মো. আকতারুল ইসলাম
রাজিব (২৮) সৌদিআরবে কাজ করতো। দুর্ঘটনায় তার কোমড়ের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ায় সৌদি থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হয় তাকে। দরিদ্র ঘরের সন্তান হওয়ায় ঠিকমতো চিকিৎসা করতে পারছিলনা। ফলে ধীরে ধীরে পঙ্গুত্ব বরন করার উপক্রম হয়েছিল। এসময় গ্রামের স্কুল শিক্ষক রমিজউদ্দিনের কথায় শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে চিকিৎসা সাহায্যের আবেদন করে। সকল কাগজপত্র পরীক্ষা করে শ্রমিক কল্যাণ ফাউণ্ডেশন তার নামে ৫০ হাজার টাকা চেক প্রদান করে। এতে রাজিব পুনরায় চিকিৎসা করতে পেরেছে। এখন সে আগের চেয়ে বেশ সুস্থ।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কল্যাণের জন্য গঠিত চমৎকার একটি তহবিল। সরকারের মহতি উদ্যোগে গঠিত শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের দুর্দিনে পরম বন্ধু হিসেবে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে।
শ্রমিক জীবন জীবিকার প্রয়োজনে কোটি কোটি শ্রমজীবী প্রাতিষ্ঠানিক- অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রম বিক্রি করেন, জীবিকা নির্বাহ করেন, চালিয়ে নেন জীবন সংসার। এই শ্রমজীবী মেহনতি মানুষগুলো অনেক সময় দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন, আবার কর্মক্ষেত্রে একটু অসাবধনতা, অসতর্কতা কিংবা নিজের অজান্তেই পতিত হন দূর্ঘটনায়। কখনো মৃত্যুবরণ করেন, এমন দূর্ঘটনা অনেক সময় শ্রমজীবী এসকল মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। অথবা সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি পঙ্গুত্ব বরণ করেন অথবা দূর্ঘটনায় আহত শ্রমিকের চিকিৎসা অথবা শ্রমিকের মেধাবী সন্তানের উচ্চ শিক্ষায় সহায়তার জন্য তাদেও পাশে এসে সহযোগিতার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার বাংলাদেশ শ্রম আইনের অধীনে গঠন করে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল।
মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণের জন্য প্রাতিষ্ঠিানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সকল প্রকার শ্রমিকের কল্যাণে সরকার বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর আলোকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল গঠন করে। শ্রম আইনে বলা হয় যে সকল কোম্পানির মূলধন ২কোটি টাকার বেশি, বছর শেষে তারা যে লভ্যাংশ ঘোষণা করে তার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। শ্রম আইনে বলা হয় কোম্পানির মালিক ছাড়া ৫ শতাংশ লভ্যাংশের সুবিধা পাবেন কোম্পানির সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ। লভ্যাংশের ৫ শতাংশের ৮০ ভাগ কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিক সরাসরি ভাগ করে নিবেন, ১০ ভাগ জমা হবে সেই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে, আর ১০ ভাগ জমা দিবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল গঠনের পর থেকে মে’২০২৩ পর্যন্ত দেশি, বিদেশী-বহুজাতিক মিলে ৩৩৭টি কোম্পানি নিয়মিত তাদের লভ্যাংশ জমা দিচ্ছে। মে’২০২৩ পর্যন্ত ৮৪৬ কোটি টাকারও বেশি জমা হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন কোম্পানি যোগ হচ্ছে এ তালিকায়। বিধান অনুযায়ী কোনো শ্রমিক প্রাতিষ্ঠিানিক হোক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক হোক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে তার স্বজনদের ২ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়। মৃতের দাফনের জন্য অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিক স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করলে সর্বোচ্চ ২ লক্ষ টাকা, দুরারোগ্য চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ ২ লক্ষ টাকা এমনকি সন্তান সম্ভবা নারী শ্রমিকদের জন্য ২৫ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। শ্রমিকদের সন্তান যারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি, মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত তাদের সর্বোচ্চ তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত শিক্ষা সহায়তা প্রদান করা হয়।
