শৈশবের স্মৃতি হাওয়াই মিঠাই

আমাদের শৈশবের স্মৃতি উসকে দেয় এমন খাবারের মধ্যে অন্যতম হাওয়াই মিঠাই। নাম শুনলেই কানে বেজে ওঠে ঝুনঝুনির টুং টুং শব্দ। ভেসে আসে ফেরিওয়ালার হাঁক, এই হাওয়াই মিঠাই…। সে ডাক শুনতেই আমরা পিছু নিতাম তার, ঠিক যেভাবে হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার পিছু নিয়েছিল শহরের সব ছেলেমেয়ে। এ এমন এক খাবারে মুখ ভরে গেলেও ভরে না মন। দেখলে আট থেকে আশি সবারই মন উচাটন। চলুন তবে জেনে নেই হাওয়াই মিঠাইয়ের ইতিহাস। জানাচ্ছেন হাসান নীল

শুরুর কথা

সে ১৪০০ শতকের কথা। গল্পের শুরু ইতালিতে। সেসময় দেশটিতে ঘরোয়াভাবে হাওয়াই মিঠাই বানানোর প্রচলন ছিল। চিনি গরম করে বিশেষ পদ্ধতিতে সুতা তৈরি করে কাঠিতে পেচিয়ে বানানো হতো তৃপ্তি এনে দেওয়া এই খাবার। যা হাওয়ার সংস্পর্শে এলেই হয়ে যেত শক্ত। তখনকার দিনের হাওয়াই মিঠাইয়ের জন্য চিনির তৈরি সুতাগুলো এখনকার মতো মিহি হতো না। সেমাইয়ের মতো মোটা হতো। ওই মোটা সুতার হাওয়াই মিঠাইয়েরই ছিল খুব সমাদর। কিন্তু সবার কপালে জুটত না। আজকাল চিনি সবার সাধ্যের মধ্যে থাকলেও সেসময় ছিল না। চিনি শুধু ধনাঢ্য পরিবারেই থাকত। তাই চাইলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার সাধ্য হতো না। ১৮০০ শতক পর্যন্ত এভাবে ঘরোয়া পদ্ধিতেই বানানো হতো এ মিঠাই। যা ধনীর কাছে সহজলভ্য হলেও গরীবের কাছে ছিল অধরা।

দুই বন্ধুর তৈরি মেশিন ঘটায় বিপ্লব

ধনী-গরীবের ব্যবধান ভেঙে হাওয়াই মিঠাইয়ের সর্বজনীন হয়ে ওঠার পেছনে হাত রয়েছে এক দাঁতের ডাক্তারের। তার নাম উইলিয়াম মরিসনের। ১৮৯৭ সালের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়ম মরিসন তার বন্ধু জন সি. ওয়ারটনকে সাথে নিয়ে প্রথম হাওয়াই মিঠাই তৈরির মেশিন উদ্ভাবন করেন। মেশিনটি বেশ কার্যকরী ছিল। এতে তৈরি চিনির সুতাগুলো ছিল আগের তুলনায় বেশ পাতলা। তাছাড়া বাতাস পেতেই শক্ত হয়ে যেত। ফলে অল্প সময়েই প্রস্তুত হতো হাওয়াই মিঠাই। এই মেশিন তৈরির মাধ্যমেই চিনির মোটা সুতায় তৈরি এই হাওয়ার মিঠাই যুগের অবসান ঘটে। তবে কার্যকরী হওয়া সত্ত্বেও মেশিনটি নিয়ে শুরুতে আগ্রহ দেখা যায়নি কারও মাঝে। অবহেলিতই ছিল বলা চলে।

