সবুজ জ্বালানি বিকাশে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

সালেক সুফী

কার্বন দূষণ এবং গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের কারণে বৈষয়িক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ ২০৫০ নাগাদ নেট জিরো অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকার প্রধান নিজেই বিশ্বমঞ্চে ২০৪১ নাগাদ ৬০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্ষমতা অর্জনে ৪০% নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ অবদানের লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ইন্টিগ্রেটেড পাওয়ার, এনার্জি মাস্টার প্ল্যান ২০২৩ (আইপিএমপি ২০২৩) অনুমোদন করেছে সেখানে ২০৪১ প্রক্ষেপিত বিদ্যুৎ ক্ষমতার ৪০% গ্রিন এনার্জি থেকে অর্জনের কথা বলা আছে।

আইপিএমপি অন্তর্ভুক্ত লক্ষ্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, মুজিব পার্সপেক্টিভ প্ল্যান এবং ডেল্টা প্লানের অসঙ্গতি রয়েছে। বিশ্বজুড়ে এখন জলবিদ্যুৎ এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেও গ্রিন এনার্জির অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ২০২৪ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো মূলত ফসিল ফুয়েল নির্ভর। এখান থেকে গ্রিন এনার্জিতে রূপান্তরের পথে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের কার্বন দূষণ ফুটপ্রিন্ট অতিশয় নগণ্য।  বাংলাদেশের কিন্তু নিজস্ব দূষণ কমানোর কোন দায় নেই।

কিন্তু বাংলাদেশ বৈশ্বিক দূষণের অন্যতম প্রধান শিকার। প্রতিবছর অতিবৃষ্টি, অকাল বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের জান মালের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে আবহাওয়া উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।  বাংলাদেশকে তাই অবশ্যই যথাসম্ভব দ্রুত জ্বালানি রূপান্তর করতে হবে। এইপথে নীতি এবং নীতিগুলো বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ সমূহ গভীর ভাবে পর্যালোচনা করে কার্যকরী পথ নকশা প্রণয়ন করে এগুতে হবে। কাজটি বলা যত সহজ বাস্তবায়ন কিন্তু তত সহজ এবং মসৃণ নয়।

মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের কিন্তু নিজস্ব উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উন্নত মানের কয়লাসম্পদ এবং জলে স্থলে এখনো বিপুল পরিমাণ পেট্রোলিয়াম সম্পদ আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো পরিবেশ সম্মত উপায়ে আহরণ, উত্তোলন এবং কাজে লাগানোর পাশাপাশি বাংলাদেশকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি-সৌর বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে।  বাংলাদেশে একমাত্র কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া জলবিদ্যুৎ সম্প্রসারণের সুযোগ নেই।

ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশের সূর্যকিরণ রেডিয়েশন কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বা ভারতের মতো না। বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনাও সীমিত এবং মূলত উপকূল এলাকা, সাগরে সীমিত। দেশে পাবনার রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০২৫ নাগাদ পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদনে আসতে পারে। বাংলাদেশ অবশ্য দীর্ঘদিন নেপাল, ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির চেষ্টা করেও এযাবৎ সফল হয়নি। তবে অচিরে এই সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি ভারত থেকে সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুৎ আমদানির কথাও বিবেচনাধীন রয়েছে।

মনে রাখতে হবে বাংলাদেশকে জ্বালানি বিদ্যুৎ বিষয়ে রূপান্তরের দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা করতে হলে নিজেদের আর্থিক, কারিগরি সক্ষমতার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে, সকল উদ্যোগের ঝুঁকি বিবেচনায় নিতে হবে, ভোক্তাদের আর্থিক সঙ্গতির কথা ভাবতে হবে। এই কাজ=গুলো সঠিক ভাবে না করে বাংলাদেশে কিন্তু এখন তীব্র জ্বালানি সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও বিদ্যুৎ সংকটের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ।

গ্রিন এনার্জি ট্রানসিশনের ক্ষেত্রে নীতিমালা সমূহের অসামঞ্জস্য দূর করে একক বাস্তবায়ন যোগ্য নীতি প্রণয়ন অত্যাবশ্যক। এটি করার পর বাস্তবায়নযোগ্য করে পেশাদারি পথে এগুতে হবে। বাংলাদেশে বড় ধরনের গ্রিড সংযুক্ত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রধান সংকট জমির প্রাপ্যতা এবং জমি অধিগ্রহণে জটিলতা।  এই ক্ষেত্রে ফসিল ফুয়েল নির্ভর আইপিপিগুলোর মতো সরকার উদ্যোগী হয়ে জমি অধিগ্রহণ করে, উন্নয়নের পর আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের কাছে লিজ প্রদান করলে সমস্যার সমাধান হবে।

