ডা. সিরাজুম মুনিরা
ডেঙ্গু জ্বর একটি মশাবাহিত ভাইরাল সংক্রমণ। এটি বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে সাধারণত দেখা যায়। বর্তমান বর্ষা মৌসুমে দেশে প্রায় প্রতিদিনই ডেঙ্গু জ্বরের রোগী শনাক্ত হচ্ছে। দিনদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সংক্রমণটিকে মোটেই অবহেলা করার মত নয়, যার কারণ হচ্ছে, এটি গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে মৃত্যুর আশঙ্কা আছে। ডেঙ্গু হলো প্রধানত Aedes aegypti নামক মশাবাহিত এক মারাত্বক ভাইরাস জনিত রোগ। আরও কিছু অপ্রধান মশার প্রজাতিও ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায় তবে তা খুবই গৌণ। এই ভাইরাস বাহিত মশা যখন একজন সুস্থ মানুষকে কামড়ায় তখন সে ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং এই ব্যক্তি ভাইরাসের একজন বাহক হয়ে যায়। এখন যদি ভাইরাসবিহীন সাধারণ কোনো মশা ওই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ায় তাহলে সেই মশাটি ও আক্রান্ত হয় ভাইরাস দ্বারা এবং এরপর এই মশা যতজনকে কামড় দেবে, প্রত্যেকেই আক্রান্ত হবে ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা এবং প্রত্যেকেই কাজ করবে এক এক জন বাহক হিসেবে।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন হলো ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। একটি ধরনে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, অর্থাৎ শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে। ওই ধরনে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। তবে অন্য তিনটি ধরনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার আক্রান্তের অর্থ হলো ভিন্ন ধরনে আক্রান্ত হওয়া। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা ও জটিলতা বেশি দেখা দেয়।
যে কোনো সময় আমাদের জ্বর হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় দু-তিন দিন বা চার-পাঁচ দিন ধরে জ্বর, তারা এই বিষয়টিকে আমলে নিচ্ছেই না, ভাবছে সিজনাল জ্বর। সে ক্ষেত্রে কোনোকোনো উপসর্গে আমরা বুঝব এটি ডেঙ্গু জ্বর? ২০১৮ সালে আমাদের ন্যাশনাল একটি গাইডলাইনস বের হয়। এই গাইডলাইনসে বলা আছে কীভাবে আমরা ডেঙ্গু জ্বর ম্যানেজমেন্ট করব এবং কীভাবে আমরা ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত করতে পারব। গাইডলাইন অনুযায়ী, আমরা এ জ্বরটা তিনটা ক্যাটাগরিতে ভাগ করতে পারি। ক্যাটাগরি এ, বি ও সি। এ ক্যাটাগরি মানে আমাদের খারাপ কোনো উপসর্গ থাকবে না। এক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো হলো- হঠাৎ প্রচণ্ড জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা, পেশি ও অস্থিসন্ধিতে গুরুতর ব্যথা, ক্লান্তি, বমি বমি ভাব বা বমি, ত্বকে ফুসকুড়ি ওঠা ইত্যাদি।
বি ক্যাটাগরি হচ্ছে, যাদের কিছু ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণ থাকে। যেমন পেটে ব্যথা, প্রচুর বমি, অথবা অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ যেমন রক্তবমি করা, নাক দিয়ে রক্ত বের হওয়া ইত্যাদি। অনেক সময় দেখা যায়, মহিলাদের মাসিকের সময় ছাড়াও প্রচুর রক্ত যাচ্ছে, পায়খানার সাথে রক্ত যাচ্ছে অথবা ত্বকের নিচে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে এমনকি অজ্ঞান হয়ে যায়, যদি প্লাজমা লিকেজের কারনে পেটে পানি চলে আসে, ফুসফুসে পানি আসে ইত্যাদি। এ ধরনের উপসর্গ যদি থাকে, তাহলে বি ক্যাটাগরিতে পড়বে। তাদের অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে এবং হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
সি ক্যাটাগরি হচ্ছে ক্রিটিক্যাল ফেস। এগুলো আরও খারাপ উপসর্গ। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ব্লাড প্রেশার কমে যায়, রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, রোগী অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। বি ও সি ক্যাটাগরির রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এবং সেইসাথে যাদের দ্বিতীয়বারের মত ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে, তাদের ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
ডেঙ্গু হলে কী ধরনের চিকিৎসা নিতে হবে বাসায় না হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে নির্ভর করে এর ধরন বা ক্যাটাগরির ওপর। এ ক্যাটাগরির রোগীরা স্বাভাবিক থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ মতে বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়াই যথেষ্ট। ডেঙ্গু সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য আসলে কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য এর লক্ষণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে,প্রচুর তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস এবং খাবার স্যালাইন পান করতে হবে একটু পরপর। তরল খাবার ৯০ শতাংশ কমায় ডেঙ্গুর তীব্রতা। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার ডাল, ডিম, মুরগির মাংস, ছোট মাছের ঝোল বেশি করে রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়। ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন, ক্লোফেনাক, আইবুপ্রোফেন-জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় এ জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্লাটিলেট এখন আর মূল বিষয় নয়। প্লাটিলেট হিসাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নামলে বা শরীরের কোনো জায়গা থেকে রক্তপাত হলে প্রয়োজন বোধে প্লাটিলেট বা ফ্রেশ রক্ত দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই কম দেখা যায়। অনেকে বলেন, পেঁপে পাতার জুস ইত্যাদি খেলে প্লাটিলেট বাড়ে। আসলে এসবের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।
