সেলফি আসলো কিভাবে

জানেন কী, আজ থেকে ১৮৪ বছর আগে প্রথম ‘সেলফি’ ছবি তোলা হয়েছিল! আমেরিকাতে প্রতি বছর ৩১ জানুয়ারি ন্যাশনাল সেলফি দিবস পালন করা হয়! ক্যামেরা হাতে নিজের তোলা ছবি ‘সেলফি’ নামে পরিচিত। বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরা হোক কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সেলফি তুলে রাখা হচ্ছে। বর্তমানে স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, কিন্তু সেলফি তোলেন না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। কিভাবে সেলফি হয়ে উঠলো আমাদের রোজকার অভ্যাস, আর কিভাবে আসলো সেলফি; নুর জাহানের প্রতিবেদনে আমাদের আজকের আয়োজন।

ইংরেজি ‘সেলফিশ’ থেকে ‘সেলফি’ শব্দটি এসেছে। সেলফি অর্থ প্রতিকৃতি। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানের মতে, সেলফি হলো একটি ছবি (আলোকচিত্র) যা নিজের তোলা নিজের প্রতিকৃতি, যা সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েবক্যামে ধারণকৃত। সেলফি শব্দটির ব্যবহার এর আগে পাওয়া গেলেও ২০০২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ান এক অনলাইন ফোরামে (এবিসি অনলাইন) প্রথম ব্যবহৃত হয় ‘সেলফি’ শব্দটি। নাথান হোপ নামে এক অস্ট্রেলীয় যুবক নিজের ঠোঁট জখম হওয়ার পর তার ছবি তুলে নেট মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। বিবরণে লিখেছিলেন, ‘ঝাপসা ছবির জন্য দুঃখিত। এটা আসলে সেলফি ছিল।’ বড় শব্দের ডাকনাম দেওয়ার প্রচলন আছে অস্ট্রেলীয়দের। শব্দকে ছোট করে শেষে আই এবং ই জুড়ে দেন তারা। যেমন অস্ট্রেলিয়ান থেকে অজি। সেলফ পোট্রেটও সেভাবেই সেলফি হয়ে উঠেছিল নাথানের কথায়। ‘সেলফি’ শব্দটি টাইম ম্যাগাজিনে ২০১২ সালে বছরের সেরা দশ শব্দে জায়গা করে নিয়েছিল। ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড অভিধানে ‘সেলফি’ শব্দটি জায়গা পেয়েছে। ওই বছরই অক্সফোর্ড বর্ষসেরা শব্দ হিসেবেও ঘোষণা করে ‘সেলফি’কে।

১৮৪ বছর আগে প্রথম সেলফি ছবি তোলা হয়েছিল। সেই সেলফিটা তুলেছিলেন একজন রসায়নবিদ। অবশ্য তখন এটির নাম সেলফি ছিল না। যখন তিনি ছবি তুলেছিলেন তিনি নিজেও জানতেন না ইতিহাসে এটিই প্রথম সেলফি হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে। সালটা ছিল ১৮৩৯। রবার্ট কর্নেলিয়াস নিজের একটি সেলফি তুলেছিলেন। পেশায় তিনি ছিলেন একজন রসায়নবিদ। তখন তার বয়স ৩০ বছর। আমেরিকার লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের তথ্য মতে, বিশ্বের প্রথম সেলফি গ্রাহক রবার্ট কর্নেলিয়াস। আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে রবার্টের তোলা প্রথম ‘সেলফি’ এখনও সংরক্ষিত রয়েছে। গুগল সার্চ করলেই ছবিটির দেখা মিলবে। এতে দেখা যায় রবার্টের এলোমেলো চুল। নিজের হাত দু’টি বুকের কাছে রেখে দিয়েছেন। রবার্টের দৃষ্টি সরাসরি ক্যামেরার দিকে নয়। ফ্রেমের মাঝখানে থেকে কিছুটা একপাশে রয়েছেন। সাধারণত সেলফি তোলার সময় যা হয়ে থাকে। রবার্ট প্রথম সেলফিটি তুলেছিলেন তাদের ঝাড় লণ্ঠনের দোকানের পেছনে। ক্যামেরার লেন্স খুলে প্রায় ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাকে। কারণ সে সময়ে ড্যাগেরোটাইপ ফটোগ্রাফিতে ছবি তুলতে অনেক সময় লাগত। যার কারণে তিনি অন্যমনষ্ক হয়ে যান এবং ক্যামেরা থেকে তার দৃষ্টি সরে যায়। রবার্ট কর্নেলিয়াস আমেরিকায় নিজের ছবি নিজে তোলার একটি স্টুডিয়ো তৈরি করেছিলেন। যেখানে সমাজের ধনী মানুষরা ছবি তুলতে আসতেন। পোট্রেট তোলার ক্ষেত্রে রিফ্লেক্টর বা আলোর প্রতিফলকের ব্যবহারও ওই স্টুডিয়োতেই চালু করেছিলেন রবার্ট।

