সংগীত পরিচালনা সহজ নয়…

শ্রোতারা শিল্পীর গান শোনেন, তাকে বাহবা দেন। কিন্তু এই গানটির পেছনে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম থাকে গীতিকার-সুরকার ও সংগীত পরিচালকের। চিরকালই তারা আড়ালে থেকে উপহার দিয়ে যান জনপ্রিয় গান ও শিল্পী। আড়ালের প্রতিভাবান মানুষটি আড়ালেই থেকে যায়। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির এমনই একজন উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম আরমান খান। জেমস, হাসান, বিপ্লব, মমতাজ এমন অনেক জনপ্রিয় শিল্পীর জনপ্রিয় গানের সুরকার ও সংগীত পরিচালক আরমান খান। মাঝে মধ্যে নিজেও গানে কণ্ঠ দেন। অভিমান করে দীর্ঘদিন গান থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। সম্প্রতি জীবনের নানা গল্প শুনিয়েছেন আরমান খান। রঙবেরঙ এর পক্ষ থেকে তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মাসুম আওয়াল

দীর্ঘ বিরতির পর অল্প পরিসরে দেখা মিলছে আপনার। সংগীত পরিচালক নয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে হাজির হয়েছেন, এই ধারাবাহিকতা থাকবে?

ইনশাআল্লাহ ইচ্ছা আছে ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাব।

‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ গানটির জন্য বেশ প্রশংসা পেয়েছেন। নতুন গান কবে আসবে?

জয় করলেন বিষয়টাতে আমি খুব একটা নিশ্চিত না। কতটুকু জয় করতে পেরেছি বলতে পারবো না। সংগীতে আসলে অতৃপ্তি থেকেই যায়! তারপরও মানুষ ভালো বলতে পারবে আমার সৃষ্টির ব্যাপারে। নতুন গান আসবে। বেশকিছু নতুন গান তৈরি করেছি।

ঢেকি যেখানে যায় সেখানেই ধান ভানে, আসলেই কি সংগীত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যায়? আপনার হোম স্টুডিও আছে?

সংগীতকে ছাড়া যায় না আসলে। যিনি এটাকে একবার ভালোবেসেছেন, হৃদয়ে লালন করেছেন, এটা তার পক্ষে ছাড়া সম্ভব না। হোম স্টুডিও আসলে এই মুহূর্তে নেই।

চাকরিস্থল গ্র্যান্ড সুলতানে অতিথিদের গান শুনিয়েছেন কখনো?

গ্র্যান্ড সুলতানে এখনো মাঝেমধ্যে টুকটাক পিয়ানো বাজানো হয়। এটা বাজানোর অভ্যাস আছে, এখনো চলছে। যেসব অতিথি আমাকে আগে থেকেই চিনেন কিংবা এখানে এসে আমার সঙ্গে পরিচিত হন, তারা অনেক সময় লবিতে বসে পিয়ানো শোনার আবদার করেন। সেসময় হয়তো তাদের পিয়ানো বাজিয়ে শোনাই। এমন অভিজ্ঞতা বেশ কয়েকবার হয়েছে। অনেক অতিথিদের পিয়ানো বাজিয়ে শুনিয়েছি।

হঠাৎ কেউ জানলো তার প্রিয় গানের সুরকার সংগীত পরিচালক আপনি, তারপর পরিস্থিতি কেমন হয়?

এমন অনেক হয়েছে। গল্পের ছলে তারা জানতে পেরেছে আমি সেই আরমান খান। তখন আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। একদিকে  ভালোও লাগে অন্যদিকে কষ্টও হয়। কেন জানে না, কেন উনি জানেন না এটা, এজন্য কষ্ট লাগে। আমাদের দেশে গায়ক-গায়িকা নির্ভর শ্রোতা তৈরি হয়। শ্রোতারা জানতেও চেষ্টা করে না এই গানটা কার লেখা? কার সুর? এ কারণে মাঝেমধ্যে বিব্রত বোধ করি। এমন একটা জনপ্রিয় গান সারা বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে কিন্তু গানটার সুরকার যে আমি এটাও জানলো না শ্রোতা, তাকে আমাকেই জানাতে হলো। ভাবতে পারেন বিষয়টা!

গান তৈরি করেন গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। কিন্তু বাহবা পান গায়ক। শিল্পীর করণীয় কী?

