সিকিউর ইউ-এর আফিফা

নাহিন আশরাফ

নারীরা এখন নিজেকে সাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য অনেক বেশি সচেতন। নারীরা যে কাজে দক্ষ সে কাজ করেই এখন নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করে তুলছে। একটা সময় নারী ও পুরুষের পেশার মধ্যে ভেদাভেদ থাকলেও তা এখন অনেকটা কমে আসছে। নারীরা এখন আর নিজেদের কোনো পেশার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেনি। সব ধরনের পেশাতেই তারা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। এমন একজন নারী সৈয়দা আফিফাতুন্নেছা আফিফা।

বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা হবার কারণে ছোটবেলা থেকে খুব আদরে ছিলেন। বাসায় তাকে কোনো বাড়তি কাজ কিংবা রান্নাঘরে যেতে দেওয়া হতো না। সবসময় নিজের মতো পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বেড়ে উঠেন ঢাকার ওয়ারিতে। শেরেবাংলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং সেন্ট্রাল ওমেন কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন। পরে তিনি ভর্তি হন ইডেন মহিলা কলেজে। সেখান থেকে ম্যাথমেটিক্সে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করেন। ছোটবেলায় মা রান্না করতে না দিলেও রান্নাই হয়ে যায় তার সবচেয়ে শখের জায়গা। বিয়ের পর যখন নিজের সংসারের রান্না করতেন সকলে তার রান্নার অনেক প্রশংসা করতেন। প্রশংসা শুনে তিনি উৎসাহ পেতেন এবং সবার জন্য রান্না করতেন। রান্নাকে তিনি কখনো পেশা হিসেবে বেছে নিবেন বলে ভাবেননি। মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন বলেই রান্না করতেন। তিন সন্তানের মা হবার কারণে তিনি বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতেন সন্তান ও তাদের পড়ালেখা নিয়ে। ব্যস্ততার মাঝেও তিনি পরিবার ও সকলের জন্য রান্না করতেন। প্রচলিত রান্না ছাড়াও তিনি খাবার নিয়ে নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করতেন। পরিবার এবং বন্ধু মহলে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল তার হাতে তৈরি মিষ্টি জাতীয় খাবার।

২০১৫ সালে তিনি নিজের তৈরি করা খাবার নিয়ে একটি মেলায় স্টল দেন। মেলায় তার তৈরি খাবারের জন্য তিনি প্রশংসিত হন এবং ক্রেতাদের বেশ সাড়া পান। ২০১৬ সালে জনপ্রিয় রন্ধনশিল্পী কেকা ফেরদৌসীর বাংলাদেশ কুকিং অ্যাসোসিয়েশনের একটি রান্না প্রতিযোগিতায় আফিফা অংশগ্রহণ করেন। প্রতিযোগিতাটি ছিল বৈশাখ উপলক্ষ্যে। খাবারের বিষয় ছিল আঞ্চলিক খাবার। একটি ঝাল এবং একটি মিষ্টি আইটেম তৈরি করে নিয়ে যেতে হবে। আফিফা বরিশালের বিখ্যাত একটি খাবার তৈরি করে নিয়ে যান। নারকেল ও বোম্বাই মরিচ দিয়ে রান্না করা চিংড়ি যা কলা পাতা দিয়ে ভাপে রান্না করা হয় এবং বরিশালেরই আরেকটি বিখ্যাত পিঠা চন্দ্রপুলি যা বরিশালে নতুন জামাইকে খেতে দেওয়া হয়।

প্রতিযোগিতায় কেকা ফেরদৌসী সহ আরো অনেক অভিজ্ঞ সেফরা ছিলেন। বিচারকেরা ধীরে ধীরে সব প্রতিযোগিদের খাবার টেস্ট করে দেখছিলেন। আফিফা স্মৃতিচারণ করে বলেন, তার খাবারটি খেয়ে বিচারকরা বলেছিলেন সাংঘাতিক মজা হয়েছে। আফিফার খাবারটি ছিল প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে ভিন্নধর্মী আইটেম। তিনি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। সেই প্রতিযোগিতা তার জীবনের মোড় কিছুটা পরিবর্তন করে দেয়। বিভিন্ন জায়গায় তিনি ইন্টারভিউ দেন, খবরের কাগজের পাতায় তার ছবি ছাপা হয়। অনুষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট ও কেকা ফেরদৌসীর কুকিং অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বারশিপ পান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। এখনও তিনি এ অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত আছেন। অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য রান্নাও শিখিয়েছেন তিনি।

