শীতের দুপুরে পরিচালক নোমানের বিদায়

রোজ অ্যাডেনিয়াম

এখন পাতার ঝরার মৌসুম, শীতকাল। হিমেল বাতাসে ঝরে পড়ছে গাছের শুকনো পাতা। এমনই এক শীতের দুপুরে প্রিয় মানুষদের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন নাট্যনির্মাতা মোহাম্মদ নোমান। ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সহযোগী সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ নোমান। জানা গেছে, দীর্ঘদিন মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন নোমান। পরিবার, নিকটাত্মীয় ও বিভিন্ন সংগঠনের সহযোগিতায় চলছিল নোমানের ব্যয়বহুল চিকিৎসা। সম্প্রতি নোমানকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সহায়তা চেয়েছিল নির্মাতার পরিবার। অবশেষে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে থেমে গেল নির্মাতার জীবন প্রদীপ।

নিজে কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি মোহাম্মদ নোমান। তবে নিবিড়ভাবে চলচ্চিত্রের সঙ্গে ছিলেন অনেকদিন ধরেই। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক ওয়াকিল আহমেদের সঙ্গে প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন অনেক বছর। খ্যাতিমান নাট্যপরিচালক ফেরদৌস হাসানের সঙ্গেও কাজ করেছেন অনেকদিন। ফেরদৌস আহমেদ নোমানকে নিয়ে লিখেছেন, “আমি তখন বিডিআর-এ। পিলখানায়। চলচ্চিত্র পরিচালক ওয়াকিল আহমেদ ফোন করে বললেন, আমি কি একজনকে পাঠাব? নাম নোমান। সে নোয়াখালী থাকে। আগেও একবার আপনার সাথে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু আপনি আর্মি শুনে ভয়ে যায়নি। তারপর আবার একটা নাটক দেখে না থাকতে পেরে এসে বলছে আপনি আর্মি হন আর যাই হন, গুলি করলে করবেন কিন্তু সে দেখা না করে যাবে না! আমি তাকে অভয় দিলাম গুলি করবো না, পাঠান। সে আসে। বলে, সে মোহাম্মদ নোমান। সে ওয়াকিল আহমেদের চিফ অ্যাসিটেন্ট। আমি যদ্দুর জানি সিনেমার চিফ অ্যাসিটেন্ট মানে বিশাল ব্যাপার। সিনেমার এ টু জেড সে-ই করে। তবে নাম হয় পরিচালকের। ওয়াকিল আহমেদ যখন শিবলি সাদিকের চিফ অ্যাসিস্টেন্ট ছিলেন তখন তাকে চব্বিশ ঘণ্টা এফডিসিতে পড়ে থাকতে দেখেছি। তার খাওয়া দাওয়া ঘুম হারাম। তাই নোমানের পরিচয় পেয়ে ভাবি ওয়াকিলের যে সিনেমাটি আমার লিখার কথা ওয়াকিল হয়তো চান আমি নোমানকে নিয়ে বসি। ওয়াকিল হয়তো অন্য কাজে ব্যস্ত। আমি বলি চিফ অ্যাসিস্টেন্ট সাহেব আমি রাত বারোটায় লিখতে বসবো, আসতে পারবে? রাত বারোটা টু ভোর পাঁচটা। সে বুঝতে পারে না আমি কেন এটা বলছি।

-তুমি ওয়াকিলের স্ক্রিপ্টের জন্য আসোনি?

-না স্যার আপনাকে দেখতে এসেছি।

-আমার নাটক দেখে নোয়াখালি থেকে কী তুমিই এসেছো?

-জি স্যার জি।

-তাহলে তুমি চিফ অ্যাসিস্টেন্ট হলে কিভাবে?

-আপনাকে বারবার দেখতে এসে ঢাকায় থাকতে থাকতে। স্যার আপনি ফেরার মতো একটা সিরিজ লেখেন না আমাকে অ্যাসিস্টেন্ট নিয়ে!

-নাটকে চিফ অ্যাসিটেন্ট লাগে না।

-আপনি যে কাজ দেবেন সেটাই করবো, টি-বয়ের কাজ করতেও আপত্তি নেই।

আমি ওর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য বলি তোমার ফোন নম্বর বলো। দরকার হলে আমি যোগাযোগ করবো।

-স্যার আমার ফোন নেই।

-তাহলে চিফ অ্যাসিস্টেন্টগিরি করো কিভাবে?

-তখন প্রোডাকশন থেকে আমাকে একটা ফোন ব্যবহার করতে দেয়।

-আমি তোমাকে কোনো ফোন কিনে দিতে পারবো না। আমার সাথে কাজ করতে চাইলে তোমার ফোন থাকতে হবে।

-জি স্যার বুঝতে পেরেছি।

তাহলে এখন এসো।

স্যার আমি আপনাকে একটা ফুল দিতে চাই।

এনেছ?

