সাগরবধূ কক্সবাজার আর নারিকেল জিঞ্জিরায় চার দিন

সালেক সুফী

(দ্বিতীয় পর্ব)

বর্তমান সময়ে সম্পাদিত মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেল যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে পর্যটননগরী কক্সবাজারকে সারা দেশের সঙ্গে সংযুক্ত করা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। একসময় রেল লাইনটি টেকনাফ-মায়ানমার হয়ে চীনের সঙ্গে সংযুক্তির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আছে। জানতাম আমাদের বুয়েট অনুজ প্রকৌশলি গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরের প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপ অন্যান মেগা প্রকল্পসহ চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ বিষয়ে সম্পৃক্ত।  এবারের বাংলাদেশ সফরের শুরুতেই কক্সবাজার  পরিদর্শন এবং কক্সসবাজার নান্দনিক রেলস্টেশন পরিদর্শনের পরিকল্পনা করি।

জানতে পারি আমাদের পরিদর্শনকালে কক্সবাজার প্রকল্পের ম্যাক্স গ্রুপের প্রকল্প ব্যাবস্থাপক বুয়েট অনুজ কেমিকৌসুলি সুফী  থাকবেন। মাতারবাড়ি পরিদর্শন শেষে কক্সবাজার ফিরে আমরা সরাসরি কক্সবাজার স্টেশন পরিদর্শনে যাই। ঝিনুকের আদলে তৈরি  নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর স্টেশন এককথায় বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক। রেল স্টেশন  দর্শনীয় স্থাপনাটির বহিরাঙ্গনে সবুজ চত্বর গড়ে তুলতে হলে যে জনসচেতনা প্রয়োজন শুরুতেই অনুভব করলাম।

সুফী এবং তার সহকর্মীরা আমাদের অডিও ভিজ্যুয়াল প্রেজেনটেশনের মাধ্যমে স্টেশন ডিজাইন, নির্মাণ শৈলী, বিশেষ নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার বিষয়ে অবহিত করলো। বহুতল বিশিষ্ট স্টেশন স্থাপনায় বাণিজ্য বিতান , হেলথ ক্লাব, রেস্টুরেন্ট, বিশ্রামাগার, ইনডোর গেম্স্ সুবিধা থাকবে। পর্যটকরা  ঢাকা চট্টগ্রাম থেকে রেলযোগে রাতের ট্রেনে এসে লকারে লাগেজ রেখে সারাদিন সাগর উপকূলে কাটিয়ে রাতের ট্রেনে আবার ফিরতে পারবে। আমাদের সাথে থাকা দুইজন স্থপতি এবং দুইজন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার স্থাপনাটির বিশেষ স্থাপত্য শৈলী দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।

দিনশেষে আমরা কক্সবাজারে পিএসএলের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা খন্দকার মাহমুদুল হক রাসেলের বাসায় ডিনার করলাম। রাসেল দম্পতি নানা ধরনের সুস্বাদু কক্সবাজারের মাছ মিষ্টি দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করে। সন্ধ্যায় আধুনিক কক্সবাজারের মোহনীয় রূপ আমাদের মুগ্ধ করে।

৩১ জানুয়ারী ২০২৪

নির্ধারিত ছিল খুব সকালে ৭-০০টায়  আমরা সড়কপথে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাবো। গ্রুপের মূল দল ঢাকা থেকে সড়ক পথে সরাসরি ভোররাতেই টেকনাফ পৌঁছে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আরেকটি দল পৃথকভাবে সেখানে পৌঁছে।  কক্সবাজার থেকে টেকনাফের পথে আমরা মেরিন ড্রাইভ দিয়ে যাত্রাকালে আমরা একদিকে বিস্তীর্ণ বে অফ বেঙ্গল বালুচর অপরদিকে সবুজ পাহাড়ের বাহারী রূপে মুগ্ধ হই। পথিমধ্যে সেই কুখ্যাত স্থান যেখানে মেধাবী সেনা অফিসার মেজর (অব) সিনহাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সেখানে দাঁড়াই।  সিনহা আমার ছেলে শাহরিয়ার শুভ্রর সহপাঠী ছিল। আশা করি হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ দ্রুত শেষ করে হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। টেকনাফ পৌঁছতে ২:৩০ ঘণ্টা লেগে যায়।

