সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে

প্রভাষ আমিন

মানুষ জন্মগ্রহণ করে; চাকরি-বাকরি, ঘরসংসার করে, তারপর মরে যায়। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষই মরে যাওয়ার আগে কোনো চিহ্ন রেখে যায় না বা যেতে পারে না। কিন্তু সব মানুষ তেমন নন। কিছু কিছু মানুষ আসেন, যারা ব্যক্তি ছাড়িয়ে, এলাকা ছাড়িয়ে, দেশ ছাড়িয়ে হয়ে ওঠেন বিশ্বের। তারা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে বদলে দেন সবকিছু। অনুপ্রাণিত করেন কোটি মানুষকে। এমন মানুষদের জন্যই সভ্যতা এগিয়ে যায়, পৃথিবী আরো বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। মালালা ইউসুফজাই তেমনি একজন।

উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াত উপত্যকায় তার জন্ম। মালালা চেয়েছিলেন ডাক্তার হতে। কিন্তু সোয়াত উপত্যকা তখন তালেবান অন্ধকারে ঢাকা। মালালা হয়তো চাইলে একা ডাক্তার হতে পারতেন। কিন্তু তাতে সোয়াতের আরো হাজারো শিশু, বিশেষ করে কন্যাশিশু থেকে যেত অশিক্ষার অন্ধকারে। পিতা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাইয়ের অনুপ্রেরণায় মালালা অ্যাকটিভিস্ট বনে যান। ২০০৭ সালে মাওলানা ফজলুল্লাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানি তালেবানের একটি শাখা সোয়াত উপত্যকা দখল করে নেয়। কট্টর ইসলামি শরিয়াহ আইনের বলে টেলিভিশন দেখা বন্ধ করে, গান-বাজনা নিষিদ্ধ করে। আর পরের বছর মেয়েদের লেখাপড়া নিষিদ্ধ করে। একই সঙ্গে তারা প্রায় ১৫০টি স্কুল বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়।

অথচ পশতু জাতি-অধ্যুষিত এই উপত্যকা চিরকালই শিক্ষার দিকে থেকে পাকিস্তানের বাকি অংশ থেকে এগিয়ে ছিল। এই রুদ্ধদ্বার পরিস্থিতি মেয়েদের শিক্ষার ওপরে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, তা জানার জন্য বিবিসির উর্দু ওয়েবসাইট একটি উদ্যোগ নেয়। ২০০৯ সাল থেকে সে উদ্যোগেই জড়িয়ে যান ১২ বছরের মালালা। গুল মাকাই ছদ্মনামে ডায়েরির মতো করে নিজের অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করেন শিশু মালালা। স্কুলে যাওয়ার আকাক্সক্ষা, তালেবানি শাসনে স্কুলে যেতে না পারার শঙ্কা, গোলাগুলির শব্দে রাতে ঘুমাতে না পারার কথা লিখতো মালালা খুব সহজ করে। এই সহজ কথাই নজর কাড়ে অনেকের। দ্রুতই বিশ্বের আরো অনেক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় গুল মাকাই তথা মালালার আকুতি।

২০০৯ সালে মালালা ও তার পিতা জিয়াউদ্দিনকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে নিউ ইয়র্ক টাইমস। এই তথ্যচিত্রের পরই আসলে গুল মাকাইয়ের আসল পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। ঝুঁকির মুখে পড়েন মালালা ইউসুফজাই। ২০১১ সালে পাকিস্তানি সেনারা সোয়াত উপত্যকা থেকে তালেবানকে পিছু হটিয়ে দিলে মালালা এবং তার সহপাঠীরা স্কুলে ফিরে আসে। সাহসী মালালা তখন নারী শিক্ষা নিয়ে প্রচার শুরু করে। যা তাকে এনে দেয় পাকিস্তানের প্রথম ‘জাতীয় যুব শান্তি পুরস্কার’। কিন্তু গুল মাকাইয়ের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসা, বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার, নারী শিক্ষার জন্য লড়াই মালালার জীবনের ওপর ঝুঁকি বাড়ায়।

মালালার ডায়রি শুধু পাকিস্তান নয়, আলোড়ন তোলে সারাবিশ্বেই। ফলে তালেবানরা প্রকাশ্যেই মালালাকে হুমকি দিতে থাকে। কিন্তু সাহসী মালালাকে দমানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত তালেবানরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর স্কুল থেকে ফেরার পথে স্কুল বাসে উঠে বন্দুকধারীরা মালালাকে খুঁজে বের করে গুলি করে। দুই বান্ধবীসহ গুরুতর আহত হন মালালা। পাকিস্তানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে নিয়ে যাওয়া হয় মালালাকে।