একজন শিল্পী যখন স্টেজে উঠে গান করেন, টেলিভিশনে গান করেন বা যেকোনো আড্ডায় গান করেন তখন অবশ্যই গীতিকার এবং সুরকারের নাম বলা উচিত। অনেক শিল্পী বলেন, আবার অনেক শিল্পী বলেন না। যারা বলেন না, তারা কেন বলেন না, জানি না। আর যারা বলেন তাদের প্রতি অনেক ভালোবাসা, শুভকামনা সবসময় থাকে। শিল্পীদের সবখানে গান গাওয়ার আগে গীতিকার, সুরকারের নাম বলা উচিত।

গান গাওয়ার সময় শিল্পী গানটির গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালকের নাম বললে নিশ্চয় কোনো ক্ষতি নেই?

গান গাওয়ার সময় গীতিকার সুরকারের নাম বললে তো কোনো ক্ষতি নেই। এ ক্ষেত্রে তার নিজের সম্মানও বাড়ে। গীতিকার সুরকারের সম্মানও বাড়ে।

আপনার গুরু কে? কিভাবে সংগীত পরিচালনায় যুক্ত হলেন?

সংগীত অবশ্যই গুরুমুখী বিদ্যা। আমার বাবা কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক আলম খান আমার গুরু। সংগীত পরিচালনায় যুক্ত হতে আমার একটু সময় লেগেছে। আমার বাবার চলচ্চিত্রের গানে কিবোর্ড বাজানো দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। এরপর কিংবদন্তি নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার ও অভিনেতা প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামুনের ধারাবাহিক নাটক ‘জোয়ার ভাটা’য় আবহাওয়া সংগীত করার মধ্যদিয়ে আমার সংগীত পরিচালনা শুরু হয়। এরপর অডিও ক্যাসেটে কাজ করার সুযোগ হয়। নাটকের আবহাওয়া সংগীতও করতে থাকি। আসলে আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটকে কাজ করার পরে কাজ করার জন্য আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাবার সাথে কাজ শুরু করার পর অনেক শিল্পীরা বলতেন আমাদের দু’একটা গান করে দেন। তাদের গান করতে করতেই প্রমিথিউজের বিপ্লব ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। বিপ্লব ভাই বলেন, ‘ভাই আমার জন্য কয়েকটা গান করে দেন।’ তখন দন্ত্য ন না মুর্ধন্য ণ’ গানটা করি। এই গানটি অসম্ভব জনপ্রিয় হওয়ার পরে আমাকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি। এরপর একের পর এক হিট গান করেছি।

সংগীত জীবনের স্ট্রাগলটা আসলে কেমন ছিল?

অনেকেই মনে করে আজম খান আমার চাচা এবং আলম খান আমার বাবা হওয়ার কারণে আমার সংগীতযাত্রার প্রথম দিকটা অনেক মসৃণ ছিল, সুন্দর ছিল। আসলে বিষয়টি তেমন না। আসলে সংগীতে আমার যাত্রাপথটি অনেক পিচ্ছিল ছিল। আব্বা সবাইকে বলতেন, শিখতেছে। বিভিন্ন মিউজিক কোম্পানি, নাটকের পরিচালক, তারা যখন আব্বাকে বলতেন আপনার ছেলে অনেক ভালো কাজ করে। তখন তিনি বলতেন, ও শিখতেছে। আজম চাচ্চু কিন্তু আমার গান গেয়েছেন অনেক পরে ২০০৪ সালের দিকে। যদিও তার আগে আমি অনেকগুলো অ্যালবামের কাজ করে ফেলেছি। আজম চাচ্চু আসলে আমাকে অনেকদিন অবজার্ভ করেছেন। ফ্যামিলির মধ্যে যখন এত বড় দুইটি ইনস্টিটিউট আজম খান ও আলম খান থাকেন তাদের ভাতিজা হিসেবে আমি যখন কাজ করছি তখন অনেক দায়বদ্ধতা চলে আসে। তাদের ছেলে হয়ে মার্কেটে একটা ক্যাসেট আসবে, গান আসবে; আর সেটা হিট করবে না এটা তো ঠিক না। যেকোনো উপায়ে এটাকে হিট করাতেই হবে। সবাই জানে আলম খান অনেক বড় সংগীত পরিচালক। তার ছেলে হয়ে আমার নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যদি সুন্দর না হয় তাহলে দুর্নাম হবে। এই বিষয়গুলো ভেবেই অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। সবসময় একটা মানসিক চাপ থাকতো। ধরেন অনেকটা বাংলাদেশ ক্রিকেট ন্যাশনাল টিম যদি মিরপুরে হোম গ্রাউন্ডে খেলে, মানুষের এক্সপেক্টেশন অনেক বেশি থাকে। তখন প্লেয়াররা অনেক বেশি চাপেও থাকে। আমার মিউজিক জীবনেও এমন একটা এক্সট্রা প্রেসার ছিল সব সময়। মানুষের এক্সপেক্টেশন অনেক বেশি ছিল আমাকে নিয়ে।

আপনার মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো অভিমান ও মন খারাপের গল্প আছে। যদিও কখনোই কিছু বলতে চাননি!