প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে থেমে থাকেননি তিনি। অংশগ্রহণ করেছেন আরো বিভিন্ন ধরনের কম্পিটিশন ও মেলায়। সেখানে তিনি তার খাবার ডিসপ্লে করে সকলের প্রশংসা অর্জন করেন। এছাড়া রান্না বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং কোর্সও করেন তিনি। বন্ধু এবং পরিবারের কাছে তিনি বিভিন্ন ধরনের রান্নার অর্ডার পান। মিষ্টি খাবারের পাশাপাশি আচারের জন্য তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। চিরাচরিত আচার ছাড়াও তিনি ভিন্নধর্মী আচার তৈরি করেন। যেমন আমড়ার ছোকলার আচার, সবজির আচার, গরুর মাংসের আচার ইত্যাদি। তার কাছের মানুষেরা যেকোনো অনুষ্ঠানের জন্য খাবার অর্ডার করতেন। যার ফলে উৎসাহিত হয়ে তিনি একটি ফেসবুক পেজ খোলেন। নাম দেন ‘আফিফা’স কুজিন’। এছাড়া রান্না বিষয়ক বিভিন্ন টেলিভিশন প্রোগ্রামে তিনি অতিথি হয়ে দর্শকদের রান্না শেখান। আফিফার তিন সন্তানই এখন যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত। এখন তার হাতে অফুরন্ত সময়। তার অবসর সময় কাটে বিভিন্ন ধরনের রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করে। তিনি বলেন, রান্না একটি আর্ট। অন্যান্য আর্টের মতো এটিও চর্চার প্রয়োজন। তাই সুযোগ পেলেই তিনি রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করেন।

শখের রান্নাবান্নার পাশাপাশি তিনি স্বামীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামলাচ্ছেন ব্যবসা। ২০১৮ সালে তিনি স্বামীর ব্যবসায় যোগ দেন চেয়ারম্যান হিসেবে। তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘সিকিউর ইউ লিমিটেড’। অফিস, ফ্যাক্টরি বা বাড়ির পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা বা কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোর নির্ভরযোগ্য সমাধান সিকিউর ইউ লিমিটেড। এখন নির্ভরযোগ্য সিকিউরিটি গার্ড কিংবা বাসার জন্য হেল্পিং হ্যান্ড পাওয়া খুব বেশি কঠিন। তারা নির্ভরযোগ্য হেল্পিং হ্যান্ড, সিকিউরিটি গার্ড এবং সিকিউরিটির সাথে জড়িত যন্ত্রপাতির সার্ভিস দিয়ে থাকেন। তাদের কোম্পানির গার্ড এবং হেলপিং হ্যান্ডদের বিশেষ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া ব্যক্তি নির্ভরযোগ্য কিনা তা মনিটরিং করা হয়। এছাড়া নিজস্ব দক্ষ জনবল দিয়ে বাড়ির পানির ট্যাংক পরিষ্কার, পোকামাকড় ও দুর্গন্ধ দূর করা, বাড়ি-অফিস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, এসি, ফ্রিজ সার্ভিসিং ইত্যাদি কাজ তারা করে থাকেন। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান এখন কেমন জনপ্রিয় জানতে চাইলে আফিফা বলেন, এমন প্রতিষ্ঠান এখন বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেকেই এ ধরনের ব্যবসা চালু করছেন।

মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবসা পুরোপুরি নির্ভর করে আস্থা ও বিশ্বাসের উপর। তাই আমাদের অনেক বেশি সচেতন থাকতে হয়, একজন গার্ড কিংবা হেল্পিং হ্যান্ডকে নিয়োগ দেওয়ার আগে। মানুষ যেহেতু বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিচ্ছে তাই সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার চেষ্টা আমরা করে থাকি। একজন গার্ড কিংবা পরিষ্কার পরিছন্নতা কর্মীকে যথেষ্ট ট্রেনিং দিতে হয়। আমাদের কোম্পানি তাদের বিশেষ ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে প্রস্তুত করেই বিভিন্ন বাসা বাড়িতে তাদের পাঠিয়ে থাকে। এর পেছনে যথেষ্ট অর্থ, শ্রমের প্রয়োজন হয়। এ ব্যবসার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্লায়েন্ট ঠিকমতো মজুরি দিতে চান না। তারা মনে করেন অল্প সময়ের এ কাজ কি এমন কষ্টসাধ্য! অনেকেই শ্রমিকের শ্রমের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করে না। সেক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

সৈয়দা আফিফাতুন্নেছা বলেন, সকল বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে নারী পারে না এমন কোনো কাজ নেই। তারা ঘর এবং বাহির দুদিকই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছে। তাদের এই যাত্রায় যদি বন্ধু এবং পরিবার সহযোগিতার হাত বাড়ায় তাহলে নারীর চলার পথ অনেকটা সহজ হয়ে যায়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

12 + eleven =