রবার্ট কর্নেলিয়াসের পর মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ফ্রান্সের আর এক ফটোগ্রাফার হিপোলাইট বায়ার্ড সেলফি তুলেছিলেন। বর্তমান সময়ে সাজানো গোছানো ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করে নানা ভঙ্গিমায় সেলফি তোলা হয়। তবে এমন সৃষ্টিশীল সেলফি প্রথম তুলেছিলেন হিপোলাইট বায়ার্ড। প্রথম ‘স্টেজড সেলফি’ অর্থাৎ সাজিয়ে গুছিয়ে মঞ্চস্থ করা ‘সেলফি’ তুলেছিলেন তিনিই। একজন মৃত মানুষের ভূমিকায় নিজেকে সাজিয়ে সেই ছবি নিজেই ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন হিপোলাইট বায়ার্ড। রবার্ট কর্নেলিয়াসের থেকে একেবারেই আলাদা ছিল হিপোলাইট বায়ার্ডের ছবি তোলার প্রক্রিয়া। ১৮৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি হিপোলাইট বায়ার্ড সেই প্রক্রিয়া বিষয়ে ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সকে জানিয়েছিলেন। অ্যাকাডেমি তার আবিষ্কারটি আগে প্রকাশ করলে হয়তো তিনিই হতেন প্রথম সেলফি গ্রাহক।

১৯০০ সালে কোডাক ব্রাউনি ক্যামেরা বাজারে এসেছিল। পোর্টেবল ‘কোডাক ব্রাউনি’ বক্স ক্যামেরা বাজারে আসার পর ফোটোগ্রাফিক আত্ম-প্রতিকৃতি তোলা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বহনে সহজ এই ক্যামেরার সাহায্যে আয়নার মাধ্যমে সেলফি তোলার প্রচলন শুরু হয় তখন থকেই। ব্রাউনি কিন্তু কোডাকের প্রথম ক্যামেরা নয়। ১৮৮৮ সালে কোডাক তাদের প্রথম ক্যামেরা এনেছিল। তবে ব্রাউনি অল্প দামে সাধারণের নাগালে পৌঁছে দিয়েছিল ক্যামেরাকে। ১৯১৩ সালে সেই ক্যামেরার সাহায্যেই আয়নায় ‘সেলফি’ তোলেন রাশিয়ার রাজকন্যা। ১৮৮৯ সালে জর্জ ইস্টম্যান ‘ইস্টম্যান কোডাক কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিখ্যাত এই কোম্পানি ফটোগ্রাফিক ফিল্ম নির্মাণের জন্য সুপরিচিত।

‘সেলফি’ পরিচিত হওয়ার অনেক আগে ভারতের কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায় নিজের মা’য়ের সঙ্গে সেলফি তুলেছিলেন। ছবির বিবরণে সত্যজিৎ লিখেছিলেন, ‘মা আর আমি। ক্যামেরার শাটারের সঙ্গে সুতো বেঁধে টান দিয়ে আমিই তুলেছিলাম ছবিটা।’ ১৯৬৬ সালে মহাকাশে তোলা বাজ অলড্রিনের ছবিটিও ঐতিহাসিক সেলফি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জেমিনি ১২ মহাকাশ অভিযানে সেলফি তুলেছিলেন বাজ অলড্রিন। মহাকাশে তোলা প্রথম সেলফি ছিল এটিই। ২০১১ সালে জেনিফার লি নামের এক নারী সর্বপ্রথম ইন্সটাগ্রামে ‘ঝবষভরব’ হ্যাশট্যাগে ছবি আপলোড করেন। ২০১৩ সাল থেকে সেলফি ক্যামেরা স্মার্টফোনে চালু হয়। মূলত ভিডিয়ো কলের সুবিধার জন্যই ওই ক্যামেরা থাকলেও, তাকে সেলফি তোলার জন্যও ব্যবহার করতে শুরু করেন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দ্বিতীয় সেলফিটি তোলা হয় ‘সেলফি’র সেলফি হওয়ার অব্যবহিত পরেই। ২০১৪ সালের অস্কারে হলিউডের তারকা টিভি সঞ্চালক এলেন ডিজেনারেসের স্মার্ট ফোনে ওই সেলফি তুলেছিলেন অভিনেতা ব্র্যাডলি কুপার। নেট মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি শেয়ার হওয়া সেলফি বলে এখনও পরিচিত সেলফিটি। ওই সেলফিতে ছিলেন হলিউডের প্রথম সারির একঝাঁক অভিনেতা অভিনেত্রী। জেনিফার লরেন্স, মেরিল স্ট্রিপ, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ছাড়াও ব্র্যাড পিট, চানিং টাটুম, জুলিয়া রবার্টস, কেভিন স্পেসি প্রমুখেরা।