এছাড়া উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রিডে সংযুক্তির জন্য সরকারের উচিত হবে অবকাঠামো গড়ে তোলা। আরেকটি সমস্যা হলো উদ্যোক্তা নির্বাচনে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডারিং না করে উদ্যোক্তাদের অযাচিত প্রস্তাবের ভিত্তিতে চুক্তি করা। এই সব কারণে সৌর বিদ্যুতের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন খরচ ফসিল ফুয়েল ভিত্তিক বিদ্যুতের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। এই বাধাগুলো দূর করার পাশাপাশি সরকার উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রাপ্তিতে সহায়তা দিলে ৫ বছরের মধ্যে সৌরবিদ্যুতের অবদান অনেক বৃদ্ধি পাবে।

সৌর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে আরেকটি বিশাল সুযোগ রুফ টপ সোলার, সোলার ইরিগেশন এবং ফ্লোটিং সোলার। রুফটপ সোলারের ক্ষেত্রে নেট মিটারিং চালু হওয়ায় নতুন সুযোগ এসেছে। তবে রুফটপ সোলারের ক্ষেত্রে বড় বাধা সোলার প্যানেল, ইনভার্টার এবং ব্যাটারি আমদানির উপর বিশাল শুল্ক, কর। সরকার সৌর বিদ্যুতের সম্প্রসারণ বিষয়ে আন্তরিক থাকলে শুল্ক কর সম্পূর্ণ পরিহার অথবা উল্লেখযোগ্য হারে কমানো উচিত।

একই সঙ্গে রূপ টপ সোলার বিশেষত শিল্পকারখানা গুলোর ছাদের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ গ্রিডে সঞ্চালনার ক্ষেত্রে কিছু কারিগরি বাধা নেট মিটারিং নীতি সংশোধনের মাধ্যমে দূর করা যেতে পারে। সোলার ইরিগেশনের ক্ষেত্রে মূল বাধা সেচ মৌসুমের বাইরে এই বিদ্যুৎ গ্রিডে সঞ্চালন। এই ক্ষেত্রে আরো প্রয়োজন একটি বাণিজ্যিক মডেল প্রণয়ন করে প্রণোদনা দিয়ে উদ্যোক্তাদের আকর্ষণ। ফ্লোটিং সোলারের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

এখন পর্যন্ত বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা খুব একটা প্রমাণিত নয়। কক্সবাজারের কুরুশকুলে ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি উইন্ড মিল আংশিক ভাবে চালু হয়েছে। অফশোর উইন্ড সম্ভাবনা নিয়ে জরিপ চলছে। খুব বেশি না হলেও বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের উপকূল এলাকা এবং সাগরে। সাম্প্রতিক সময়ে মাইক্রো টারবাইন এবং হাইব্রিড (সোলার+উইন্ড) বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। বাংলাদেশ ভেবে দেখতে পারে।

সবশেষে আসি বিদ্যুৎ গ্রিডের সক্ষমতা নিয়ে। বিদ্যমান অবস্থায় বিদ্যমান গ্রিডের যথাপ্রযোজ্য সংস্কার করা না হলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ এবং ভ্যারিয়েবল রিনিউবেল বিদ্যুৎ গ্রহণে সীমাবদ্ধতা থাকবে। সকল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রকে অবশ্যই এফজিএমও স্থাপন করে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। পিক লোড মানাজেমেন্টের ক্ষেত্রে পিকিং প্লান্ট ব্যবহার পরিহার করে ভ্যারিয়েবল বেজ লোড ব্যাবস্থায় যেতে হবে।

সবশেষে বলি বাংলাদেশকে অবশ্যই গ্রিন এনার্জি সম্প্রসারণে যেতে হবে। তবে এই ক্ষেত্রে ভাবাবেগে তাড়িত না হয়ে বাস্তবসম্মত এবং বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে সঠিক পেশাদারদের দায়িত্ব দিতে হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen + ten =