প্রথম যেবার সাড়া জাগায়

তৈরির প্রায় এক দশকের মতো আড়ালেই ছিল মিঠাই তৈরির মেশিন। এতে হাল ছাড়েননি মেশিন উদ্ভাবনকারী উইলিয়াম ও জন। ১৯০৪ সালে মেশিনে তৈরি হাওয়াই মিঠাই নিয়ে তারা হাজির হন সেন্ট লুইসের বিশ্বমেলায়। পসরা সাজিয়ে বিক্রির জন্য বসে যান। কে জানত এবারের প্রচেষ্টা হবে উইলিয়াম-জনের ভাগ্য বদলের কারণ। সে মেলায় হাওয়াই মিঠাই দেদারসে বিক্রি হতে থাকে। প্রথম দিনই ২৫ সেন্ট করে ৬৮ হাজার ৬৫৫ বাক্স হাওয়াই মিঠাই বিক্রি হয়। যা ছিল সে সময়ের হিসেবে বেশ বড়সড় ব্যাপার! এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায় মেশিনে তৈরি হাওয়াই মিঠাইয়ের সুখ্যাতি। চাহিদা ও কদর দেখে বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে এটি বাজারজাত করতে। এখান থেকেই গড়ে ওঠে বিশ্বের সর্বাধিক হাওয়াই মিঠাই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টটসি রোল অফ কানাডা লি.।

গোল্ড মেডল প্রোডাক্টসের মেশিন

মেলার প্রথম দিন থেকে ক্রমেই বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় খাবারটি। তবে উইলিয়াম-জনের মেশিন হাওয়াই মিঠাই তৈরিতে বিপ্লব ঘটালেও এটি সামলানো ছিল বেশ যন্ত্রণাদায়ক। এটি চিনির সুতা তৈরির সময় অত্যধিক শব্দ করতো। বলা নেই কওয়া নেই ভেঙে যেত। ফলে মিঠাই প্রস্তুতকারীকে ঝাক্কিঝামেলা পোহাতে হতো। এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে মার্কিন কোম্পানি গোল্ড মেডল প্রোডাক্টস। ১৯৪৯ সালে স্প্রিংয়ের একটি মেশিন তৈরি করে তারা। মেশিনটি হাওয়াই মিঠাই তৈরি প্রক্রিয়া আরও সহজ করে তোলে। এতে চাহিদাও বেশ বাড়তে থাকে। কাজ আসতে থাকে কোম্পানিটির। আজ অবধি কোম্পানিটি হাওয়ার মিঠাই বানানোর মেশিন বিক্রি করে যাচ্ছে।

তৈরি প্রক্রিয়া

মুখে দিলেই চুপসে যাওয়া হাইয়াই মিঠাই নিয়ে অনেকেরই কৌতূহলের শেষ নেই। তারা জানতে চান, ওই মেশিন দিয়ে কীভাবে হাওয়াই মিঠাই তৈরি করা হয়। প্রথমে মেশিনে চিনি দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে চিনি গলে যায়। মেশিনটির ভেতর একটি ছিদ্রযুক্ত পাত আছে। ওই সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত পাতে চিনির সিরা মেশিনে রেখে অনবরত ঘোরানো হয়। এতে করে ছিদ্রগুলো দিয়ে চিনির সিরা অতি সরু সুতা হয়ে বের হতে থাকে যা বাতাসের সংস্পর্শে এলেই শক্ত হয়ে যায়। এবার ওই সুতাগুলো পেচিয়ে বানানো হয় হাওয়াই মিঠাই।

সম্রাট হেনরিকে আপ্যায়ন

মেশিন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে যে হাওয়াই মিঠাই বানানো হতো সেটিরও যে বেশ কদর ছিল একটি গল্পে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ষোড়শ শতকে ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় হেনরি গিয়েছিলেন ইতালির ভেনিসে। সম্রাটকে আপ্যায়নে দেশটির নানারকম সুস্বাদু খাবারে সাজানো হয়েছিল টেবিল। যেখানে হাওয়াই মিঠাইও ছিল।

চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো

শোনা যায়, জোসেফ ল্যাসকক্স নামের একজন মার্কিন দন্ত চিকিৎসক ছিলেন। তিনি দাঁতের চিকিৎসায় এই হাওয়াই মিঠাই ব্যবহার করতেন। চিকিৎসা শেষে কেমন অনুভব হয় সেটা জানতেই রোগীর মুখে পুরে দিতেন হাওয়াই মিঠাই। এর অবশ্য কারণও ছিল। অন্য ক্যান্ডি খেলে দাঁতে লেগে থাকে। ফলে দাঁত ফ্লস না করলে নানারকম সমস্যা তৈরি হয়। তবে হাওয়ার মিঠাই খাওয়ার পর এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো না। তাই হাওয়াই মিঠাই দিয়েই কাজটি সারতেন তিনি।

কবে এলো ভারতবর্ষে

ভারতবর্ষে কীভাবে হাওয়াই মিঠাই এলো সে কথা কেউ বলতে পারে না। নেই কোনো লিখিত দলিল। ধারণা করা হয়, অনেক আগে থেকেই এ উপমহাদেশে এর প্রচলন রয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শন পাপড়ি খায় এখানকার মানুষ। ধারণা করা হয় চিনি দিয়ে বানানো শন পাপড়ির মতো একই উপাদানে তৈরি হাওয়াই মিঠাইও অনেক দিন ধরে এদেশের মানুষকে তৃপ্তি দিয়ে আসছে।

একাল সেকাল

আজ থেকে দুই দশক আগে গ্রামবাংলায় ছিল হাওয়াই মিঠাইয়ের রমরমা অবস্থা। সেসময় তামা কিংবা কাসার ঝুনঝুনি বাজিয়ে পথে প্রান্তরে ফেরি করে বিক্রি করা হতো এটি। ঝুনঝুনির শব্দ শুনলেই ছুটে এসে হাওয়াই মিঠাইওয়ালাকে ঘিরে ধরত তারা ছেলেমেয়েরা। তবে পয়সা না দিয়েও ওই মিঠাই মিলতো। শুধু হাওয়াই মিঠাই না, শন পাপড়ি, চানাচুরসহ বিভিন্ন মুখরোচক খাবার যেমন লোহা, এলুমিনিয়ামের তৈরি পরিত্যক্ত জিনিসপত্রের বিনিময়ে পাওয়া যেত। স্কুলের সামনে এর বেশি চাহিদা ছিল। পাশাপাশি হাটে মাঠে ঘাটেও তুমুল বিক্রি হতো।

তবে আজকাল হাওয়াই মিঠাইয়ের সেই জৌলুস হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ফাস্টফুডের ভিড়ে এর দিকে তেমন কেউ আর তাকায় না। ফলে আগের মতো দেখা যায় না। বিক্রেতারাও আয়ের ক্ষেত্রে তেমন সুবিধা করতে পারেন না। অনেকে বাধ্য হয়ে করেছেন পেশার পরিবর্তন। যারা রয়ে গেছেন তারা করছেন বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন। এই যেমন হাওয়ার মিঠাইয়ের আকারে পরিবর্তন এসেছে। আগে সর্বোচ্চ টেনিস বলের সমান আকারের হতো। দিন দিন তা হয়ে উঠেছে ঢাউস সাইজের। দেখতে একেকটা রঙিন বেলুন বলে মনে হয়। রাজধানীর বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় এ দৃশ্য দেখা যায়। ছোটরাসহ প্রেমিক যুগলের কাছেও রঙ বেলুনের মতো এই হাওয়াই মিঠাইয়ের বেশ চাহিদা রয়েছে। পাশাপাশি ফটোগ্রাফিতেও অনেকে কাজে লাগান এটি।

