শুভ কথা

মৌ সন্ধ্যা

স্বপ্ন ও প্রচেষ্টা মানুষকে শূন্য থেকে পরিপূর্ণ করে দেয়। মিডিয়া জগতে এমন শূন্য থেকে পথ চলা শুরু করে এখন খ্যতির চূড়ায় পৌঁছে গেছেন অনেকেই। নিজেদের যোগ্যতা দিয়েই তারা হয়েছেন অনেকের অনুপ্রেরণা। দেশের এমনই একজন নন্দিত নায়কের নাম আরিফিন শুভ। সর্বশেষ বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীনির্ভর ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমার মুজিব চরিত্রে অভিনয় করে সবার নজর কেড়েছেন তিনি। এটাই ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেটের সিনেমা। ২ ফেব্রুয়ারি চিত্রনায়ক আরিফিন শুভর জন্মদিন। রঙবেরঙ এর পক্ষ থেকে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

ভালুকার ভালো ছেলে

আরিফিন শুভর জন্ম ১৯৮২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করেন। তার পৈত্রিক বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলায়। এখনো সেই গ্রামের বাড়িতে তার বাবা বসবাস করেন। অবসর পেলেই শুভ গ্রামে ছুটে যান। সময় কাটান কাছের মানুষদের সঙ্গে। ভালুকার ভালো ছেলে হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত তিনি।

মডেলিং দিয়ে শুরু, অতঃপর অভিনয়ে

মিডিয়া জগতে আরিফিন শুভর শুরু হয়েছিল মডেলিংয়ের মাধ্যমে। র‌্যাম্প মডেল হিসেবেও এক সময় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন ছয় ফুটের বেশি লম্বা এই সুদর্শন নায়ক। বেশকিছু বিজ্ঞাপনেও দেখা মিলেছে তার। মিস্টার কুকিজের বিজ্ঞাপনে তার সাথে কাজ করেন নুসরাত ফারিয়া, যমুনা গ্রুপের বিজ্ঞাপনে নাদিয়া নদী ও প্রাণ আপের বিজ্ঞাপনে পরীমনি। তার মডেলিংয়ে ক্লোজআপ ও বাংলালিংকের বিজ্ঞাপন দুটিও ব্যাপক সাড়া ফেলে। এক সময় ছোট পর্দায় অভিনয়ে সুযোগ পান আরিফিন শুভ। ২০০৭ সালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘হ্যাঁ/না’ নাটকের মাধ্যমে ছোটপর্দায় তার যাত্রা শুরু হয় তার। এরপর ২০০৮ সালে ‘ইজ ইকুয়াল টু’ ধারাবাহিকে অভিনয় করে নিজের অবস্থান আরেকটু পোক্ত করে নেন শুভ। অনেক তারকার ভিড়ে তার চরিত্রটিই বেশি আলোচিত হয়েছিল, ‘ইজ ইক্যুয়াল টু’ নাটকে। এরপর অনেক নাটকে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন আরিফিন শুভ।

সিনেমার হাতছানি

প্রত্যেক অভিনেতার স্বপ্ন থাকে বড় পর্দার অভিনেতা হওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণ হতে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি আরিফিন শুভকে। তার অভিনীত প্রথম সিনেমার নাম ‘নমুনা’। যদিও মুক্তি পায়নি সেই সিনেমা। তবে থেমে থাকেননি শুভ। ২০১০ সালে ‘জাগো’ সিনেমা মুক্তির মাধ্যমে শুভর অভিষেক হয় চলচ্চিত্রে। এরপরে তিনি বেশকিছু দিন চলচ্চিত্র থেকে দূরে ছিলেন। পরে থিতু হয়েছেন সিনেমাতেই।

