সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ গাইড: যাওয়ার উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ

কাউসার মো. সায়েম

নদীমাতৃক বাংলাদেশে দীর্ঘ ভ্রমণে যাওয়ার ব্যাপারে যে কোনো বয়সের ভ্রমণপিপাসুদের মনেই প্রথম যে নামটি আসে তা হল সেন্টমার্টিন দ্বীপ। হাজারো পর্যটকের বিস্ময়ের ফেনিল সাগরের বুকে জেগে ওঠা এই একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির অবস্থান দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে সর্ব দক্ষিণে।

কক্সবাজারের টেকনাফ জেটি থেকে জাহাজে করে প্রায় দুই ঘন্টার অন্তহীন জলপথ পাড়ি দেবার সময় দৃষ্টি সীমানায় জাদুর মতো ভেসে উঠবে তিন বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ছোট্ট দ্বীপটি। দেশের ভেতরে ও বাইরের পর্যটকদের জন্য অতি আকর্ষণীয় এই সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবারে ভ্রমণ ফিচার।

সেন্টমার্টিন নামটির পেছনের গল্প

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা কামাল পাশার মতে, আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের সময় দ্বীপটি আরবের ব্যবসায়ীদের নজরে আসে। সওদাগররা সে সময় দ্বীপটির নাম দিয়েছিলেন জাজিরা; মানে উপদ্বীপ। পরে স্থানীয়রা একে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ বলতে শুরু করে, যার অর্থ ‘নারকেলের দ্বীপ’।

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০০ সালে ভূমি জরিপের সময় দ্বীপটি ব্রিটিশ-ভারতের এখতিয়ারভুক্ত হয়। কামাল পাশার সহকর্মী অধ্যাপক বখতিয়ার উদ্দিন দাবি করেন যে, চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মার্টিনের নামে নামকরণ করা হয়েছিল দ্বীপটির। কিন্তু বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, মার্টিন নামের লোকটি ছিলেন মূলত একজন খ্রিস্টান সাধু। আর এই সাধুর নামটাই পরবর্তীতে যুক্ত হয়ে যায় দ্বীপের নামের সঙ্গে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের বিশেষত্ব

টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাওয়ার মাঝ সমুদ্রপথে সাদা ফেনার জলরাশির উপর দিয়ে সাদা গাঙচিলের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য এক অফুরন্ত আনন্দের হাতছানি দেবে। পাখিদের খেলা আর সাগরের বিশালতা সগর্বে ঘোষণা করবে ছোট জীবনে অপার স্বাধীনতার কথা। এক দৃষ্টে নাফ নদীর মোহনায় এক টুকরো বসতি মনে হলেও আসলে দ্বীপটি পাশাপাশি সাতটি এলাকায় বিভক্ত। এরপরেও প্রতিটি অংশ যেন এক সুতায় গাঁথা মালার মতো।

পড়ন্ত বিকালে এক কাপ চায়ের সঙ্গে পশ্চিম উপকূলে সূর্যাস্তের সাক্ষী হওয়ার মত অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা হয় না। সেন্টমার্টিন তার অর্ধেকটা সৌন্দর্য্যই যেন ঢেলে দিয়েছে পশ্চিম উপকূলের এই সৈকতে। রোদেলা সকাল কাটানোর জন্য পূর্ব সৈকতটা সেরা। এদিকের সৈকত থেকে মায়ানমারের পাহাড়ের উপর সূর্যের প্রথম রশ্মির দৃশ্যটা যে কোনো পর্যটককে জাদুর জালে জড়িয়ে ফেলতে যথেষ্ট।

দ্বীপের একদম দক্ষিণে প্রবালের মায়ায় বেড়ে উঠেছে দেশের দক্ষিণের সর্বশেষ বিন্দু ছেঁড়া দ্বীপ। এরকম নামের কারণ হচ্ছে- বর্ষাকালে মূল দ্বীপ থেকে এ জায়গাটি একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ তো গেলো সমুদ্র আর সূর্যস্নান! কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সেন্টমার্টিন তার রূপে দর্শনার্থীদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য আরও ব্যবস্থা রেখেছে স্কুবা ডাইভিং, স্নরকেলিং ও বারবিকিউয়ের। সেন্টমার্টিন ঘুরতে যেয়ে নিদেনপক্ষে একটা দিন যদি সেখানে থাকা না হয়, তাহলে বাড়ি ফিরে আসতে হবে বিস্তর অনুশোচনা নিয়ে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