কিছুটা অভিমান তো অবশ্যই আছে। আমার আগের উত্তরগুলোতেই আপনি বুঝে যাবেন অভিমানগুলো কোথায় থেকে এসেছে? কিছু জিনিস খুব খারাপ লাগতো। একটা মোমেন্টে গিয়ে আমার পজিশান অনেক ভালো তখন কেউ যদি বলে একটু কম রেটে কাজ করা যায় না! একটু কনসিডার করবেন আমাদের! উল্টা কোথায় আমাদের রেট বাড়ার কথা সেখানে রেট কমানোর কথা বলা হতো। গায়ক গায়িকারা আমাদের সুর করা গান কিংবা আরো আমাদের সময়ের অনেকের সুর করা গান গেয়ে তাদের রেট বাড়াচ্ছে, কিন্তু আমাদের রেট বাড়ে না। অডিও ক্যাসেটের ক্ষেত্রে এটা নিয়ে আমার অভিমান ছিলো। অডিও অ্যালবামের কাজ ২০০৫ সালে ছেড়ে দিয়েছি। ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আমি তিন বছর সঙ্গীতাঙ্গনে কাজ করেছি। তিন বছরে আমি ২৩টি অ্যালবামের কাজ করেছি। ২০১০ সালে একটা অ্যালবামের কাজ করেছিলাম তাও সেটা ছিল নন কমার্শিয়াল অ্যালবাম ‘নিয়ো না পরানে যাতনা’। এরপর ‘কানামাছি মৌমাছি’ অ্যালবাম করেছি। যদিও এগুলো কমার্শিয়ালি হিট করার জন্য করা হয়নি। ভালোলাগা থেকে কাজগুলো করেছিলাম। এমন অভিমানের কথাগুলো কেউ কেউ জানেন। আরো দু’একটি ব্যক্তিগত কারণ আছে। এগুলো একান্তই ব্যক্তিগত। এগুলো না বলি।

আপনার গাওয়া গান নিয়ে কিছু বলেন…

আমি আসলে গায়ক না। তারপরও গান গাওয়ার দুঃসাহস করি। বলা যেতে পারে দীর্ঘ বিরতির পরে ২০২১ সালে ‘বন্ধু’ শিরোনামে একটা গান করি। ২০২২ সালে সংগীতের কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চুকে ট্রিবিউট করে ‘আসা যাওয়া’ শিরোনামে একটা গান করেছিলাম। ওই বছরই ‘স্বাধীন বাংলা  বেতার কেন্দ্র’ গানটি বের হয়, ‘কথা দিলাম’ শিরোনামেও একটা গান করেছিলাম। তার পরের বছর দিঠির সঙ্গে একটা ডুয়েট গান করলাম ‘আমার বাংলাদেশটা’ শিরোনামে। আর আজম খানকে ট্রিবিউট করে একটা গান করলাম ‘গুরু’।

নিজের সুর ও সংগীত করা যে গানগুলো আপনার প্রিয়…

সব গানই আমার কাছে প্রিয়। যে গানগুলো করেছি সব গানই ভালবেসে করেছি। নিজের সুর করা প্রিয় গানের মধ্যে হাসান ভাইকে দিয়ে গাইয়েছিলাম ‘মন ময়না’। হাসান ভাই আরেকটা গান গেয়েছিলেন ‘জানালা’। এটাও আমার খুব পছন্দের একটি গান। ওয়ারফেজের মিজান ভাই একটা গান গেয়েছিলেন ‘আর কারো চোখে আমি দোষী নই’। এটাও আমার খুব প্রিয় একটি গান। জেমস ভাই গেয়েছিলেন ‘আমি তো চলেই যেতাম’ এটাও আমার খুব প্রিয় একটি গান। পান্থকানাই একটা গান গেয়েছিলেন ‘লাগবে না’ শিরোনামে। আরেকটা খুব প্রিয় গান আছে যে গানটি গেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। যেটা প্রথম প্রথম প্রকাশিত আমার অডিও গান ‘এক ঘরের কারণে যে ঘর হারালাম’। উনি আমার খুব পছন্দের মানুষ, ভালোবাসার মানুষ। উনার জন্য এই গানটা করেছিলাম।

