সাদা বল ক্রিকেটের দুটি সিরিজের অর্জন

সালেক সুফী

অনেকটা সম শক্তির সফরকারী শ্রীলঙ্কা দলের বিরুদ্ধে সাদা বলের দুই ফরমেট টি২০ এবং ওডিআই সিরিজ কাল শেষ হয়েছে। এখন দুটি দল লাল বলে দুই ম্যাচের টেস্ট ম্যাচ সিরিজ খেলবে। পিছনে ফিরে সিরিজ দেখলে দুটি সিরিজ থেকে বাংলাদেশের অর্জন পর্যাপ্ত।  শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছু। আশা করি সঠিক পর্যালোচনা থেকে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করা হবে। আসুন বিশ্লেষণ করি সিরিজ দুটি।

শুরুতে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তিন ম্যাচের টি২০ সিরিজটির প্রথম এবং শেষ ম্যাচ জিতে সফরকারী দল ২-১ সিরিজ জিতে নেয়।  অপরদিকে চট্টগ্রামের সাগরিকার জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তিন ম্যাচের ওডিআই সিরিজ বাংলাদেশ প্রথম এবং শেষ ম্যাচ জিতে ২-১ সিরিজ জয় করে।

জয়ের লক্ষ্যে অবিচল থাকা এবং নিজেদের শক্তি সামর্থের প্রতি আস্থাশীল থাকলে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর ম্যাচ জয় করা যায় এটি এই দুই সিরিজ থেকে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা। অতিথি দলকে ঢাকার ধীর, নিচু, ঘূর্ণি উইকেটে ট্রাপ করে ম্যাচ এবং সিরিজ জয়ের আত্মপ্রসাদ লাভ হিতে বিপরীত করে সেটি বুঝতে পেরেছে বাংলাদেশ। সিলেট এবং চট্টগ্রামের উইকেট গুলো ছিল স্পোর্টিং, সেখানে ব্যাটসম্যান এবং বোলারদের সমান সুযোগ থাকায় দুটি দল নিজেদের সেরা দক্ষতা প্রদর্শন করে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছে। উত্তেজনায় ভরপুর দুটি সিরিজ উপভোগ্য হয়েছে। অনাগত দিনে এই সিরিজের অর্জন দুটি দল বিশেষ করে বাংলাদেশের অনেক কাজে লাগবে।

খেলোয়ারদের গুণগত মান, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা, দলীয় ভারসাম্য বিচারে সফরকারী দল কিছুটা এগিয়ে থাকলেও মাঠের খেলায় দুই দল ছিল প্রায় সমশক্তির। দুটি  দিন রাতের দুটি করে চারটি ম্যাচে প্রথম বোলিং করা দল শিশিরের আশীর্বাদে বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। উভয় সিরিজের শেষ ম্যাচ ম্যাচে দিনের খেলায় সেই সুবিধা ছিল। সাধারণভাবে আম্পয়ারিং ম্যান সন্তোষজনক হলেও একটি দুটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত উষ্ণতা ছড়িয়েছে।

যাহোক শেষ পর্যন্ত দুটি সিরিজ সফল ভাবে শেষ হয়েছে।  কিছু খেলায় গ্যালারি উপচে পড়া দর্শক থাকলেও কয়েকটি ম্যাচ হয়তো গরম এবং রমজানের কারণে দর্শকশূন্য ছিল। এবারে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ধারাভাষ্যের মান ছিল উন্নত। দেশ বিদেশের ক্রিকেট প্রেমিকরা উপভোগ করেছে। তবে রোজার সময় দিবারাত্রির চট্টগ্রামের ম্যাচগুলো ৩০ মিনিট আগেই শুরু করা যেত।

বাংলাদেশ দলে এবার দুই কিংবদন্তী সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ছিল না। সিরিজে বিভিন্ন সময়ে অপরাপর ব্যাটসম্যানরা দায়িত্ব নিয়ে খেলায় দুই পাণ্ডবের উপস্থিতি বোঝা যায়নি। তরুণ অধিনায়ক নাজমুল শান্ত এই প্রথম তিন ফরম্যাটে দায়িত্ব পেয়ে সামনে থেকেই দলকে নেতৃত্ব দিয়েছে। দলে থাকা পঞ্চপাণ্ডবের শেষ দুই জন মুশফিকুর রহিম এবং মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যথেষ্ট অবদান রেখেছেন।

