ আসে তাকে বলা হয় শাল দুধ। এই দুধ হলুদ ও আঠালো হয়ে থাকে। সাধারণত প্রসবের ২/৩ দিন শাল দুধ বের হয়, তাই শিশুকে জন্মের এই ২/৩ দিন শুধু মায়ের শাল দুধ খাওয়াতে হবে। শাল দুধে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ থাকে। ভিটামিন এ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে, ভিটামিন এ চোখের জন্য খুব উপকারী। শিশুর শরীর বিকাশে ভিটামিন এ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শিশু যদি ভিটামিন এ না পায় তাহলে তার রাতকানার মতো অনেক ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে। দেখা যায়, যেসব বাচ্চারা সঠিকভাবে মায়ের বুকের দুধ পায় না তারা রিকেট রোগে আক্রান্ত হয়। মায়ের দুধের অভাবে তাদের হাড়ের গঠন সঠিকভাবে হয় না, ফলে হাড়ে ব্যথা হয় ও হাড় নরম হয়ে যায়। পরবর্তীতে হাড়ে বিকৃতি দেখা যায়। জন্মের পর শিশুরা অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াজনিত কিছু রোগে আক্রান্ত হয়। তবে পর্যাপ্ত মায়ের দুধ পেলে শিশুকে ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব। নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে শিশুর মৃত্যু সংখ্যা কম নয়। ভাইরাস, ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে নিউমোনিয়া ছড়ায়। তবে মায়ের দুধ পান করার ফলে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

জন্মের পর শিশুদের কান পাকা রোগ হয়। কান পাকা বা কানের ইনফেকশন থেকে রেহাই পেতে শিশুকে নিয়মিত মায়ের দুধ পান করাতে হবে। এছাড়া শিশুদের ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে প্রচুর লবণ ও পানি বের হয়ে যায়। ডায়রিয়া সহ সকল পাকস্থলির রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে মায়ের বুকের দুধ। মায়ের দুধের ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয় না। মায়ের দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণের ভিটামিন সি। ভিটামিন সি’র অভাবে স্কার্ভি রোগ হয়ে থাকে। স্কার্ভি রোগের লক্ষণ হিসেবে মাড়ি ফুলে যায় ও রক্তক্ষরণ হয়। এছাড়া নিয়মিত বুকের দুধ পেলে শিশুদের ঠান্ডাজনিত রোগ দূর হয়। একজন শিশু থেকে আরেকজন শিশুর বুদ্ধিমত্তার অনেক তফাত থাকে। এর পেছনেও মায়ের দুধের ভূমিকা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ের দুধ শিশুর মস্তিষ্ক গঠনে সহায়তা করে। সেসব শিশুরা মায়ের পর্যাপ্ত পরিমাণের মায়ের দুধ পান করে তারা মেধাবী হয় ও বুদ্ধিতে অনেক বাচ্চাদের থেকে এগিয়ে থাকে।

বুকের দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা

মায়ের দুধ পান করে শুধু যে শিশু উপকৃত হয় এমন না। শিশুকে দুধ পান করিয়ে একজন মা-ও সুস্থ থাকে। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর মায়ের জরায়ু বড় হয়ে যায়। কারণ এই জরায়ুতেই বাচ্চা থাকে। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার কিছুদিন পর থেকে জরায়ু ছোট হতে থাকে। শিশুকে দুধ পান করালে জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যায়। সারাবিশ্বে অনেক নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যার সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে। বাচ্চাকে নিয়মিত বুকের দুধ পান করালে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। স্তন ক্যানসারের পাশাপাশি জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকিও কমে আসে। জানা গেছে, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া অনেক রোগী কখনো বাচ্চাকে দুধ পান করাননি। সন্তান জন্মদানের পর অনেক মায়ের ওজন বেড়ে যায়। তবে নিয়মিত বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করালে ওজন দ্রুত কমে আসে। বাচ্চা জন্মদানের পর অনেক মায়ের বিষণ্নতার মতো মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করালে হরমোন ব্যালেন্স হয়ে আসে; ফলে বিষণ্নতা কিছুটা কেটে গিয়ে মন ভালো থাকে। তবে সন্তান জন্মদানের পর অনেকের ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ শরণাপন্ন হতে হবে।