জি না স্যার

তাহলে কিভাবে দেবে?

ঐ যে স্যার ফ্লাওয়ার ভাসে…

হা হা হা

সে অপ্রস্তত। মাথা নিচু করে বলে, স্যার এখন ওয়াকিল ভাইয়ের প্রোডাকশন বন্ধ বলে আমার কাছে কোনো টাকা নেই। তাই কিনে আনতে পারিনি। আমার কাছে স্যার কানা পয়সাও নেই, হে হে হে! নোমান ওঠে। সালাম করে। চলে যায়।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের আইসিইউতে জীবনের শেষ দিনগুলোতে চিকিৎসাধীন ছিলেন নোমান। ডিরেক্টরস গিল্ড বাংলাদেশ এর সদস্য ছিলেন নাট্যনির্মাতা নোমান। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সহযোগী সদস্যও ছিলেন। মৃত্যুর পর তার আত্মার শান্তি কামনা ও পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেছে ডিরেক্টরস গিল্ড ও চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি।

ফেসবুকে লিখতেন মোহাম্মদ নোমান। তার লেখার একটা বিশাল অংশ জুড়ে থাকতো প্রেম। ফেসবুকে নিজেকে নিয়ে ‘কে আমি’ শিরোনামে একটা লেখা লিখেছিলেন নোমান। লেখাটি এমন:

‘আমার জন্ম হলো আর ইংরেজি নতুন বছর শুরু হলো। আমার বিয়ে হলো আর নতুন শতাব্দি শুরু হলো। আমার মেয়ের জন্ম হলো বাংলা নতুন বছর শুরু হলো। এই হচ্ছি আমি। আমি মানে নতুন কিছু শুরু। আমাকে নিয়ে আমি খুব খুশি। এই আমার কিছু পাবার ইচ্ছা নেই, তাই কোনো ব্যর্থতা নেই। যা পেয়েছি তা একান্তই আামার। যা পাইনি তা আমার নয়। আমি কারো নই, কেউ আমার না। কিছু করি না, কিছু করাই না। কোথাও কোনো দাগ চিহ্ন নেই আমার। আমি চলে গেলে কোথাও কোন শূন্যতা তৈরি হবে না, ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাসের বেগ আসবে না কারো। কারো উল্লাসও হবে না। তিনি আসলেন ঘুরে ফিরে চলে গেলেন। কি মসৃণ আসা যাওয়া। তবে কিছু ঋণ আছে। আকাশের নীল, ধূসর আর কালো মেঘ, সাগরের নোনা জল, নদীর বুক ছুঁয়ে আসা শীতল বাতাস, শিশির ভেজা ঘাস, গাছের সবুজ, সূর্যের তাপ, চাঁদের কোমল আলো, অমাবস্যার আঁধার। আমার অনেক ঋণ আছে। মায়ের কোল, বাবার তর্জনী, বোনের খুনসুটি, ভাইয়ের স্নেহ-ভালোবাসা। ঋণ আছে আমার শিশু মেয়ের হাসির, প্রিয়তমা বধুর বুকের উষ্ণতার। আর অপেক্ষা করে আছে ভেজা মাটি। প্রকৃতির শতভাগ সুবিধাভোগী আমি। যার জন্য কোনো মূল্য দিতে হয়নি আমার। জমে আছে সব আমাকে ঋণী করে। কিভাবে শোধ হয় এই ঋণ। আমার প্রয়োজনে আমি নিয়েছি, না তাদের প্রয়োজনে তারা দিয়েছে। কোথা থেকে এসেছি তা আমি নিজে জানি না, কোথায় যাবো কেউ জানে না। সত্য মিথ্যা মিলে এই আমি – কে আমি? তুমি যদি আমায় ঘৃণা করতে তবে বুঝতাম আমি অপ্রিয়, যদি ভালবাসতে বুঝতাম আমি প্রিয়। কোথাও প্রভাব নেই আমার, কেউ প্রভাবিত করে না আমায়। জন্মে উল্লাস নেই আমার, উল্লাস আমার প্রতিদিন।’

নোমান নিজেও জানতেন না কত মানুষ তাকে ভালোবাসতো। তার চলে যাওয়া কত মানুষের মন খারাপের কারণ হয়েছে তার জানা হবে না। নোমান জানেন না তার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তার মতো সহজ সাবলীল সুন্দর মনের মানুষদের বড্ড প্রয়োজন। ওপারে ভালো থাকুন তিনি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

six + fourteen =