যে কাজগুলো করে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন…

এই গানগুলো ছিল ২০০৩-০৪ ওই সময়ের করা। বিপ্লব ভাইয়ের ‘দন্ত্য ন না মুর্ধন্য ণ কোনটা আসল মন’, ‘চান্দের বাতির কসম দিয়া ভালোবাসিলি’ এন্ড্রু কিশোরের ‘বিন্দিয়ারে বিন্দিয়া লাল শাড়ি পিন্দিয়া’। হাসান ভাইয়ের ‘শীত নয় গ্রীষ্ম নয় এসেছে বসন্ত’ অনুরুপ আইচের লেখা। নাজিব আহমেদের লেখা সুরে হাসান ভাইয়ের গাওয়া ‘লাল বন্ধু নীল বন্ধু’। লাল বন্ধু গানটির কথা অনেকেই বলেন এখনো। নান্টু ঘটক গানটির কথা বলেন। বিপ্লব ভাইয়ের ‘তালা চাবি’ গানটিও খুব হিট করেছিল। আরো বেশকিছু গান আছে। আমি কয়েকটা গানের কথাই বললাম।

গুরু আজম খানের সঙ্গে আপনার মজার কোনো স্মৃতি…

ছোটবেলা থেকে তো গুরু আজম খানের সঙ্গেই আমার বেড়ে ওঠা। তার সঙ্গে ছোটবেলার অনেক স্মৃতি আছে। একটার কথা বলি। এটা অনেকেরই অজানা। ১৯৯৮ সালে যখন আমি প্রফেশনালি সংগীত শুরু করি আব্বার সঙ্গে সেই সময়ের কিছু পরের কথা। ১৯৯৯ সালে আমি পরিকল্পনা করলাম আজম চাচ্চুর একটা একক অ্যালবাম করব। বেশ কয়েকটা গান আমি লিখলাম ও সুর করলাম। আজম চাচ্চুকে শোনালাম। ক্যাসেট প্লেয়ারে রেকর্ড করে নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি বলেন, তোমার গানগুলো আমি সবই শুনলাম। দেখো এই ধরনের গান অলরেডি হয়ে গেছে। আমি এ ধরনের গান গেয়ে ফেলেছি। এবং ইন্ডাস্ট্রিতে এ ধরনের গান চলে। তুমি যেহেতু আমার প্রথম একক করতে চাচ্ছ, এখানে এমন গান নাই যেটা মার্কেটে আসার পরে বিস্ফোরণ হবে। ঐরকম গান বানানো তোমাকে শিখতে হবে। তখন ফ্রান্সে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে। উনি বললেন, ফ্রান্স ওয়ার্ল্ড কাপে রিকি মার্টিন একটা গান করেছে তুমি শুনেছো? আমি বললাম, শুনেছি। উনি বললেন, ওই গানটির মধ্যে কিন্তু নতুনত্ব আছে। আমি তোমাকে নতুনত্বের একটা ধারা বুঝাইলাম। তুমি নতুন কিছু করো। নতুন ধরনের জিনিস সবসময় মানুষকে আকর্ষণ করবে। মনে রাখবা প্রথম ক্যাসেট যেটাই করো, আমার করো, আর অন্য কারো করো ওইটা যদি মার্কেটে তুমি হিট করাতে না পারো তাহলে মার্কেটে গান হিট করাতে ১০ বছর লাগবে। এই কথাটা আমার অনেক ভালো লেগেছিল। যে কারণে বিপ্লব ভাইয়ের অংক নামের ক্যাসেটটির জন্য ‘দন্ত্য ন না মূর্ধন্য ণ’ গানটি খুব চিন্তাভাবনা করেই  করি। গানটি তুমুল হিট হয়েছিল। আজম চাচ্চু বলেছিলেন, নতুন কিছু নিয়ে মার্কেটে আসতে হবে, এমন কিছু নিয়ে আসতে হবে যেন গানটা মানুষের মধ্যে একটা সাইরেন বাজায় দেয়। এ কথাগুলো আমার খুব মনে পড়ে।

বাবার কোন উপদেশ সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?