সাব্বির, তানভীর, শুভরা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে সমগ্র পরিকল্পনা করায় কোনোক্ষেত্রেই কোনো সমস্যা হয়নি। সামান্য সময় বিরতিতে আমরা জাহাজ টার্মিনাল সংলগ্ন টংঘরে চা নাস্তা করে ‘কেয়ারী সিন্দাবাদ’ জাহাজে আরোহন করি। আমাদের দলে কিছু পরিবারসহ ৮২ জন  ছিলাম। পিএসএলের বিশেষ ডিজাইনের শার্ট পরা প্রাণচ্ছল ছেলেরা পুরো যাত্রার সময় গানে গানে মাতিয়ে রাখে সবাইকে। বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্ত নদী নাফ দিয়ে এই উপভোগ্য সেন্ট মার্টিন যাত্রা দীর্ঘদিন মনে থাকবে।  বিশেষত আমাদের সঙ্গী হতে ব্যাকুল গাংচিল গুলোর স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ ছিল চোখ চেয়ে দেখার মতো।

দুঃখজনক হলেও রোহিঙ্গা সমস্যাৰ কারণে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক এখন শীতল। সংঘর্ষ চলছে সীমান্তের ওপারে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান বিদ্রোহীদের। যার আঁচ পড়েছে এপারেও। প্রকৃতপক্ষে বন্ধ হয়ে গেছে এখন টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন  নদীপথে   যাত্রা।  অথচ দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে সৎভাব থাকলে এই অঞ্চলের সম্পদ যৌথভাবে আহরণ করে দুটি দেশ সমৃদ্ধ হতে পারে।  যাহোক যথা সময়ে সেন্ট মার্টিন পৌঁছলাম। আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল দ্বীপের সেরা ব্লু ওশান রিসোর্টে।

জমজমাট প্রবাল দ্বীপ, লোকে লোকারণ্য। সামান্য বিশ্রামের পর দুপুরের  খাবার।  আমার রুম সঙ্গী ছিল পেট্রোবাংলার প্রাক্তন সহকর্মী পরিচালক (অব) পিসিডি প্রকৌশলি মাহবুব সরওয়ার। সামুদ্রিক মাছ সহযোগে দুপুরের খাবার ছিল উপাদেয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সবাই ছুটলাম সাগর কূলে।  দেখলাম অযত্ন অবহেলায় অনেক প্রবালের অপমৃত্যু।  বিকেলের প্রাণবন্ত পরিবেশে সূর্যাস্ত দেখার সময়   জীবনের গোধূলি বেলা স্মরণে আসলো। একজন পরিদর্শকের কাছ থেকে নিয়ে রঙিন ঘুড়ি উড়ালাম।

অস্তগামী সূর্য দেখে জীবন সায়াহ্নের কথা মনে পড়লো। জীবনে অনেক সাগর কূলে সূর্যাস্ত দেখেছি। প্রশান্ত মহাসাগর, দক্ষিণ মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগরে সূর্যাস্ত দেখেছি। কক্সবাজার, কুয়াকাটা উপকূলেও সূর্য অস্ত দেখার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখা সূর্যাস্ত দীর্ঘদিন মনে থাকবে। সেন্ট মার্টিন উপকূলে পর্যটনবান্ধব ব্যবস্থা উন্নয়নের অনেক সুযোগ আছে। কোস্ট গার্ড, বিচ পুলিশ আরো তৎপর হলে প্রবালগুলো সংরক্ষিত থাকবে।

সন্ধ্যায় আয়োজন হলো হাউজি। সাব্বিরের সঙ্গে আমি জকির দায়িত্ত্ব পালন করলাম। রাতের খাবারটিও ছিল উপভোগ্য। পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে রাতে আর বের হইনি। যদিও সন্ধ্যার পর জমজমাট সেন্ট মার্টিন ছিল উৎসবের দ্বীপ। বলে রাখা প্রয়োজন দ্বীপে বিদ্যুৎ উৎস মূলত সোলার। কিছু ডিজেল চালিত জেনারেটার থাকলেও রাত ১২-০০টা থেকে সকাল পর্যন্ত প্রায় বিদ্যুৎহীন থাকে দ্বীপটি। দ্বীপে সৌর এবং বায়ুবিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের যথেষ্ট সুযোগ আছে। দ্বীপটিকে পলিথিন মুক্ত ঘোষণা করে নিবিড় মনিটরিং করা যায়। সবার উচিত একসময়ের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে তোলা নারকেল জিঞ্জিরার স্বকীয়তা বজায় রাখতে সহায়তা করা। (চলবে)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

six − 4 =