হিরোশি উয়েদা’কে বলা হয় সেলফি স্টিকের উদ্ভাবক। ২০০৫ সালে সেলফিকে আরও সহজলভ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য আবিষ্কার হয়েছিল সেলফি স্টিক। কানাডার একজন নাগরিক সেলফি স্টিক আবিষ্কার করেছিলেন। আধুনিক সেলফি স্টিকের একটা দারুণ ডিজাইন তৈরি হলো ২০১৪ সালে। যা খুব সহজেই মোবাইলে ছবি তোলার জন্য ব্যবহার করা যাচ্ছিল। টেইলর সুইফট এবং স্ন্যাপচ্যাটের কথা না বললেই নয়। টাইম ম্যাগাজিনের তালিকায় ওই বছরের সেরা ২৫টি আবিষ্কারের একটি সেলফি স্টিক। ২০১৫ সালের পর থেকে সেলফি স্টিক বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১৫ সালে ডিজনিল্যান্ড থিম পার্কে সেলফি স্টিক নিষিদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ। আনলেও তা প্রবেশ দ্বারে রেখে আসতে হয় এবং যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে হয়। ২০১৫ সালে বেশ কয়েকটি মিউজিক শো’য়ে নিষিদ্ধ হয় সেলফি স্টিক। আরেকটি বিখ্যাত বিনোদন পার্ক সিক্স ফ্ল্যাগস একই নিয়ম চালু করে সেই সময়। সেখানে নিরাপত্তাজনিত কারণে নিষিদ্ধ হয় সেলফি স্টিক।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম মৃত্যু ঘটে সেলফি স্টিকের মাধ্যমে। সত্যিকার অর্থেই এটি মানুষের জীবনের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বিপজ্জনক পরিবেশ এবং পরিস্থিতিতে সেলফি তুলতে গিয়ে সেই সময় প্রাণ হারায় ১২ জন। তীব্র বেগে ছুটে আসা ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে, ধেয়ে আসা ষাঁড়ের সামনে ইত্যাদি পরিস্থিতিতে সেলফি স্টিকে ছবি তুলতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন তারা। এরপর আমেরিকায় নিষিদ্ধ করা হয় সেলফি স্টিক। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাস থেকে মোবাইল নির্মাতা কোম্পানিগুলো এমন স্মার্টফোন বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল যা দিয়ে সেলফি তুলতে সেলফি স্টিকের প্রয়োজন পড়বে না। কাজেই সেলফি স্টিক জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। সেলফি তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা কিন্তু কম নয়। প্রতিবছর ভারতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হয় সেলফি তুলতে গিয়ে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে ‘ঘড় ঝবষভরব তড়হব’ যেখানে সেলফি তোলা একবারে নিষিদ্ধ।

ফেসবুক জনপ্রিয়তা লাভ করার আগে মাইস্পেস ছিল জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম। ২০০৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত মাইস্পেস ছিল বৃহত্তম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ২০০৬ সালের জুন মাসে গুগল এটিকে সবচেয়ে বেশি প্রদর্শিত ওয়েবসাইট হিসেবে নির্বাচিত করে। সেলফি সর্বপ্রথম জনপ্রিয়তা পায় মাইস্পেস প্লাটফর্মে। তারপর ফেসবুক ছাড়াও ইমেজ শেয়ারিং প্লাটফর্মগুলো জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর সেলফি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সেলফি তোলা অতি সহজ হলেও আমরা অনেকেই সেলফি তোলায় আসক্ত হয়ে যাই; যা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। স্মৃতিগুলো বন্দী করে রাখার জন্য সেলফি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তা যেন জীবনহানির কারণ না হয় সেদিকে নজর রাখা প্রয়োজন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − two =