বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম পেশাজীবীরা সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারের বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি বিশ্বব্যাপী সমন্বিত নীতিমালার প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে নৈতিক মান এবং সংবাদ প্রতিবেদনের ওপর জনসাধারণের আস্থা বজায় রাখা যায়। খবর বাসস।
সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে বিশ্ব সাংবাদিক সম্মেলন ২০২৫ অনুষ্ঠান কালে এই আহ্বান জানানো হয়। এই সম্মেলনে ৫৩টি দেশের ৬২ জন সাংবাদিক অংশগ্রহন করেন।
কোরিয়ার সাংবাদিক সমিতি আয়োজিত বার্ষিক এই অনুষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের সামনে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগগুলো নিয়ে বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর আলোচনা করার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স অ্যান্ড এডিটরস (আইআরই)-এর নির্বাহী পরিচালক ডায়ানা ফুয়েন্তেস বলেছেন, সাংবাদিকতা পেশাকে উন্নত করার জন্য এআই শক্তিশালী হাতিয়ার হলেও মানুষের তদারকি অপরিহার্য।
তিনি একটি প্যানেল আলোচনার সময় বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি এআই-এর সর্বোত্তম পন্থা হল মনোমুগ্ধকর সম্ভাবনাগুলো খুঁজে বের করার সাথে সাথে সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করতে শেখা এবং নীতিশাস্ত্রকে সর্বাগ্রে রাখা। এসবের সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ত থাকা প্রয়োজন।’
ফুয়েন্তেস নিউজ রুমগুলোতে এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন।
ফুয়েন্তেস আরো বলেছেন, ‘যখন কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা, পোস্ট করা বা সম্প্রচার করা হয়, তখন সংবাদমাধ্যমের উচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল সে সম্পর্কে সরল ভাষায় একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া।’
তিনি উল্লেখ করেছেন, বিশ্বাস অর্জন করা কঠিন কিন্তু হারানো সহজ এবং সংবাদমাধ্যমগুলোকে রিপোর্টিংয়ে এআই-এর সম্পৃক্ততার বিষয়ে স্বচ্ছ হতে হবে।
একই রকম উদ্বেগের পুনরুক্তি করে কোরিয়ার ‘বুসান ডেইলি নিউজের’ একজন সংবাদকর্মী লেখক হোয়াং সিওক-হা সতর্ক করে বলেছেন, সংবাদ সামগ্রীর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অননুমোদিত ব্যবহার মিডিয়া কপিরাইট এবং আর্থিক স্থায়িত্বের জন্য গুরুতর হুমকি।
তিনি আরো বলেছেন, ‘স্পষ্ট আইনি সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া সাংবাদিকতার স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়ার ঝুঁকি বেশি’, ‘এআই যখন সংবাদ নিবন্ধগুলো প্রশিক্ষণ দেয় এবং ব্যবহার করে তখন ন্যায্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
কোরিয়া জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পার্ক ইয়ং-হিউন তার উদ্বোধনী ভাষণে বিভ্রান্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বৈত চ্যালেঞ্জের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, এই বিষয়গুলো বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
তিনি বলেছেন, ‘সাংবাদিকতাকে অবশ্যই তার নৈতিক মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় খাপ খাইয়ে নিতে হবে এবং নেতৃত্ব দিতে হবে।’
সম্মেলনের উদ্বোধনকালে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় পরিষদের সভাপতি উ ওন শিক ও এই উদ্বেগের পুনরুক্তি করেছেন, ভুয়া সংবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি সতর্ক এবং স্বচ্ছ গণমাধ্যমের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন, যাকে তিনি বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
সংবাদ কক্ষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ছিল সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা উল্লেখ করেছেন, ডেটা বিশ্লেষণ এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবাদ তৈরি থেকে শুরু করে দর্শকদের সম্পৃক্ততা পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মিডিয়া কর্মপ্রবাহে ক্রমবর্ধমানভাবে একীভূত করা হচ্ছে।
তবে, সর্বসম্মত ভাবে তারা একমত যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সাংবাদিকতার মানবিক উপাদানগুলোর পরিপূরক হতে হবে, প্রতিস্থাপন নয়।
পোলিশ সাংবাদিক নাতালিয়া সেভজাক, যার রিপোর্টিংয়ের ওপর ভিত্তি করে পোল্যান্ডের মাতৃত্বকালীন ছুটি নীতিতে উল্লেখযোগ্য সংস্কার এনেছে। তিনি তার ব্যক্তিগত সুক্ষদৃষ্টি বিনিময় করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এআই তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে এবং তথ্যের সংক্ষিপ্তসার করতে পারে।’ ‘কিন্তু এটি মানুষের অভিজ্ঞতার সূক্ষ্মতা বা অন্যায়কে চ্যালেঞ্জ করার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। এখানেই মানব সাংবাদিকরা অপরিবর্তনীয় থেকে যান।’
সম্মেলনে বক্তারা বিশেষ করে দ্রুত উৎপন্ন কৃত্রিম সামগ্রীর যুগে দৃঢ় নৈতিক মানদণ্ডের গুরুত্ব এবং বিভ্রান্তি মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এআই মডেল প্রশিক্ষণে সাংবাদিকতা সংক্রান্ত বিষয়বস্তু ব্যবহারের জন্য গণমাধ্যম সংস্থাগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বাধ্যবাধকতা থাকা।
অংশগ্রহণকারীরা এই ক্ষেত্রে ন্যায্য অনুশীলন নিশ্চিত করার জন্য ব্যাপক বৈশ্বিক নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
এআই-এর বাইরেও সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সংবাদ কভার করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা খুঁজে বের করা হয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সমস্যা যা টেকসই, নির্ভুল এবং প্রভাবশালী প্রতিবেদনে দাবি করেছে।
সপ্তাহব্যাপী সম্মেলনের সমাপ্তির সাথে সাথে প্রতিনিধিরা সীমান্তজুড়ে গণমাধ্যম পেশাদারদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যের জন্য একটি যৌথ আবেদন জারি করেন। যাতে তারা অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে এবং সাংবাদিকতার অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারেন।’
একজন প্রতিনিধি উল্লেখ করেছেন, ‘তথ্যে ভরা পৃথিবীতে’ ‘সাংবাদিকতাকে সাহস, সততা এবং দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে।’
অংশগ্রহণকারীরা সর্বসম্মত ভাবে একমত হয়েছেন যে মিডিয়া শিল্প যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রূপান্তরমূলক প্রবাহের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তখন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং নীতিগত সাংবাদিকতার মূল্যবোধগুলোকে এর মূলে রাখতে হবে।