সাগর বধূ কক্সবাজার এবং নারকেল জিঞ্জিরায় চার দিন

সালেক সুফী

চতুর্থ পর্ব

লেখাটা প্রায় শেষ হয়ে এলো বলাই হলো না শিরোনাম নিয়ে কিছু কথা। বঙ্গোপসাগর তীরে কক্সবাজার অবশ্যই সাগর বধূ। এখানে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নয়নাভিরাম সাগর তীর। সমতল এই সাগর তীরের একদিকে উত্তাল সাগর অন্যদিকে সবুজ সুউচ্চ পাহাড়। কক্সবাজার সাগর তীরে মেরিন ড্রাইভ অনেকটা গোল্ড কোস্টের পাশে বিরাজমান প্যাসিফিক মোটরওয়ের মত। ইদানিং নানা ধরনের মেগা স্থাপনা নির্মাণে কক্সবাজারকে সারা দেশের সঙ্গে সড়ক, রেল, বিমান পথে সংযুক্ত করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ এবং কক্সবাজারে ঝিনুকের অবয়বে দৃষ্টিনন্দন রেল স্টেশন নির্মাণ উল্লেখযোগ্য সংযোজন। সাগরের বুকে রানওয়ে বিস্তৃত করে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে এখন আধুনিকরূপে গড়ে তোলা হচ্ছে। কক্সবাজারের মহেশখালী-মাতারবাড়ি রূপান্তরিত হচ্ছে বিদ্যুৎ জ্বালানি হাব হিসাবে। এখানে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩০০ মিটার প্রস্থ, ১৮.৫ গভীর কৃত্রিম সংযোগ খাল নির্মাণ করে মাতারবাড়ি বন্দরকে গভীর সমুদ্রবন্দরে রূপান্তর করা হয়েছে।

জাপার সরকারের আর্থিক সহায়তায়  ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে কোল পোর্ট, আমদানিকৃত কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, স্থাপিত হবে ল্যান্ড বেসড এলএনজি টার্মিনাল, এলপিজি টার্মিনাল। হয়তো নির্মাণ করা হবে তেল শোধনাগার। মাতারবাড়ি অনতিবিলম্বে পরিণত হবে এতদঞ্চলে অন্যতম ব্যস্ত গভীর সমুদ্রবন্দর হিসাবে।

নানা আকর্ষণের কারণে কক্সবাজার দেশ বিদেশি পর্যটকদের জন্য প্রিয়। তবে আবাসন সুবিধা অধিকতর আধুনিক এবং পর্যটনবান্ধব করার সুযোগ আছে। অপরিকল্পিত বহুতল ভবন নির্মাণ করে স্বাভাবিক বায়ু প্রবাহ যেন বাধাগ্রস্থ না হয় নজর দেওয়া প্রয়োজন।

ক্রীড়া প্রেমিক হিসেবে সুপারিশ করবো শেখ কামাল স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার।  এখানে বিপিএল সহ অন্যান্ন দ্বিপাক্ষিক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এবং ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠান সহ প্রতিবছর ডিসেম্বর জানুয়ারী মাসে ক্রীড়া উৎসব হতে পারে।  কক্সবাজারে গড়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক মানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। মোট কথা পর্যটন সুবিধা বিকাশ ঘটিয়ে কক্সবাজার অচিরেই হতে পারে এতদঅঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন শহর।

ইতিমধ্যে মেরিন ড্রাইভের পাশে গড়ে উঠছে নানা স্থাপনা। লক্ষ্য রাখতে হবে  নানা বাণিজ্যিক স্থাপনায় যেন কক্সবাজার স্বকীয়তা না হারায়। অবশ্য বিপুল সংখ্যায় রোহিঙ্গা আগমন বিশাল চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। আশা করা যায় বন্ধু দেশগুলোর সহায়তায় অচিরে রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন হবে।

কক্সবাজারের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন যাকে নারকেল গাছের আধিক্যের কারণে নারকেল জিঞ্জিরা নামে ডাকা হয়। অনেকে আদর করে দারুচিনি দ্বীপ বলেন। কথিত আছে একবার সামুদ্রিক ঝড়ে নাকি দারুচিনি জাহাজ ডুবি হয়েছিল এখানে।  বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত সীমিত পরিসরের সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশ মায়ানমার বিভক্ত করা নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফ থেকে নদীপথে যেতে সুবিধা।  চাইলে কক্সবাজার থেকেও সরাসরি যাওয়া যায়।

প্রবাল দ্বীপের সাগর বেলাভূমি  সমতল।  সূর্যোদয় এবং সুর্যাস্ত দেখার আদর্শ স্থান।  তবে প্রবালগুলোর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পরিব্রাজকদের আরো সচেতন আর সতর্কতার প্রয়োজন আছে।  প্রতিবছর অসংখ্য দেশি পর্যটক সেন্ট মার্টিন সফর করে। পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা আছে। কিছুটা আধুনিকায়নের সুযোগ আছে।

সেন্ট মার্টিন জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের আওতায় না থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ডিজেল নির্ভর অথবা সীমিত আকারে সৌরবিদ্যুৎ নির্ভর। তবে উপকূল  জুড়ে বায়ু বিদ্যুৎ এবং বায়ু-সৌর হাইব্রিড বিদ্যুতের সুযোগ আছে। পরিব্রাজকরা শুঁটকি সহ নানা উপহার সামগ্রী ক্রয় করতে পারেন এখান থেকে মোটামুটি সুলভ মূল্যে।