আরিফিন শুভর যতো সিনেমা

কয়েক বছর বিরতির পর ২০১৩ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক সাফি উদ্দিন সাফি পরিচালিত ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’ চলচ্চিত্রে খলচরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র পরিচালক ও সমালোচক মতিন রহমান শুভর এই সিনেমায় ‘কানে লাগে’ সংলাপটির জন্য ও তার অভিনয় অভিব্যক্তি প্রকাশের স্টাইলের প্রশংসা করেন। সিনেমাটি ব্যবসায়িক দিক থেকেও সফল হয়। সে বছর ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এতে তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন আইরিন সুলতানা। ২০১৪ সালে ইফতেখার চৌধুরীর ‘অগ্নি’ সিনেমায় শুভ একজন বক্সিং খেলোয়াড় ও পেশাদার খুনি ড্রাগন চরিত্রে অভিনয় করেন। একই বছর শাহাদাত হোসেন লিটনের ‘মন বোঝে না’, মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত ‘তারকাঁটা’ সিনেমায় অভিনয় করেন। এরপর আশিকুর রহমান পরিচালিত ‘কিস্তিমাত’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন শুভ। যা ব্যবসায়িক দিক থেকে বেশ ভালো সাফল্য পায়। ২০১৫ সালে শিহাব শাহীন পরিচালিত ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ ও সাফি উদ্দিন সাফি পরিচালিত ‘ওয়ার্নিং’ চলচ্চিত্রে কাজ করেন। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ চলচ্চিত্রটি দর্শকদের ব্যাপক সাড়া পায়।

২০১৬ সালে আরিফিন শুভ আশিকুর রহমান পরিচালিত অ্যাকশন ধর্মী ‘মুসাফির’ সিনেমায় অভিনয় করেন। এরপর অনন্য মামুন পরিচালিত নাট্যধর্মী ‘অস্তিত্ত্ব’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই সিনেমাটিও ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং দর্শক ও সমালোচকদের কাছে শুভ বেশ প্রশংসা পান। ২০১৬ সালের শেষ দিকে মুক্তি পায় জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ‘নিয়তি’ সিনেমাটি। এতে শুভর বিপরীতে অভিনয় করেন জলি। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে মুক্তি পায় জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত পথ-রোমাঞ্চকর রোমান্টিক ‘প্রেমী ও প্রেমী’ এবং শামিম আহমেদ রনি পরিচালিত কমেডিধর্মী ‘ধ্যাততেরিকি’। এই সিনেমা দুটিতেও শুভ প্রশংসিত হন। একই বছর অক্টোবরে মুক্তি পায় দীপংকর দীপন পরিচালিত পুলিশ অ্যাকশন ত্রিলার ‘ঢাকা অ্যাটাক’। এতে শুভকে ঢাকা মহানগর পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান আবিদ রহমান চরিত্রে দেখা যায়। এই সিনেমাটিও বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং আন্তজার্তিকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমা হয়। এরপর ২০১৯ সালে মুক্তি পায় আরিফিন শুভর ‘আহা রে’ সিনেমাটি। এটি থেকে দর্শকদের কাছ থেকে বেশি ইতিবাচক সাড়া পান শুভ। এখানে তার বিপরীতে ছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। এছাড়াও একই বছরের শেষদিকে মুক্তি পায় রাজনৈতিক থ্রিলার ‘সাপলুডু’। যা দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়।

২০২১ সালে মুক্তি পায় নাবিদ সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদ এর ‘মিশন এক্সট্রিম’। এখানেও চমক দেখিয়েছেন শুভ। ২০২৩ মুক্তি পায় নাবিদ সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদ এর ‘ব্ল্যাক ওয়ার: মিশন এক্সট্রিম ২’। শুভ ভালো করেছেন এখানেও। মিজানুর রহমান আরিয়ান পরিচালিত চরকি ওয়েব ফিল্ম ‘উনিশ ২০’ এ রোমান্টিক অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন শুভ। অমিতাভ রেজার ‘আয়নাবাজি’ সিনেমাতে সাজ্জাদ চৌধুরী নামের একটি অতিথি চরিত্রেও পাওয়া যায় আরিফিন শুভকে। আরিফিন শুভ ২০২৩ সালে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর চরিত্রে অভিনয় করছেন। ভারতীয় নির্মাতা শ্যাম বেনেগালের ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ দিয়ে আরও একবার তুমুল আলোচনায় আসলেন আরিফিন শুভ। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত বঙ্গবন্ধুর জীবনী নির্ভর এই সিনেমায় মুজিবের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হন শুভ। বিগ বাজেটের ছবি হলেও, ‘মুজিব’-এ অভিনয়ের বদৌলতে শুভ পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়েছিলেন মাত্র ১ টাকা!