তালেবানের গুলি মালালাকে পরিণত করে আন্তর্জাতিক আইকনে। সুস্থ হয়ে যুক্তরাজ্যেই পড়াশোনা শুরু করেন মালালা। যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের এজবাস্টন হাইস্কুল ফর গার্লসের শিক্ষার্থী থাকার সময় মালালা মাত্র ১৭ বছরে বয়সে শান্তিতে নোবেল পান। সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবরটা মালালা পেয়েছেন শ্রেণিকক্ষে বসেই। প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তার স্ত্রী মিশেলের আমন্ত্রণে মালালা হোয়াইট হাউসে গেছেন মালালা; নিমন্ত্রণ পেয়েছেন যুক্তরাজ্যের রানি এলিজাবেথের কাছ থেকেও।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মালালা মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিভি চ্যানেলে তার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে। ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল কানাডার পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর হাত থেকে সম্মানসূচক নাগরিকত্বের সনদ গ্রহণ করেন ১৯ বছর বয়সী মালালা। পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া থেকে দেওয়া সম্মানজনক লিবার্টি মেডেল। রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্মানজনক শাখারভ মানবাধিকার পুরস্কার। বিখ্যাত টাইম সাময়িকীর বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকাতেও স্থান পেয়েছিলেন মালালা। মালালার আত্মজীবনী ‘আই অ্যাম মালালা: হাউ ওয়ান গার্ল স্টুড আপ ফর এডুকেশন অ্যান্ড চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড’ ঠাঁই করে নিয়েছে অ্যামাজনের সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায়।

তালেবানের গুলি মালালাকে দমাতে পারেনি। বরং এই হামলা বদলে দিয়েছে তার জীবন। আর তিনি বদলে দিয়েছেন গোটা বিশ্বের ভাবনা। গুলি খেয়েও বসে থাকেননি, পুরস্কার পেয়েও দায়িত্ব শেষ মনে করেননি। বিশ্বব্যাপী যে পরিচিতি তাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে শিশুশিক্ষা, বিশেষ করে নারী শিশুশিক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন মালালা। তার নামে প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পিছিয়ে পড়া নারীদের শিক্ষার জন্য কাজ করছেন।

মালালা ইউসুফজাইয়ের কাজের একটা বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে নারী শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে নারীদের সবসময় পিছিয়ে রাখা হয়। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন এবং সভ্যতার অগ্রগতির জন্য পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। জনসংখ্যার অর্ধেককে অবগুণ্ঠিত রেখে কোনো দেশ, কোনো সভ্যতা এগিয়ে যেতে পারে না। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি। কিন্তু মুখে বললে হবে না, কাজ করতে হবে। আর সেই কাজটাই নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন মালালা। আসল কাজটা হলো নারীদের জীবন আলোকিত করতে হবে শিক্ষায়, কর্মে।

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। গার্মেন্টস খাতের ব্যাপক বিকাশে নারী শ্রমিকদের অবদান অতুলনীয়। কৃষিখাতেও নারীরা সমানতালে কাজ করছেন। শিক্ষায় নারীরা পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেতা নারী, স্পিকার নারী, সংসদ উপনেতা নারী। রেল থেকে বিমান সবখানে নারীদের জয়জয়কার। খেলাধুলায় আমাদের নারীরা সাফল্য এনে দিচ্ছেন। বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এখন আর পুরুষদের কাজ, নারীদের কাজ বলে আলাদা কিছু নেই। ঘরেবাইরে সবকিছু নারীরা সামলাচ্ছেন নিপুণ দক্ষতায়। কিন্তু তারপরও ধর্মীয় মৌলবাদীরা নারীদের ঘরে আটকে রাখতে চায়, তাদের অবগুষ্ঠিত রাখতেন চায়। বাংলাদেশের একসময়কার শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আল্লামা শফি নারীদের তেঁতুলের সাথে তুলনা করে বলেছিলেন, নারীদের ‘ক্লাস ফোর-ফাইভ’ পর্যন্ত পড়াই যথেষ্ট। এখনও ধর্মীয় নেতারা বিভিন্ন ওয়াজে নারীদের পণ্য হিসেবে বর্ণনা করেন আর কীভাবে তাদের ঘরে আটকে রাখা যায়, তার কৌশল বর্ণনা করেন। বাংলাদেশেও যদি একজন মালালা থাকতো, যদি সাহসের সাথে মৌলবাদীদের মোকাবেলা করতো; আমরা আরো দ্রুত এগিয়ে েেযাতে পারতাম।

আমরা জানি রাত যত গভীর, ভোর তত নিকটবর্তী। অন্ধকার যত তীব্র, আলো তত উজ্জ্বল। পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় অন্ধকার তালেবান শাসনে যে আগুন জ্বেলেছিলেন মালালা ইউসুফজাই, তা আজ ছড়িয়ে গেছে সবখানে। সে আগুন পুড়িয়ে দিক বিশ্বের সকল মৌলবাদীর আস্তানা, আমাদের সকল কুপমণ্ডুকতা, পশ্চাদপদতা। শিক্ষার আলো জ্বলুক ঘরে ঘরে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nine + thirteen =