জ্বর কমে যাওয়ার পর সংকটকাল পেরিয়ে গেলে আপনা থেকেই প্লাটিলেট বাড়তে শুরু করে। জ্বরের শেষের দিকে রক্তচাপ কমে যেতে পারে অথবা মাড়ি, নাক, মলদ্বার দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। এ রকম হলে প্রয়োজনে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়া লাগতে পারে। এসব ক্ষেত্রে তাই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। ডেঙ্গু রোগীর কিডনি কিংবা লিভারে সমস্যা, পেট ব্যথা, বমি অথবা অন্তঃসত্ত্বা, অথবা জন্মগত যদি কোনো সমস্যা থাকে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। অনেক সময় রোগীর জন্য আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের প্রয়োজন হতে পারে। এর বাইরে জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে যদি কোনো রোগীর দাঁতের মাড়ি বা নাক বা মলদ্বার দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়, সারাদিন যে পরিমাণ প্রস্রাব হতো, তার পরিমাণ যদি কমে যায়, শ্বাসকষ্ট হলে দেরি করা উচিত নয়। ভর্তি করাতে হবে হাসপাতালে। ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম থেকে মানবদেহে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাল্স রেট অনেকটা বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ খুব কমে যায়। শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস খুব দ্রুত চলে। রোগী অস্থির হয়ে ওঠেন। তখন সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত।
ডেঙ্গু জ্বর রোধ করার জন্য কোনো ভ্যাকসিন নেই। মশার কামড় থেকে বাঁচা এবং মশার সংখ্যা হ্রাস করাই রক্ষার সর্বোত্তম পদ্ধতি। কোনো জায়গায় পানি জমে রয়েছে কি না দেখা বা পানি জমতে পারে এমন জায়গার দিকে নজর দিতে হবে। ফুলদানি, ক্যান এই জাতীয় জিনিস নিয়মিত পরীক্ষা করা, খালি করা বা পরিবর্তন করতে হবে। বাড়ির আসেপাশে জমা জল থাকলে পরিষ্কার করতে হবে। মশার কামড় এড়াতে লম্বা হাতা শার্ট এবং প্যান্ট মোজা পরতে হবে, খোলা জানালায় mosquito net লাগাতে হবে, রাত্রে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে, মশা তাড়ানো ক্রিম বা ধুপ ব্যাবহার করা যেতে পারে।
ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে স্বাস্হ্য অধিদপ্তর অত্যন্ত সচেষ্ট আছেন। ইতোমধ্যে প্রতিটি জেলা উপজেলায় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এই নির্দেশনা অনুযায়ী সকল সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগ স্ক্রিনিংয়ের পর্যাপ্ত কিটের ব্যবস্হা করা হচ্ছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্হাপনায় ডেঙ্গু স্ক্রিনিংয়ের চার্জ ১০০ টাকা ধার্য্য করা হয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক বা আরএমও এর কক্ষে অতিরিক্ত অভিজ্ঞ চিকিৎসককে দায়িত্ব দিতে বলা হয়েছে, যাতে আগত ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যাহত না হয়।
হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের পর্যাপ্ত মশারির ব্যবস্হা করার জন্য সংশ্লিষ্ট পরিচালক/তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের জাতীয় গাইড লাইন অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। ২৪/৭ ল্যাব খোলা রাখা হচ্ছে। ন্যাশনাল গাইড লাইন অনুযায়ী প্লেটলেট কনসেনট্রেট প্রয়োজন হলে, সরকারিভাবে সংগ্রহ করা যাবে। ২১টি সেন্টারে DMCH, NICVD, NIKDU, NINS, BSMMU, CMCH, RMCH, NICRH, RpMCH, M.A Rahim MCH (DjMCH), SZMCH, CoMCH, Sher-E-Bangla MCH, Sylhet MAG Osmani MCH, NIDCH, ShSMCH, SSMCH, Cox’s Bazar H, MMCH, BSMMCH (Faridpur), Shahid M. Mansur Ali MCH (Shirajgonj) প্লাটিলেট সরবরাহের ব্যবস্হা আছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার সহযোগিতায় হাসপাতালের চারপাশ নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাসহ হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ডাব বিক্রি বন্ধ করতে বলা হয়েছে। ডেঙ্গু একটি ভেক্টর বাহিত রোগ বিধায় জিও লোকেশন ট্রেসিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মোবাইল নম্বর এবং পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা অবশ্যই সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার জন্য আইইডিসিআর এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার যৌথ উদ্যোগে কন্ট্রোল রুম খোলা আছে যেখানে ডেঙ্গু সংক্রান্ত যে কোনো প্রয়োজনে যোগাযোগ করা যাবে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ব্যাপারে বিশদ জ্ঞানার্জন ডেঙ্গু প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রতিটি জনসাধারণকে সচেষ্ট হতে হবে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে। শুধু নিজেদের সুস্বাস্থ্যের জন্যই নয়; ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে হলে এখনি প্রয়োজন ডেঙ্গু নির্মূলে সোচ্চার হওয়া।
লেখক: সিভিল সার্জন, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা
পিআইডি ফিচার