শুধু দুর্নীতি নয় সামগ্রিক কর্মসংস্কৃতিই প্রশ্নবিদ্ধ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

সরকারি কর্মকর্তাদের আমলনামার কিছু কিছু প্রকাশিত হচ্ছে আর মানুষ ভয় পেয়ে যাচ্ছে এদের দুর্নীতির নমুনা দেখে। বিশাল বিশাল দুর্নীতির খতিয়ান পড়ে শেষ করা যায় না। মানুষ ভাবছে, প্রশ্ন করছে; ওরা ঘুষ খায় জানতাম, তাই বলে এতো খায়? সামাজিকমাধ্যম ও যোগাযোগমাধ্যমে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, কাস্টমস সদস্য মতিউর রহমানের পর আরও বেশকিছু নাম আসছে। দুদক এখন এখন তদন্ত করছে। সরকার স্বউদোগে কোনটিই উদ্ঘাটন করেনি। তবে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার অভিযান শুরু করেছে, সে যে-ই হোক, দুর্নীতি করলে কারও রক্ষা নেই। যারাই দুর্নীতি করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।

কিন্তু আসলেই কি অভিযান শুরু হয়েছে? সেটা তো দৃশ্যমান নয়। সামাজিকমাধ্যম আর গণমাধ্যমে খবর আসার পর কিছু টুকটাক অ্যাকশন দেখছে মানুষ, কিন্তু সেই অর্থে কোনো অভিযান তো দেখা যাচ্ছে না। যাইহোক, তবুও সরকার প্রধান যখন বলেছেন, তখন সেকথা গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করতে হবে এবং আমরা আশা করছি যে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংকখোর দানব, পুঁজিবাজার ধ্বংসকারী ব্যবসায়ীসহ রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট লুটেরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশের সরকারি অফিসগুলোতে কর্মচারী ও কর্মকতারা ব্যাপক ঘুষ খায়, দুর্নীতি করে, এই তথ্যটা অজানা নয়। কিন্তু বেনজীর, আর মতিউরের দুর্নীতির ফিরিস্তি মানুষের কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যেই নতুন আরো নাম এসেছে। কাস্টমস কর্মকর্তা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের মতো দুর্নীতির পথে হেঁটে সম্পদের চূড়ায় উঠেছেন পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এডিশনাল আইজিপি) ড. শামসুদ্দোহা খন্দকার। শুধু শামসুদ্দোহা একা নন, তার স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানাও দুর্নীতির ছায়ায় সম্পদে হয়েছেন শক্তপোক্ত। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, এ দম্পতি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের মালিক। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার ২৭ শতক জমি আছে তাদের নামে। দলিলে এসব জমির দাম ৭০ কোটি টাকা দেখানো হলেও আদতে বাজার দর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এই দোহা সাহেব গুলশানে ২০০ কোটি টাকা মূল্যের একটি সরকারি বাড়িও দখল করে রেখেছেন। একটি পত্রিকা লিখেছে, শামসুদ্দোহা খন্দকার শুধু গাছেরটা খান না, তলারটাও কুড়ান। কিন্তু এরকম কতজনকে ধরবে সরকার?

সরকারি অফিসে দুর্নীতি এক বিশাল সমস্যা। কিন্তু ঘুষ দিয়েও কি মানুষ কাক্সিক্ষত সেবা পায়? সরকারি কর্মীদের বিশাল এক অংশ ঘুষ খেয়েও কাজ করে না, করতে পারে না, যা করে সেটা ঠিকভাবে দক্ষতার সাথে করতে পারে না। এরা অদক্ষ, এরা অলস, এরা কর্মবিহীন থাকতে পছন্দ করে, এরা কাজে ফাঁকি দেয়। নামাজের নাম করে, দুপুরের খাবারে উছালায় বেরিয়ে যায় এবং আর ফিরে আসে না; এরকম অসংখ্য গল্প চালু আছে। এদের মনোজগতে কাজ করার কোনো তাড়নাই নেই। এরা হয়তো মনে করেন, কাজ করার দরকারই বা কী? কাজ না করলে যদি চলে যায়, তবে খামাখা নিত্যদিন অফিসে যাওয়ার একঘেয়ে, বিরক্তিকর পুনরাবর্তনে নিয়োজিত থাকা কেন?

