সাফ ফুটবল ২০২৩ – দাপুটে জয়ে টাইগারদের ঈদ উপহার

সালেক সুফী

সাফল্য তৃষ্ণান্ত ১৭ কোটি ফুটবল প্রেমিক বাংলাদেশীর ঈদের আনন্দে সাফ ফুটবল ২০২৩ বাংলাদেশের দাপুটে জয় নতুনমাত্রা যোগ করেছে। মাঠের বাইরে নানা বিতর্ক এবং কলঙ্কে বাংলাদেশ ফুটবলমোদিরা হতাশার সাগরে ডুবে ছিল। এমটিতেই এএফসি এবং ফিফা রাংকিংয়ে তলানিতে থাকা বাংলাদেশ ফুটবল দলের ভাগ্যাকাশে ছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। এমনি অবস্থায় জামাল বাহিনী পর পর দুই ম্যাচে মালদ্বীপ এবং ভুটানকে দাপুটে  ৩-১ ব্যাবধানে উড়িয়ে দিয়ে সেমী ফাইনালে পৌঁছেছে। মোরসালিন, রকিব, হৃদয় নামের কিছু নবীন খেলোয়াড়ের প্রতিভার আগুনে জ্বলা জয় গুলো দেখে বাংলাদেশী ফুটবল প্রেমিকদের স্বপ্নগুলো ডানা মেলছে। বাংলাদেশকে খেলতে হবে সেমিফাইনালে মদ্ধপ্রাচ্চের দেশ কুয়েতের বিরুদ্ধে। জয় পেলে ফাইনালে মুখোমুখি হতে হবে স্বাগতিক ভারত এবং শক্তিশালী লেবাননের বিজয়ী দলের বিরুদ্ধে। যারাই সামনে আসুক জয়ের রক্ত নেশা পাওয়া বাংলার বাঘেরা যদি স্বপ্ন চূড়ায় পৌঁছে যায় অবাক হবো না।

সেই কবে ২০০৩ সবেমাত্র নীলমনি একবার বাংলাদেশ সাফ ফুটবলে জয় পেয়েছিলো। ২০০৯ সালে সর্বশেষ ‘দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপ’–এর শেষ চারে খেলেছিল বাংলাদেশ। ২০১১, ২০১৩, ২০১৫, ২০১৮ সাফে গ্রুপ থেকেই বিদায়। ২০২১ আসরে গ্রুপ পর্ব ছিল না। লিগভিত্তিক টুর্নামেন্টের পাঁচ দলের মধ্যে সেবার চতুর্থ হয় বাংলাদেশ।

আমি সেই ১৯৬০ দশক থেকেই ঢাকা ফুটবলের সঙ্গে পরিচিত।  ১৯৭০, ১৯৮০, ১৯৯০  দশকে নানা ভাবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। খেলা নিয়ে লিখেছি বাংলা ইংরেজি দুই ভাষায় অনেক। দেখেছি বাংলাদেশ ফুটবলের সোনালী দিনগুলো। প্রবাসে এসে শুনছি ফুটবলে বাংলাদেশের ক্রমাবনতির শোকগাথা।  মাঝে মধ্যে যখন বাংলাদেশ সফর করেছি গ্রামে গঞ্জে কিন্তু ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা দেখেছি সাধারণ মানুষের মধ্যে। সেই কুড়িগ্রাম, সাতক্ষিরার মতো প্রত্যন্ত প্রান্তরেও। সম্প্রতি বাংলাদেশের মেয়েদের নিয়মিত ফুটবল সাফল্য আবারো আমাকে প্রবাসে বসে ফুটবল নিয়ে আগ্রহী করে তোলে। এবার কিন্তু আমি রাত জেগে বাংলাদেশের তিনটি ম্যাচ দেখেছি। মালদ্বীপ আর ভুটান বাংলাদেশের সামনে দাঁড়াতেই পারে নি। লেবাননের বিরুদ্ধে ম্যাচটিতেও বাংলাদেশ জয় না পেলেও অন্তত একটি পয়েন্ট অর্জন করার মতো খেলেছে।