সন্ধ্যায় সেন্ট মার্টিনকে অনেকটা ইন্দোনেশিয়ার বালী দ্বীপের মতো মনে হয়। তবে কিছু নির্দোষ বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলে সেন্ট মার্টিনকে আরো আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার সুযোগ আছে। সেন্ট মার্টিনের সুখ দুঃখ অনেকটাই সর্ব দক্ষিণের তিনটি বিচ্ছিন্ন ছেড়াদিয়া দ্বীপাঞ্চল নিয়ে।  জোয়ারে সংযোগ বিচ্ছিন্ন, ভাটায় জেগে ওঠা ছেড়া দ্বীপে সরকারী ভাবে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হলেও কেউ মানে না। বিশ্বায়নের এই যুগে ডাইক নির্মাণ করে দীপাঞ্চলটিকে বিকশিত করা যায় কি না দেখা যেতে পারে। তবে অবশ্যই ছেড়া দ্বীপের প্রবালগুলো রক্ষায় পরিদর্শন নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।

সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফ হয়ে কক্সবাজার ফেরা

দুই দিনের অবিস্মরণীয় সেন্ট মার্টিন সফর শেষে ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কেয়ারী সিন্দাবাদ যোগে পুরো পিএসএল দল কক্সবাজার ফেরত আসি। ফিরতি পথে নাফ নদীর দুই পাড়ে বাংলাদেশ এবং মায়ানমার দুই প্রতিবেশী দেশের  পারস্পরিক সহযোগিতার অপরিহার্যতা আবারো গভীর ভাবে চিন্তায় আসে। ভুরাজনীতির অশুভ প্রভাবে দুটি দেশ এতদঅঞ্চনের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে উন্নত দেশে পরিণত হবার সুযোগ হারাচ্ছে।

আশা করি এতদঅঞ্চলের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ এবং মায়ানমার সরকার সঠিক উপলব্ধি থেকে বিষয়টি অনুধাবন করবে। বন্ধু দেশগুলো স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। ফিরতি পথে শুনলাম সীমান্তের ওপারে যুদ্ধ চলছে। গোলাবারুদ সীমান্ত পেরিয়ে এপারে আসছে।

টেকনাফ পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে আসলো।  রাতের আঁধারে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার যেতে হবে। জনৈক বন্ধু মোবাইলে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়ায় সারাপথে চালককে নিয়ন্ত্রণে রেখে নিরাপদে কক্সবাজার পৌঁছলাম। ৮২ জনের পুরো দল এবার মাঝারি একই হোটেলে অবস্থান করলাম।  রাতের খাবার একই সঙ্গে খেলাম।

আমার আহত বাম পায়ের ক্ষত কষ্ট দিচ্ছিল।  ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাইনি পায়ে কখন কাচের গুঁড়া ঢুকে আছে। অস্ট্রেলিয়ায় আসার পরে প্রেসার ব্যান্ডেজের কল্যাণে কাচের গুঁড়াটি বেরিয়ে আসে।

৩ ফেব্রুয়ারি সকালে আমাদের বিমান যোগে ফিরে যেতে হবে।  প্রাতঃরাশের পর আমরা বিদায়ী সভায় মিলিত হলাম। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই চার দিনের কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন সফর ছিল অত্যন্ত কুশলী পরিকল্পনার সফল আয়োজন। ৮২ জনের বিশাল গ্রুপ অপূর্ব সহমর্মিতার  সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে প্রতিটি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছে। সাব্বির, তানভীর, শুভ, আজিজা সহ সবাইকে প্রশংসা করে খাট করবো না।  এককথায় বলবো অসাধারণ।

সময় সংকুলান না হওয়ায় জেলা প্রশাসক এবং কক্সবাজার বিমানবন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্পের ব্যবস্থাপকের আতিথেয়তা গ্রহণ করা হয়নি। তবে ম্যাক্স গ্রুপের বন্ধুর সহায়তায় কক্সবাজারের প্রখ্যাত শুঁটকি বাজার থেকে সুরমা, ছুরি, লইট্টা শুঁটকি সংগ্রহ করি। এগুলো পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে এসেছি।

চার দিনের কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ সফরে অনেক কিছু শিখেছি। দেশের সম্পদ সম্ভাবনা নিয়ে আরো গভীর ভাবে জেনেছি। মাতারবাড়ি ঝটিকা সফর, দৃষ্টিনন্দন কক্সবাজার রেল স্টেশন বিষয়ে জানা, সেন্ট মার্টিন এবং ছেড়া দ্বীপে অবিস্মরণীয় সময় কাটানো, কখনো ভোলা যাবে না সাগর পাড়ে বারবিকিউ, সংগীত মূর্চ্ছনা, হাউজি খেলা , নানা ধরনের উপাদেয় মাছ, রিসোর্টের দুটো বেড়াল, দুটি স্বর্গীয় শিশুর সঙ্গে খুনসুটি কত মধুর স্মৃতি।

জীবন সফরের বালুকা বেলায় দাঁড়িয়ে জানিনা আবার কোনোদিন সেন্ট মার্টিন যাওয়ার সুযোগ হবে কি না। কত দেশ ঘুরেছি, বিশ্বজুড়ে কত সাগর, মহাসাগর পাড়ে সময় কেটেছে।  এবারের সফরটি নানা কারণেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।  পিএসএলকে ধন্যবাদ আমাকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য।

জানি কক্সবাজার অঞ্চলের বর্তমান সঙ্কট একসময় কেটে যাবে। বাস্তবায়িত এবং বাস্তবায়নাধীন অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলো এতদঅঞ্চলকে দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মিলন মোহনায় পরিণত করবে। প্রয়োজন সৎ দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × 4 =