সুঁই তোর মাথায় ছিদ্র কেন

মাহবুব আলম

সূচকে কথ্য ভাষায় সুঁই বলা হয়। এই সুঁইয়ের সঙ্গে কম-বেশি আমরা সবাই পরিচিত। তবে সুঁইয়ের সঙ্গে সুঁই-সুতা বললে আমরা আরও সহজে ভালো করে বুঝি। আমাদের ছোটবেলায় সুঁই-সুতা ছিল না এমন কোনো বাড়ি ছিল না। সেসময় এই সুঁই-সুতা ছিল অত্যাবশতীয় একটি সামগ্রী। শার্টটা ছিঁড়ে গেছে, প্যান্টের সেলাই খুলে গেছে অথবা শাড়ি-ব্লাউজটা ফেটে গেছে বা ছিঁড়ে গেছে, তখন করণীয় কি? করণীয় দ্রুত সেলাই। সেই সেলাইয়ের জন্য ঘরে ঘরে সুঁই-সুতা থাকতো। রাখতো কোনো একটা কাঠিতে সুতার রোলে সুঁই গেঁথে। অথবা সুঁই রাখতো দেয়ালে ঝুলে থাকা ক্যালেন্ডারে। সুঁই এত ছোট, ছোট নয়, রীতিমতো ক্ষুদ্র, তাই ক্যালেন্ডারে গেঁথে রাখত। এতে বিপত্তি কম হয়নি। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে গিয়ে অথবা কোটার মধ্যে সুঁই-সুতা খুঁজতে গিয়ে সুঁইয়ের গুঁতো খায়নি, সুঁই ফোটেনি কারো হাতে এমন ঘটনার কোনো শেষ নেই।

এছাড়াও আগেকার দিনে নারীরা সুঁই-সুতা দিয়ে রুমালে নকশা আঁকত। বিছানার চাদর, টেবিলের চাদরেও নকশা করার জন্য সুতার ব্যবহার ছিল হরহামেশা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েও ইন্দিরা গান্ধী সুঁই-সুতার ব্যবহার ভুলেননি। তাইতো তার কাছে এর অনেক কদর ছিল। কথিত আছে ইন্দিরা গান্ধীর হ্যান্ড ব্যাগে সবসময় সুঁই-সুতা থাকতো। এমনকি বিদেশে সফরে সময়ও।

একবার লন্ডন শহরে গিয়ে সেখানে অধ্যয়নরত পুত্র রাজিব গান্ধীর হবু স্ত্রীকে দেখতে চাইলেন। এতে খুব খুশি হয়ে হবু স্ত্রী সোনিয়া এসে হাজির হন তার সামনে। সোনিয়াকে দেখে খুব খুশি হন ইন্দিরা গান্ধী। খুশি হবারও কথা, ইতালির মেয়ে, রোমান মেয়ে। যাদের সৌন্দর্যের খ্যাতি দুনিয়া জোড়া। সর্বোপরি সৌন্দর্যের দেবীরাও বাস করে রোমান সাম্রাজ্যে। কিন্তু গোল বাধলো তার ড্রেস টপসে দুই হাতায় ছিদ্র বা ছেঁড়া দেখে। আসলে ওটা ছিল ওই টপসের ডিজাইন। কিন্তু শাড়ি-ব্লাউজের দেশের রক্ষণশীল ইন্দিরা ইউরোপিয়ান পোশাক টপসের বিষয়টা বুঝলেও তার ভালো লাগেনি। তাই তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তার ব্যাগ থেকে সুঁই-সুতা বের করে টপসের দুই হাতায় সেলাই করে দিলেন। তারপর তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, দেখ রাজীব, সোনিয়াকে এখন কি সুন্দর লাগছে।

এখনও সেই সুতার ব্যবহার আছে। তবে ঘরে ঘরে নেই। তারপরও আছে গ্রামবাংলায় ও শহরের নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ঘরে। এখানে বলে রাখা দরকার সুঁইয়ের মাথায় একটা ছিদ্র থাকে। যে ছিদ্র দিয়ে সুতা ঢুকানো হয়। এই সুতা ঢুকানো একটা আর্ট।