মালদ্বীপের বিরুদ্ধে আমি নিজে বাংলাদেশকে ৮-১ জয় পেতে দেখেছি এবং ম্যাচ নিয়ে লিখেছি। সেই মালদ্বীপের সঙ্গে খেলা গত ৬ ম্যাচের চারটিতেই বাংলাদেশ পরাজিত হয়েছে জেনে কষ্ট লাগতো। এবার কিন্তু খেলার ধারার বিরুদ্ধে সূচনায় ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল। এর পর আহত বাঘের মতোই ঝাঁপিয়ে পরে বাংলাদেশ মৌমাছির মতো হুল ফোটাতে থাকে মালদ্বীপ রক্ষণ দুর্গে। একের পর এক কর্নার, মোক্ষম জায়গায় থ্রো ইন, মধ্যমাঠ থেকে ডিফেন্স চেরা থ্রু, উইং থেকে চিপস আছড়ে পড়তে থাকে।  এদিন তারেক কাজী, তপু বিশ্বাস, বিশ্বনাথ ঘোষ, জামাল, হৃদয় ছিল অনবদ্য।  বিরতির আগেই তপুর হেড থেকে মাথা গ্ল্যান্সিং হেডের মাধ্যমে সমতা আনে রকিব (১-১)। বিরতির পর আক্রমণ ধারা অব্যাহত রাখে টোটাল ফুটবল কৌশলে খেলা বাংলাদেশ।  এমনি এক আক্রমণ থেকে তারেক কাজি সুযোগসন্ধানী গোল বাংলাদেশকে এগিয়ে দেয় (২-১) । আগের কিছু খেলায় দেখেছি শেষ দিকে এসে বাংলাদেশ খেই হারিয়ে ক্লান্ত হয়ে পরে। কোচ সঠিক সময়ে কিছু পরিবর্তন আনে।  বিশেষ করে কুশলী তরুণ মোরসালিন এসে কিছু সৃজনশীল আক্রমণ রচনা করে. খেলার অন্তিম মুহূর্তে ওর গোলে বাংলাদেশ ৩-১ ম্যাচ জয় করে টুর্নামেন্টে এগিয়ে যাবার দুয়ার খুলে ফেলে।

কাল ভুটানের বিরুদ্ধে জয় কাঙ্খিত থাকলেও কিছুটা শংকা ছিল। সেটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের পারফরমেন্স ভরসা দেয়নি। কিন্তু কাল শুরু থেকেই বাংলাদেশ জয়ের নেশায় উন্মত্ত ছিল। এই দিন তারেক কাজী আহত থাকায় বিশ্বজিৎকে  সেন্ট্রাল ডিফেন্স  তপু বর্মণের পাশে খেলতে হয়েছে, শুরু থেকেই দিন মোরসালিন, রকিব জুটি জমে উঠেছিল। কিন্তু এইদিনও খেলার ধারার বিরুদ্ধে ১২মিনিটে গোল হজম করে বাংলাদেশ (০-১)। পিছিয়ে পড়েও কিন্তু আক্রমণের ধারা থেকে পিছিয়ে পড়েনি বাংলাদেশ। তরুণ মোরসালিন রীতিমতো ভীতি ছড়ায় ভুটান শিবিরে। ২২ মিনিট ওর দূরপাল্লার শটে করা সমতার গোলটি বাংলাদেশের নবজাগরণের প্রতীক হয়ে থাকবে (১-১)। আমাদের ফরিদপুরের তরুণ ছেলেটির পসিশন সেন্স, বল কন্ট্রোল, সাথীদের সাথে বোঝাপড়া সব কিছুই জাত স্ট্রাইকারের সহজাত। পরিচর্যা পেলে অনেক এগিয়ে। মোরসালিন ডিফেন্স ফুঁড়ে বেরিয়ে বল ঠেলে দিয়েছিলো সতীর্থ রকিবকে।  রকিব চেয়েছিলো সুবিধাজনক জায়গায় থাকা জামালকে বল দিতে। পথে ভুটানের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের পায়ে লেগে গোল হলে বাংলাদেশ ২-১ গোলে এগিয়ে যায় খেলার ৩০ মিনিটে।  মুহুর্মুহু আক্রমণে অসহায় হয়ে পরে ভুটান। ৩৬ মিনিট রকিব নিজেই কুশলতার সঙ্গে ঢুকে পরে চমৎকার গোল করে বাংলাদেশকে ৩-১ এগিয়ে নেয়। এর পর প্রথমার্ধের বাকি সময় এবং দ্বিতীয়ার্ধ বাংলাদেশ হাই প্রেসিং করে খেলে এবং নিজেদের রক্ষণ ভাগ সুরক্ষিত রেখে জয় সুনিশ্চিত করে।

জানি আজ বাংলাদেশের নগর শহরে ঈদ আনন্দে ভাষা বাংলাদেশিরা ফুটবল দলের নব জাগরণ নিয়ে কথা বলবে। পর পর দুই ম্যাচে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশিদের জন্য ঈদ উপহার টাইগার বাহিনীর।

কুয়েত, ভারত, লেবানন অনেক এগিয়ে থাকলেও মোমেন্টাম এখন বাংলাদেশ দলে।  নিজেদের খেলাটা ধরে রাখলে সেমী ফাইনাল পেরিয়ে ফাইনাল এমনকি শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখতেও এখন দ্বিধা নেই। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে। কাজটি কিন্তু সহজ সাধ্য নয় এখনো।

সালেক সূফি, আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × 1 =