মায়ের পুষ্টি

সন্তান প্রসবের পর মায়েদের ওজন বেড়ে যায়। ফলে অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে কিছুদিন পরেই ডায়েট করা শুরু করে। যা একদম অনুচিত। সন্তান জন্মের ৬ মাস পর্যন্ত একজন মায়ের পর্যাপ্ত পুষ্টির প্রয়োজন। কারণ মায়ের পুষ্টি থেকেই সন্তান পুষ্টি পাবে। মায়ের খাবারে প্রোটিন, শর্করা ও ফ্যাট এই তিনটি উপাদানের উপস্থিতি থাকতে হবে। প্রতিদিন দুটি ডিম ও এক গ্লাস দুধ পান করতে হবে। সরাসরি দুধ খেতে না চাইলে দুধ জাতীয় খাবার যেমন পায়েস, পুডিং,  সেমাই ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। প্রোটিনের উৎস হিসেবে ডিমের পাশাপাশি মাছ, মাংস ও ডাল জাতীয় খাবার খেতে হবে। এছাড়া সবুজ পাতার শাকসবজি, কাঁচা পেপে, গাজর, মিষ্টি আলু, নানা ধরনের বাদাম ইত্যাদি খেতে হবে।

অনেক সময় বুকে দুধ কম আসলে মাকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ক্যালরির খাবার খেতে বলা হয়। এটি সঠিক নয়। চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার খেলেই শিশু পর্যাপ্ত দুধ পাবে। তবে প্রসেসড ফুড ও বাইরের অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। অনেক সময় মা বিষণ্নতায় ভুগলে কিংবা অতিরিক্ত চিন্তা করলে বুকে দুধ আসে না। তাই মাকে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করতে হবে। মন ভালো রাখার জন্য অবসরে প্রিয় কাজ করা যেতে পারে। যেমন গান শোনা, গাছের সাথে সময় কাটানো, বই পড়া, গল্প করা, মাঝে মাঝে হাঁটতে যাওয়া ইত্যাদি। মায়ের এই সময়টা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে তার পরিবারের সদস্যরা।

কুসংস্কার

জন্মের পর অনেক শিশুকে গ্লুকোজ কিংবা মধু খাওয়ানো হয়। যা একেবারে অনুচিত। মধু খাওয়ানোর ফলে শিশুর ডায়রিয়া হতে পারে। অনেকেই মনে করে মায়ের প্রথম শাল দুধ ক্ষতিকারক। আসলে এটি ভুল ধারণা, মায়ের শাল দুধ শিশুর জন্য সবচেয়ে উপকারী। অনেকের ধারণা রয়েছে অসুস্থ মা বুকের দুধ খাওয়াতে পারবে না, যেকোনো পরিস্থিতেই মা তার সন্তানকে দুধ খাওয়াতে পারবে। অনেকে বাচ্চা যাতে দ্রুত বুকের দুধ ছেড়ে দেয় সে অভ্যাস গড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু জোর করে এই অভ্যাস করার দরকার নাই। শিশুর তার সময় মতো নিজ ইচ্ছাতেই বুকের দুধ ছেড়ে অন্য খাবার খাওয়া শুরু করবে। অনেকেই মনে করেন, মা যদি ঝাল বেশি খাবার খায় তাহলে শিশুর সমস্যা হবে। তবে এমন কোনো কথার যুক্তি নেই। মা তার পছন্দ মতো যেকোনো খাবার খেতে পারবে। তার প্রভাব বুকের দুধের উপর পড়বে না।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three + eleven =