হাওয়াই মিঠাইয়ের রঙ

দেশে সাদা নীল গোলাপি রঙে সীমাবদ্ধ থাকলেও দেশের বাইরে রঙের দিক থেকে বেনিয়াসহকলার সব কলাই পূর্ণ করেছে হাওয়াই মিঠাই। চীন জাপানে তো এর কারিগরেরা আরও এক ধাপ এগিয়ে। দেশগুলোতে রঙে বৈচিত্র্য থাকার পাশাপাশি এতে শিল্পকর্মও করা হয়। এছাড়া অনেক দেশে শুধু রঙের বৈচিত্র্যই থাকে না, স্বাদেও থাকে ভিন্নতা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, অ্যাপল, ম্যাপেল গোলাপ, ল্যাভেন্ডার, আমসহ বিভিন্ন ফ্লেভারের হাওয়াই মিঠাই পাওয়া যায়। ফলে একে তো রঙিন তার ওপর বিভিন্ন ঘ্রাণযুক্ত হাওয়াই মিঠাই ক্রেতাদের সহজেই আকৃষ্ট করে।

২০০০ টাকার হাওয়াই মিঠাই

দেশ ভিন্নতায় দামের দিক থেকেও পার্থক্য রয়েছে হাওয়াই মিঠাইয়ের। বাংলাদেশে এটি খুব সহজলভ্য। ৫-১০ কিংবা ২০ টাকাতেই পাওয়া যায়। তবে দেশের বাইরে এর দাম নির্ভর করে ফ্লেভারের ওপর। স্বাদ ও গন্ধের ভিত্তিতে কখনও তা বিক্রি হয় ভীষণ চড়া দামে। উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হবে সেফরন ফ্লোভারড কটন ক্যান্ডির কথা। যুক্তরাষ্ট্রের এই হাওয়াই মিঠাই কিনতে বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০০০ টাকা খরচ করতে হবে।

একেক দেশে একেক নাম

মানচিত্রের ভিন্নতায় হাওয়াই মিঠাইয়ের স্বাদ ও গন্ধের মতো নামেও ভিন্নতা রয়েছে। বাংলাদেশে হাওয়াই মিঠাই ডাকলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে রয়েছে হরেক রকম নাম। ফেয়ারি ফ্লস, ক্যান্ডি ফ্লস, স্পুন সুগার, কটন ক্যান্ডি। কটন ক্যান্ডি বলেই বেশি ডাকা হয়। প্রশ্ন জাগতে পারে এর কটন ক্যান্ডি নামের কারণ কী? কটন মানে তুলা। হাওয়াই মিঠাই দেখতেও অনেকটা তুলার মতো। সেকারণেই এমন নাম দেওয়া হয়েছে। অনেকে আবার মজার ছলে একে বুড়ির মাথার পাকা চুল বলেও ডেকে থাকেন।

নামকরণে সার্থকতা

মিঠাই হিসেবে পরিচিত হলেও এতে চিনির পরিমাণ কিন্তু তেমন না। এক কাঠিতে ৩০ গ্রামের মতো চিনি থাকে। বাকি ৭০ ভাগই থাকে বাতাস। একারণেই একে ডাকা হয় হাওয়াই মিঠাই।

হাওয়াই মিঠাই দিবস

যুক্তরাষ্ট্রে হাওয়াই মিঠাইয়ের এতটাই কদর যে এর জন্য ক্যালেন্ডারের পাতায় আলাদা একটি দিন রেখেছে তারা। সেটি হলো ৭ ডিসেম্বর। এদিন যুক্তরাষ্ট্রে কটন ক্যান্ডি ডে অর্থাৎ হাওয়াই মিঠাই দিবস হিসেবে পালন করা হয়। মন ভরে তারা হাওয়াই মিঠাই খায় দিনটিতে।

সবমিলিয়ে এটা স্পষ্ট পৃথিবীজুড়ে দেশ-জাতি, সীমারেখার ভিন্নতা থাকলেও হাওয়াই মিঠাইয়ের বেলায় মতে ভিন্নতা নেই কারও। ছোট থেকে বড় সকলেরই প্রিয় খাবার এটি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খাদ্য কথন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 − ten =