এই বাংলায় এক সময় সুঁই-সুতার মতো ধুচনির ব্যবহার ছিল। বিশেষ করে গ্রামবাংলায়। ধুচনিকে অনেকে জায়গায়ই খালোই বলা হতো। এই খালোই বা ধুচনি চাল ধোয়ার কাজে বিশেষভাবে ব্যবহার হতো। এই ধুচনি আসলে টিনের তৈরি একটি হালকা বালতি বিশেষ। তবে বালতির সঙ্গে এর পার্থক্য হচ্ছে ধুচনির তলায় অসংখ্য ছিদ্র থাকত। সুচের মাথায় যেমন একটা ছিদ্র এখানে অনেক ছিদ্র, শতশত ছিদ্র। তবে মাথায় নয় তলায়। যাতে চাল ধোয়ার সময় পানি আপনা আপনি বেরিয়ে যায়।

এক সময় এই ধুচনি ও সুচ দিয়ে অনেক গল্প ছিল। সেই গল্পের একটা হলো একদিন ধুনচি সূচকে বলছে, তোর মাথায় ফুটো (ছিদ্র) কেন? ধুনচির এই অবাক ও বিস্ময়কর প্রশ্নে সূচ হেসেছিল। হাসতে হাসতে পাল্টা প্রশ্ন করে বলল, আমার শরীরে তো একটা ফুটো তোর শরীরে এত অসংখ্য ফুটো কেন?

সম্প্রতি ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রচার প্রপাগান্ডায় সেই সঙ্গে ভারত সরকারের এক্ষেত্রে জোর গলা দেখে সেই পুরানো সূচ আর ধুচনির গল্প মনে পড়ছে।

গুজরাট দাঙ্গার দগদগে ক্ষত এখনো শুখায়নি। ওই দাঙ্গা, ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনও আদালতে মামলা ঝুলে আছে। দিল্লির শিখ দাঙ্গায় একদিনে ২০ হাজার নর-নারী শিশু-কিশোর হত্যার নারকীয় ঘটনায় সারা দুনিয়ায় শোকের ছায়া নেমে আসে। সেই দাঙ্গার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি শিখদের প্রতিরোধের আগুন এখনও থামেনি। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করা হয়। তারই পরিণতি খালিস্তান আন্দোলন। সম্প্রতি মনিপুরে জাতিগত দাঙ্গায় বীভৎস রূপ আধুনিক বিশ্বের বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে। আর কাশ্মীর সেখানে তো সাম্প্রদায়িকতার দগদগে ঘায়ে মলম দেওয়ার পরিবর্তে লবণ দেওয়া হচ্ছে বছরের পর বছর। সেই ভারতের অভিযোগ বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের। এই অভিযোগ শুনে আস্তাবলের ঘোড়াও হাসছে। তারপরও একের পর এক অভিযোগ করেই যাচ্ছে ভারতের মিডিয়া আর দাঙ্গাবাজ গুজরাট কসাইখ্যাত মোদী সরকার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার অভিযোগ বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা নেই। সেই আইনশৃঙ্খলা ফেরাতে নাকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা বাহিনী প্রেরণ করতে হবে। কি নির্লজ্জ আর হাস্যকর প্রস্তাব। যে দেশের রাজধানী দিল্লি ধর্ষণের জন্য বিশ্ববিখ্যাত, যে রাজধানীতে ধর্ষণের ভয়ে নারীরা সন্ধ্যার মধ্যে ঘরে ফিরে। আর কলকাতায় ধর্ষণ নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে তার কোনো কিছুই কি আছে বাংলাদেশ। না নেই। তাই মমতা-মোদীর চিৎকার শুনে যে কারোরই সূচ আর ধুনচির গল্পই মনে পড়বে। মনে পড়ছেও। এটাই তো স্বাভাবিক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × three =