শীত ও বসন্তকাল; অর্থাৎ নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন জাহাজ চলে। অন্য সময় সমুদ্রযাত্রার একমাত্র উপায় ট্রলার বা স্পিডবোট। তাছাড়া শীতের সময় ছাড়া অন্যান্য প্রায় সব ঋতুতেই উত্তাল থাকে সাগর। তাই সেন্টমার্টিন ভ্রমণ উপভোগের জন্য শীতের মৌসুমটা সবচেয়ে ভালো ও নিরাপদ। অন্য সময় গেলে সেন্ট মার্টিনে যাতায়াত ও দ্বীপে ঘোরাঘুরি নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। তবে সেই অফপিক সময়গুলোর একটা ভালো দিক হচ্ছে- সে সময় দ্বীপে হোটেল ভাড়াটা অনেক কম থাকে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপ আনুষঙ্গিক খরচ

সেন্টমার্টিন দ্বীপ দেশের সর্ব দক্ষিণের উপজেলা টেকনাফের একটি ইউনিয়ন হওয়ায় সেখানে যেতে হলে ঢাকা থেকে প্রথমে টেকনাফে পৌঁছাতে হবে। ঢাকার কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে এসি ও নন-এসি বিভিন্ন বাস যাত্রা করে টেকনাফের উদ্দেশ্যে। বাসের ধরন এবং মানের উপর নির্ভর করে এসব বাসে টিকিটের মূল্য ৯০০ থেকে দুই হাজার টাকা। এভাবে সড়ক পথে টেকনাফ জেটি পর্যন্ত যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘন্টা।

এই দীর্ঘ সময়ের পথটা এড়াতে চাইলে সুযোগ আছে প্লেনে যাওয়ার। ঢাকা থেকে আকাশপথে এক ঘণ্টার মধ্যে কক্সবাজার পৌঁছানো যায়। সেক্ষেত্রে প্লেনের ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভাড়া গুণতে হবে চার হাজার ২০০ থেকে ১১ হাজার টাকা পর্যন্ত। তারপর টেকনাফগামী যেকোনো বাসে বা মাইক্রোবাসে করে সর্বোচ্চ আড়াই ঘন্টার মধ্যে পৌঁছানো যাবে টেকনাফের একদম জেটি পর্যন্ত। এখানে বাস ভাড়া পড়তে পারে ১৮০ টাকা। আর ৮ থেকে ১০ আসন বিশিষ্ট মাইক্রোবাস রিজার্ভ করলে খরচ হবে প্রায় তিন হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা।

তবে যে পথেই যাওয়া হোক না কেন, এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সেন্টমার্টিনের জাহাজ টেকনাফ জেটি থেকে সকাল সাড়ে ৯ টায় ছেড়ে যায়। তাই টিকিটের আনুষ্ঠানিকতার জন্য এক ঘন্টা আগেই উপস্থিত হতে হবে জেটিতে। জাহাজগুলোর প্রতিষ্ঠান ও তাদের নিজস্ব শ্রেণীর ওপর নির্ভর করে, ভাড়া ৬৫০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা পড়তে পারে। আড়াই ঘন্টার সমুদ্রযাত্রার পর জাহাজগুলোর সেন্টমার্টিন দ্বীপে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর ১২টায় বেজে যায়। এই জাহাজগুলো আবার ফিরতি পথ অর্থাৎ টেকনাফের দিকে যাত্রা শুরু করে বিকাল ৩টার দিকে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা

সেন্টমার্টিনে রাত্রি যাপনের জন্য প্রতিটি বাংলাদেশি পর্যটকদের স্বপ্ন থাকে প্রথিতযশা গ্রন্থকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের সমুদ্র বিলাসে থাকার। এছাড়া গত কয়েক দশক ধরে দর্শনীয় জায়গা হিসেবে দ্বীপটির জনপ্রিয়তা থাকায় এখানে আছে বেশ কিছু বিলাসবহুল হোটেল ও রিসোর্ট। হোটেলগুলোর প্রতিষ্ঠান এবং কক্ষের ধরণ অনুসারে এগুলোতে এক দিন থাকার জন্য জনপ্রতি ভাড়া গুণতে হয় এক হাজার ৫০০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মতো। ভ্রমণের মৌসুমে অর্থাৎ শীত ও বসন্তে এই হোটেলগুলোতে থাকতে চাইলে আগে থেকেই বুকিং করে যেতে হবে।