শুভকে ‘আব্বা’ ডেকে যা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী

‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমার শুটিং শুরু করার আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ চরিত্র রূপদানকারী আরিফিন শুভর সঙ্গে কথা হয় দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ওই মুহূর্তের কথা সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন ঢালিউড চিত্রনায়ক আরিফিন শুভ। সে ভিডিওটিই পরে হয় নেট দুনিয়ায় ভাইরাল। ওই ভিডিওতে শুভকে বলতে দেখা যায় মুজিব বায়োপিকের শুটিং শুরুর আগের কথা। ওই সময়ের কথা বলতে গিয়ে শুভ বলেন, আমি তাঁকে (প্রধানমন্ত্রী) দূর থেকে দেখছিলাম। অন্যরা তার কাছাকাছি ছিলেন। সব আর্টিস্টদের ভিড়ে তিনি আমাকে দেখতে পারছিলেন না। হঠাৎ করেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আমার আব্বা কোথায়?’ শুভ আরও বলেন, ওই সময় ‘আব্বা’ বলে খোঁজার পরই দ্রুত আমি তাঁর সামনে যাই। তখন তিনি আমাকে একটা কথাই বলেছিলেন। আর তা হলো: ‘ভালো করে করো।’ তখন আমার মনে হয়েছিলো, একজন সন্তান হিসেবে তিনি আমাকে একথা বলেছিলেন। ওই সময় তার চোখের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না।

প্রধানমন্ত্রীর ওই কথাই মুজিব সিনেমায় ভালো অভিনয় করার প্রেরণা যুগিয়েছে চিত্রনায়ক শুভকে। অভিনয় ক্যারিয়ারে সেরা কাজটি করার সময় নিজেকে সবসময়ই কঠিন অনুশীলনে রেখেছেন তিনি। এ সিনেমায় সব দৃশ্যতেই তার আবেগ জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে সিনেমার শেষ দৃশ্য (১৫ আগস্টের দিন বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দৃশ্য)।

সরকারের পক্ষ থেকে প্লট উপহার

সরকারি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন চিত্রনায়ক আরিফিন শুভ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প থেকে অভিনেতা আরিফিন শুভকে ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ১৮তম বোর্ড সভায় অভিনেতা আরিফিন শুভর নামে ১০ কাঠা আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অভিনেতা আরিফিন শুভর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাড়ির ঠিকানায় চিঠি দিয়ে বরাদ্দের এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। ২০২৩ সালের শেষ দিনে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফিন শুভকে প্লট বরাদ্দের বিষয়টি নিশ্চিত করে চিঠি দেন।

ব্যক্তিগত জীবন

আরিফিন শুভ ২০১৫ সালে অর্পিতা সমাদ্দারকে বিয়ে করেন। অর্পিতা সমাদ্দার পেশায় একজন ফ্যাশন ডিজাইনার এবং ঢাকায় একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করেন। বর্তমানে সুখেই দিন কাটাচ্ছেন তারা।

শেষ কথা

সকলেই স্বীকার করবেন বর্তমানে ঢালিউডে অন্যতম সফল নায়ক আরিফিন শুভ। নিত্যনতুন ভালো কাজ দর্শকদের উপহার দিয়ে চলেছেন তিনি। সিনেমার প্রয়োজনে কঠোর পরিশ্রম করে সিক্স প্যাক বানান যেমন, তেমন প্রয়োজনে শারীরিক গঠনের পরিবর্তন আনেন। আরও এগিয়ে যাক শুভ। বিনয়ী এই নায়ক সব সময় বলেন, দর্শকের টাকায় তিনি পোশাক পরেন, খাবার খান। দর্শক তার মূল্যবান সময় বের করে টাকা খরচ করে তার সিনেমা দেখে বলেই তিনি আজকের আরিফিন শুভ। তার বিনয় ও যোগ্যতা তাকে আরও বহু দূরে নিয়ে যাক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fourteen − 6 =