সুপারহিরো নারায়ণ দেবনাথ মারা গেলেন

মঙ্গলবার সকালে যখন নারায়ণ দেবনাথের মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছল, আচমকাই সেই বন্ধুর কথাটা মনে পড়ল। সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল ক্রমশই ভরে উঠছে স্মৃতিচারণায়। নারায়ণ দেবনাথ এক এমন জাদুকরের নাম, যার নামটুকু উচ্চারণই যথেষ্ট।

বাঙালি এখন গ্লোবাল। তার রুচিরও বিস্তর বদল ঘটেছে। কিন্তু আজও বইমেলায় বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা কিংবা নন্টে আর ফন্টে, কে‌ল্টুদাদের ঘিরে ছোট ছোট হাসিমুখের ভিড় নজর এড়ায় না। বহিরঙ্গে যতই বদলাক, শৈশব আসলে শৈশবই। তাই সেদিন যারা চিলেকোঠায় বসে শীতের দুপুরে বাঁটুল পড়ত তাদের নাতিপুতিরা ফ্ল্যাটবাড়ির একচিলতে বারান্দায় বসেও নারায়ণ দেবনাথের চরিত্রদের সঙ্গে সময় কাটায়। আর সেটা কাটায় ওদের সঙ্গে রিলেট করতে পারছে বলেই। এ এক বিরাট সাফল্য।

১৯৬২ সালে ‘হাঁদা-ভোঁদা’, তিন বছর পরে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ আর ১৯৬৯-এ ‘নন্টে-ফন্টে’। সে বড় সুখের সময় নয়। সদ্য স্বাধীন দেশে তখনও যুদ্ধের ধিকি ধিকি আগুন কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তেজনা ছড়িয়ে রয়েছে। তবু সেই সব জটিল কুটিল পরিস্থিতি থেকে তাদের সরিয়ে নিয়ে যেত হাঁদা-ভোঁদাদের নিরলস আনন্দ-মজা।

সেই সময়কার মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত বাঙালির টানাটানির সংসারের ফাঁকফোকর ভরিয়ে রাখতেন যারা তাদের অন্যতম নারায়ণ দেবনাথ তাই নিজেই যেন হয়ে উঠেছিলেন এক সুপারহিরো। যাঁর সুপার পাওয়ার হাতে ধরা রং-তুলির জাদুস্পর্শ। বাঙালি তখন খবরের কাগজে একফালি ফ্যান্টম পেত রোজ। চলমান অশরীরীকেও আপন করে নিয়েছিল সে। কিন্তু সেই সঙ্গেই নারায়ণ দেবনাথের হাত ধরে নিখাদ বাংলা কমিকসেও এক স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল।

নারায়ণ দেবনাথ আরও কয়েকটি কমিকস স্ট্রিপের স্রষ্টা। সারা জীবন ধরেই করে গিয়েছেন অসামান্য ইলাসট্রেশন। সমস্ত কিছুর মধ্যেই এমন এক মৌলিকত্ব ছিল যা তৈরি করে দিয়েছিল দুরন্ত সিগনেচার। ভেবে দেখুন নারায়ণ দেবনাথ ব্যবহৃত অনুকার অব্যয়গুলি— ঢকাস, খ্যাড়াং, ছলাস, ইরক, উলস জাতীয় শব্দের মধ্যেই যেন বুনে দেওয়া আছে নিখাদ বাঙালিয়ানা।

অবশ্য কেবল ছোটরাই কি তাকে পড়ে? নাহ! পড়ে বড়রাও। তাদের কাছে বাঁটুল কিংবা হাঁদা-ভোঁদার কমিকস আসলে এক অনন্য নেভারল্যান্ডে পালিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র। নারায়ণ দেবনাথও রয়েছেন। থেকে যাবেন আরও বহু বহু বছর। মৃত্যু অনতিক্রম্যই। দীর্ঘায়ু নারায়ণ দেবনাথের মৃত্যুকে তাই আমাদের মেনে নিতেই হবে। সেই সঙ্গে এও মানতে হবে, আমাদের শৈশবের যে অংশটা তার কাছে বাঁধা পড়ে আছে তা থেকে যাবে একই রকম। তার সৃষ্ট চরিত্রদের মতোই।

সংবাদ প্রতিদিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × four =