কিন্তু যারা আবাসনের বিলাসিতা এড়িয়ে ঘোরাঘুরির দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, তারা স্থানীয়দের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে তাদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন। মৌসুম অনুযায়ী ভাড়া আলাদা হয়, তবে সাধারণত ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বেশ ভালো রুমের ব্যবস্থা হয়ে যায়।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের স্থানীয় খাবার

এক সময় নারিকেল জিঞ্জিরা নাম পরিচিত এই দ্বীপটিতে এখনো নারকেলের জনপ্রিয়তা আছে। পর্যটকরা এখানকার সুস্বাদু ডাবের পানি না খেয়ে সেন্টমার্টিন ত্যাগ করেন না। যারা মাছ খেতে পছন্দ করেন তাদের জন্য সেন্টমার্টিন সামুদ্রিক মাছের বিশাল ভান্ডার নিয়ে অপেক্ষা করছে।

এই ভান্ডারে আছে কোরাল, সুন্দরী পোয়া, ইলিশ, রূপচাঁদা, গলদা চিংড়ি, এবং কালাচাঁদা, যেগুলো একবার চেখে দেখলে মুখে স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। হোটেল এবং রিসোর্টগুলোতে পছন্দ মতো মাছ বেছে নিয়ে বারবিকিউ করা যায়। এই দ্বীপের আরো একটি জনপ্রিয় খাবার হলো কুরার মাংস। এখানকার বাসিন্দারা স্থানীয় মুরগিকে কুরা বলে। এছাড়া লইট্যা, চুড়ি, রূপচাঁদা, কাচকি মাছের শুঁটকিও কেউ না খেয়ে আসেন না।

সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে প্রয়োজনীয় কিছু সতর্কতা

সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সময় রোহিঙ্গা সমস্যা এড়াতে সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র রাখা দরকার। কক্সবাজার থেকে শুরু করে টেকনাফ অব্দি যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময় চেকিং হতে পারে। প্রবালের উপর দিয়ে হাঁটার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কোনো কোনো প্রবাল এতটাই ধারালো, যে বেকায়দায় পা পড়ে কেটে যেতে পারে। ভ্রমণ শুরু সময়েই উপকূলের আবহাওয়ার সম্পর্কে অবগত হয়ে নিতে হবে।

বিশেষত ভাটার সময় সমুদ্র সৈকতে না যাওয়াটাই উত্তম। শীতকালে সাধারণত সাগরের অবস্থা অনুকূল থাকে। এরপরেও যাওয়ার আগে স্থানীয় আবহাওয়া ভালো করে জেনে নেয়া উচিত। নৌকা দিয়ে সেন্টমার্টিনের আশেপাশের সাগর অঞ্চল ঘোরার সময় লাইফ জ্যাকেট পরে নেয়া আবশ্যক।

ভ্রমণ মানেই আড্ডা, গান, হাসি-তামাশা, খেলাধুলা। কিন্তু এই কার্যকলাপের ফলে আশেপাশের বা স্থানীয় কারো যেন কোনো সমস্যা বা ক্ষতিসাধন না হয় সেদিক স্পষ্ট নজর রাখতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে আবর্জনা ফেলে দ্বীপের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি না করা। বিশেষ করে সৈকতে, সমুদ্রের পানিতে প্লাস্টিক বা যেকোনো ধরনের আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

শেষ কথা

প্রতিটি প্রকৃতিপ্রেমির স্বপ্ন থাকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের, যেটি একবার পূরণ হয়ে গেলেও স্বপ্নটি যেন বারবার হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকতে থাকে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকেরই দায়িত্ব এই দেশীয় সম্পদটিকে সংরক্ষণ করা। কোনো ভাবেই যেন এর সৌন্দর্য্য নষ্ট না হয়, তা নিশ্চিত করা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন একই রকম মুগ্ধতা নিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপ দেখতে পারে, সেজন্য এর রূপমুগ্ধ প্রতিটি ভ্রমণপিপাসুরই যথাযথ ভূমিকা পালন করা উচিত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nineteen − 7 =