সার্বিক বিচারে বাংলাদেশ টপ অর্ডার ব্যাটিং ধারবাহিক ভাবে খেলতে পারেনি। বিশেষ করে ওপেনিং ব্যাটসম্যান লিটন কুমার দাস নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছে। নির্বাচকমন্ডলীর নতুন প্রধান সঠিক সময়ে লিটনকে সঙ্গত কারণে সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে পরিবর্তন করেছেন। একই সঙ্গে ওপেনারের পরিবর্তে ওপেনার প্রতিস্থাপন না করে মূল দল নির্বাচনে চার জন ওপেনার থাকা যথাযথ হয়নি সেটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। যদিও মিডল অর্ডারে সঠিকভাবে ইনফর্ম তরুণ জাকের আলী অনিককে ব্যবহারের সুযোগ হয়নি।

ব্যাটসম্যান হিসাবে এই সিরিজ দুটিতে নাজমুল শান্ত, তৌহিদ হৃদয় আরো পরিণত হয়েছে, মুশফিক তার চিরায়ত নির্ভরযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। মাহমুদুল্লাহ প্রমাণ করেছে এখনো দলকে দেওয়ার অনেক কিছুই আছে ওর। সবচেয়ে বড় অর্জন আমি মনে করি দীর্ঘ প্রত্যাশিত একজন উঁচু মানের প্রতিশ্রুতিময় লেগ স্পিনার খুঁজে পাওয়া।  তরুণ রিশাদ হোসেন ভালো ব্যাটিং এবং ফিল্ডিং করা ছাড়াও টি২০ এবং ওডিআই ম্যাচে নান্দনিক দুটি ইনিংস উপহার দিয়েছে।

সাদা বলের ক্রিকেটে এই ধরনের ক্লিন স্ট্রাইকার অতি প্রয়োজনীয় ছিল।  অনেকটা গ্লেন ম্যাক্সওয়েল অথবা আন্দ্রে রাসেলের ঢংয়ে ভয় ডরহীন ব্যাটিং করেছে রিশাদ।  উপযোগী উইকেটে হাসারাঙ্গার মতো বিশ্বসেরা স্পিনারকে তুলোধুনো করা চাট্টিখানা কথা না। একই সঙ্গে সীমিত সুযোগে নিজের জাত চিনিয়েছে জাকের আলী অনিক।  অদূর ভবিষ্যতে সঠিক যত্ন পেলে জাকের লেট্ অর্ডারে অবদান রাখবে।

একটি মাত্র ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে তানজিদ তামিম। তাও সৌভাগ্যক্রমে সৌম্য সরকারের কংকাশন পরিবর্তন হিসাবে। নিজের ছন্দে জীবনানন্দে মারকুটে ব্যাটিং করে দলকে কক্ষ পথে রেখেছে। তবে ওকে স্ট্রোকস খেলার পাশাপাশি স্ট্রাইক রোটেট করে খেলা রপ্ত করতে হবে। আমি মনে করি ধারাবাহিকতার অভাব থাকলেও ভালো ব্যাটিং করেছে বাংলাদেশ। তবে শেষ টি২০ ম্যাচ এবং দ্বিতীয় ওডিআই প্রমাণ করেছে উন্নতমানের দ্রুত গতির সুইং বোলিং এবং লেগ স্পিনের বিরুদ্ধে দুর্বলতা আছে বাংলাদেশের।

সিরিজ জুড়ে বাংলাদেশের পেস বোলিং উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে।  তাসকিন এবং শরিফুল ছিল ধারাবাহিক।  মুস্তাফিজ কিছুটা অধারাবাহিক হলেও শেষ ওডিআইতে ভালো বোলিং করেছে। আমি মনে করিনা স্পিন বোলিং ধারাবাহিকভাবে ভালো করেছে।  তবে লেগ স্পিনার হিসাবে রিশাদের সংযোজন অবশ্যই আশা জাগানিয়া। ধৈর্যশীল হতে হবে ওকে নিয়ে যেহেতু ব্যাট হাতেও ওর ম্যাচ জয় করা প্রতিভার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।  আমি মনে করি এই দলের সঙ্গে সাকিব আল হাসান এবং মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন যোগ হলে বাংলাদেশ আসন্ন টি২০ বিশ্বকাপে ভালো কিছু করবে।

আমি সর্বশেষে সিলেট এবং চট্টগ্রামে স্পোর্টিং উইকেটের জন্য কিউরেটরদের সাধুবাদ জানাবো।  এখন টেস্ট ম্যাচ দেখার অপেক্ষায়। আমাদের সময় ১৯৭০, ১৯৮০ দশকে  বাংলাদেশ শক্তিশালী শ্রীলংকার সঙ্গে খাবি খেতো। সুযোগ সুবিধা কিছুই ছিল না আজকের মতো ক্রিকেটারদের। সেই অবস্থান থেকে আজ চোখে চোখ রেখে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে খেলছে। আমি দল নির্বাচনেও শুভ পরিবর্তনের আভাস দেখছি।

সালেক সুফী: আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

6 − 4 =