তাই দুর্নীতিই একমাত্র সমস্যা না। একটা কাজের সংস্কৃতিই গড়ে উঠেনি বহু দপ্তরে। আমরা সবাই জানি, সরকারি কর্মচারীদের একটা বড় অংশ কাজে খুব অবহেলা করেন, ডেস্কে থাকেন না, অফিসে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে যান ব্যক্তিগত কাজে দীর্ঘদিন ফাইল আটকে রাখেন, কোনো প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দেন না, সাধারণ মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার করেন, প্রচুর ভুল করেন। এরকম অভিযোগ ঝুড়ি-ঝুড়ি। কিন্তু নিশ্চয়ই অনেক সরকারি অফিস আছে, যেখানে দক্ষ কর্মচারী আছেন, কর্মকর্তা আছেন এবং তারা পরিশ্রম করতে সদাই উন্মুখ, অথচ তাদের মূল্যায়ন হয় না।

সামগ্রিক চিত্রটা উৎপাদনশীলতার পরিপন্থী। সরকারি দপ্তরে কর্মী-মূল্যায়ন ব্যবস্থা রয়েছে বটে, কিন্তু তার ভিত্তিতে কর্মীদের শাস্তি বা পুরস্কারের যথার্থ ব্যবস্থা করা এ দেশের রাজনৈতিক কাঠামোয় প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুর্নীতি, আলস্য আর কাজ ফাঁকির সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি। সরকারি কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের একটা বড় অংশ এখন দলীয় কর্মীদের চাইতেও বেশি রাজনীতি করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য। এই গোষ্ঠীটা প্রবল প্রতাপে সবকিছু করায়ত্ব করেছে। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামো এদের প্রশ্রয় দেয়। এরকম অনিয়ম, এরকম রাজনীতি এবং দুর্নীতি উপর মহল থেকে নিচতলা পর্যন্ত বিস্তৃত। যারা দুর্নীতিগ্রস্ত নন, তারাও স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেন না।

পুরো পরিস্থিতি সরকারি চাকরির একটা ভয়ংকর ভাবমূর্তি দাঁড় করিয়েছে যে, কাজ করতে হয় না, কিন্তু বেতনের বাইরে উপরি অনেক। তাই সরকার প্রধান যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সতর্ক করছেন তখন দৃষ্টি দিতে হবে সরকারি দপ্তরের সামগ্রিক কর্মসংস্কৃতির দিকে।

একথা মানতেই হবে যে, কাজে ফাঁকি এবং দুর্নীতি বন্ধ করা খরচসাপেক্ষ এবং বহু সমস্যাসঙ্কুল। সমস্যা জটিল, কিন্তু এটা তো করতে হবে। সরকারি উৎপাদনশীলতা এবং সেবা-পরিষেবার মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এই মূল্যায়ন যথাযথভাবে করতে গেলে কাজে ফাঁকি, দুর্নীতি, কাজের অভাব, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ইত্যাদি সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে, সরকারই বা কতটা দায়বদ্ধ কাজের পরিবেশ সৃষ্টিতে।

একটা সমস্যা তো আছেই। প্রশাসনকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা হলে সরকারি কর্মকর্তারা রাজনৈতিক সরকারকে পাত্তা দিতে চায় না। এর একটা কার্যকর সমাধান প্রয়োজন। সরকার চাকরি দেয় ঠিকই, কিন্তু কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে অক্ষম। এ কারণেও কর্মসংস্কৃতি সৃষ্টি হয় না যথাযথভাবে।

লেখক: সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিন দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eight + seven =