আব্বার যে উপদেশ সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তা হচ্ছে- মানুষকে ঠকায়ো না। মানুষকে কথা দিলে কথা রাখার চেষ্টা করবা। লেনদেন করতে গেলে দরকার হলে এক পয়সা কম নিও কিন্তু কাউকে কম দিবা না। সবকিছুতেই সৎ থাকতে হবে। অসততা একেবারেই করা যাবে না। কমিটমেন্ট ঠিক রাখতে হবে। মানুষের সঙ্গে কখনো দুর্ব্যবহার করবা না। যাকে ভালো লাগবে না তার থেকে দূরে চলে যাবা। কিন্তু কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না। বাবার কথা মনে করেই কারো সঙ্গে দুর্ব্যবহার করিনি। অনেকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে পারতাম। অভিমান করে সংগীত থেকে সরে এসেছি।

আপনার পরিবার নিয়ে কিছু বলুন…

আমার স্ত্রী এমি খান। তার সঙ্গে সংসার জীবন বিশ বছর হলো। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের নাম আরহাম খান। ও এ লেভেল দিচ্ছে সামনে। মেয়ে আনতা রাইসা খান। ও ক্লাস এইটে পড়ে। ওরা বাংলাদেশের খুব স্বনামধন্য স্কুল সানবিম ও সানিডেলে পড়ে। ওরাও সংগীত ভালোবাসে।

নতুন শিল্পী ও সংগীত পরিচালকদের কী বলতে চান?

গান বাজনা শিখতে হয়। গান শুনে শুনে একটা গান তৈরি করে বেশিদিন টেকা যায় না। আপনাকে নতুন কিছু একটা সৃষ্টি করতে হবে। নতুন কিছু করতে হলে, সংগীত পরিচালক হতে হলে রাগ ঠাটসহ বিভিন্ন তাল সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। কিংবা তার সাথে কম্পোজিশন করার ক্ষেত্রে ভালো সফটওয়্যার ইউজ করা, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে হবে। গায়ক গায়িকাকে অবশ্যই প্রতিদিন সকাল বেলায় উঠে রেওয়াজ করতে হবে। এটা করতেই হবে। রেওয়াজ না করলেও চলবে, তবে কিছুদিন চলবে, বেশিদিন চলবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো – নিজের মধ্যে একটা মৌলিকত্ব থাকতে হবে। আমি যেটা করবো সেটা জেনুইন, যেটা আগে হয়নি। অমুক শিল্পী একটা কিছু করেছে আমি ওই শিল্পীর মতো আরেকটা কিছু করব এরকম ফলো করে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। বাংলা গানের কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমন কথার ওপর গান করতে হবে যে কথা খুব সহজে মানুষ বুঝতে পারে। অনেক কাব্য গানে কিন্তু কিছুই বুঝলাম না, মাথার ওপর দিয়ে চলে গেলো; ওই গান টিকবে না। কারণ বাংলাদেশের মাটি খুব নরম। এদেশের মানুষ যে গান শুনে এটা আমাদের ভাগ্য। অনেক দেশ আছে যেসব দেশের মানুষ গানই শোনে না।

সংগীত পরিচালক হতে চাইলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে বাংলাদেশে? তার আসলে করণীয় কী?

বাংলাদেশে সংগীত পরিচালনা শেখানোর মতো কোনো ইনস্টিটিউট এখন পর্যন্ত আমার জানা মতে তৈরি হয়নি। তবে সংগীত শিক্ষার অনেক ইনস্টিটিউশন আছে। সংগীত পরিচালনা আসলে কাউকে শেখানো যায় না। এটা শিখতে হয়। বিভিন্ন সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করলে পরিচালনা শেখা যায়। বলে বলে এটা শেখানো যায় না। যারা সংগীত পরিচালক হতে চায়, তাদের উচিত ভালো সংগীত পরিচালকের সঙ্গে লেগে থাকা এবং কাজ শেখা। শিখতে চেষ্টা করা। তাহলে তারা সংগীত পরিচালনা জিনিসটা কি সেটা বুঝতে পারবে। পরে নিজের মতো করে মৌলিক জিনিস তৈরি করা শিখতে হবে। যেমন আমার বাবা আলম খান উনি কিন্তু আগে সংগীত পরিচালক কিংবদন্তি রবিন ঘোষের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন, সত্য সাহা আঙ্কেলের সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন, খান আতাউর রহমানের সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন, পাশাপাশি নিজের মৌলিক গান নিজের মতো করে তৈরি করে এসেছেন। আমিও সেইম। আমি আমার বাবার সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করেছি তিন চার বছর। পরে আমি আমার মতো করে গান বানিয়েছি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আমার বাবার সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। তারপর তিনি নিজেই সক্রিয় হয়েছেন এবং নিজেই সুরের মূর্চ্ছনায় মানুষকে পাগল করেছেন। সুতরাং সংগীত পরিচালকদের সাথে কাজ করা জরুরি, যদি সুযোগ থাকে। অথবা সংগীতের গ্রামার জেনে তারপর সংগীত পরিচালনায় নামা উচিত। সংগীত পরিচালনা সহজ নয়, এটা অনেক বিশাল ব্যাপার।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সুরের মূর্চ্ছনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

6 + 9 =