শ্রমিকের দুর্ঘটনায় মৃত্যু, দাফন-কাফন, স্থায়ী পঙ্গুত্ব, চিকিৎসা সহায়তা, সন্তান সম্ভবা নারী শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তাসহ এ তহবিল থেকে এ পর্যন্ত ২৩ হাজার ৩৮৭ জন শ্রমিককে ১১০ কোটি ১১ লাখ ৫৮ হাজার টিাকার ও বেশি ৩৫৫ টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। শ্রমিকের আর্থিক সহায়তার জন্য প্রতিদিনই সারা দেশ থেকে শতশত আবেদন জমা হচ্ছে। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল তাদের আশ্রয় স্থল। এখান থেকে অর্থ সহায়তা পাওয়া শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এবছরের মে পর্যন্ত মাত্র ৫ মাসে ৪ হাজার ৪’শ ৩১ জন শ্রমিককে সাড়ে ২২ কোটি টাকার বেশি আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। অনেক সময় জরুরী ভিত্তিতে শ্রমিকের চিকিৎসার প্রয়োজনে চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হয়। সাম্প্রতিক কয়েকটি দুর্ঘটনায় আহত অনেক শ্রমিকের চিকিৎসার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তাৎক্ষনিকভাবে চিকিৎসা সহায়তা দেযা হয়েছে। চট্রগ্রামের সিতাকুন্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকান্ড, পুরান ঢাকার দু’তিনটি অগ্নিকান্ডেই দগ্ধ/আহতদের তাৎক্ষনিকভাবে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা সহায়তা হয়েছে। সম্প্রতি ‘নাকে অক্সিজেনের নল লাগিয়ে রিকশা চালানো সেন্টু এখন হাসপাতালে’ এমন একটি সংবাদের পরিপক্ষিতে শ্রম প্রতিমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে সেন্টু চিকিৎসার খোঁজখবর এবং বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
শুধু কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিকই নয়, যারা কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন না মানে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক। যেমন- কৃষি কাজ করেন, ভ্যান চালান, ঠেলাগাড়ি চালান, ইট ভাংগেন, সবাই এ সুবিধার আওতাভুক্ত। এমন অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করলে আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির জন্য তাঁর মৃত্যু সনদ, চিকিৎসার জন্য রেজিস্টার্ড ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অথবা পৌরসভা কিংবা সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলার এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থিত শ্রম দপ্তর, কিংবা কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সুপারিশ নিয়ে ফরমের সাথে জমা দিতে হবে। আর কোনো শ্রমিক যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন তাহলে মৃত্যু সনদ কিংবা চিকিৎসা সহায়তার ক্ষেত্রে চিকিৎসাপত্রের সাথে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সুপারিশ জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন এর ওয়েব সাইটে আর্থিক সহায়তা ফরম আছে,ডাউন লোড দিয়ে প্রিন্ট করে ফরম পূরণ করে জমা দিতে হবে।
আবেদন জমা দেওয়ার জন্য ঢাকায় আসার প্রয়োজন নেই। বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে শ্রম পরিদপ্তরের অফিসে, কিংবা কলকারখানা ও পরিদর্শনের অফিসে জমা দেওয়া যাবে। শ্রমিকের মৃত্যুতে তার স্বজনরা, দুর্ঘটনায় আহত হলে কিংবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা নারী শ্রমিক সন্তান সম্ভবা হলে ‘ক’ ফরমে আবেদন করতে পারবেন। আর শিক্ষা সহায়তার জন্য রয়েছে ‘কক’ ফরম। এই সুযোগে বলে রাখা ভালো শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকদের কল্যাণে একই রকম সুযোগ সুবিধা প্রদানের জন্য ‘কেন্দ্রীয় তহবিল’ নামে আলাদা একটি তহবিল রয়েছে।
বর্তমান সরকার সাধারণ জনগণের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা চালু করে তা তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। শ্রমিকের কল্যাণে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। বিপদে-আপদে শ্রমিকের পাশে আছে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল শ্রমিকের বন্ধু, দুর্দিনের সহায়। এ তহবিল শ্রমিকের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে সহযোগিতা করে, শ্রমিকদের যে কোনো বিপদে সহায়তার হাত বাড়িয়ে সুস্থ সবলভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা শ্রম মন্ত্রণালয়
পিআইডি ফিচার