সোমেশ্বরী নদী পাড়ের ছেলে সোমেশ্বর অলি

সোমেশ্বর অলি মানুষকে মুগ্ধ করেন গানের কথার মধ্য দিয়ে। দেড় যুগের ক্যারিয়ারে বেশ কিছু জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের। বর্তমানে সমানতালে কাজ করছেন ছোট পর্দা থেকে ওটিটি প্লাটফর্মে। তার লেখা গান শ্রোতারা শুনেছেন বড় পর্দায়। ইতিমধ্যে দুই শতাধিক গান লিখেছেন তিনি। ২০২৩ সালে ‘কিছুটা উপর থেকে মানুষ দেখতে ভালো লাগে’ নামে প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন তিনি। তার সম্পর্কে জানাচ্ছে নূরজাহান প্রধান

সোমেশ্বর অলির জন্ম ও বেড়া ওঠা ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরে। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি এবং কবিতার প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল তার। কবি হওয়ার জন্যই ঢাকায় আসেন অলি। তবে গীতিকার হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পান লুৎফর হাসানের থেকে। শখের হলেও এখন তিনি একজন পেশাদার গীতিকার। তিনি নিজের মতো থাকতে ভালোবাসেন। বলা যায় আত্মগোপনে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। লেখালেখি করেন মনের আনন্দে। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করেন। তবে কথা বলে তার লেখা গান। গীতিকবি হিসেবে সোমেশ্বর অলি সুপরিচিত।

দেড় দশক আগে এস আই টুটুলের কণ্ঠে ‘রঙিন দালান’ শিরোনামে গানের কথা লিখে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন সোমেশ্বর অলি। এরপর আরও কয়েকটি গান লিখেন। ২০১১ সালে গায়ক লুৎফর হাসান প্রকাশ করলেন নিজের গাওয়া প্রথম অ্যালবাম ‘ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো’। অলির লেখা টাইটেল গান ‘ঘুড়ি’ সকলের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। ‘ঘুড়ি’ লেখার মাধ্যমে সকলের কাছে গীতিকার হিসেবে অধিক পরিচিতি লাভ করে সোমেশ্বর অলি।

ময়লা টি-শার্ট

ছেঁড়া জুতো

কদিন আগেই

ছিল মনেরই মতো

ময়লা টি-শার্ট

ছেঁড়া জুতো

কদিন আগেই

ছিল মনেরই মতো

দিন বদলের

টানাপোড়েনে

সখের ঘুড়ি, নাটাই সুতো

ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো

তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়?

যে সব বাংলা গান শ্রোতাদের মাঝে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার মধ্যে প্রথম সারিতে থাকবে লুৎফর হাসানের কণ্ঠে গাওয়া এই গানটি। গানের কথা লিখেছেন সোমেশ্বর আলী। গানটি ইউটিউবে ইতিমধ্যে ২ কোটি বারের বেশি শুনেছেন শ্রোতারা।

সোমেশ্বর অলির মিডিয়াতে কাজ শুরু গীতিকবি হিসেবে না। শুরুটা হয় পত্রিকায় লেখালেখি করার মাধ্যমে। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় আজ থেকে দুই দশক আগে। ২০১১ সালে থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উপ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন সমকাল পত্রিকায়। তারপর বাংলা নিউজের বিনোদন বিভাগের প্রধান হয়ে টিম পরিচালনা করেছেন ২০১৭ সাল পর্যন্ত। সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞতা বছর দশেকের। তার মধ্যে বিনোদন সাংবাদিকতা করেছেন ছয় বছর। ১০ বছর সাংবাদিকতা সঙ্গে যুক্ত থেকে ২০১৭ সালে ইস্তফা দেন।

২০২১ সালে মিজানুর রহমান আরিয়ান নির্মাণ করেন ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’ ওয়েব ফিল্ম। ওটিটি প্লাটফর্মে সোমেশ্বর অলির কাজ শুরু হয় ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’ ওয়েব ফিল্মে ‘রুপকথার জগতে’ গানটি লেখার মাধ্যমে। গানটি এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের প্রোফাইলে ঘুরে বেড়ায়। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন রেহান রাসুল ও অবন্তি সিঁথি। ‘এক রূপকথার জগতে/ তুমি তো এসেছ আমারই হতে/ কোনো এক রূপকথার জগতে/ তুমি চিরসাথী আমার, জীবনের এই পথে…’। গানটি লিখেছেন সোমেশ্বর অলি, সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন সাজিদ সরকার। ইতোমধ্যে গানটি সাড়ে চার কোটি মানুষ শুনেছে। সোমেশ্বর অলির কথায়, সাজিদ সরকারের সুরে, ইব্রাহিম কামরুল শাফিনের কণ্ঠে বন্ধু দিবসের গান ‘চল বন্ধু চল’ বেশ সাড়া ফেলেছিল। জি ফাইভের ওয়েব ফিল্ম ‘যদি কিন্তু তবুও’-তে গানের কথা লিখেছেন অলি। সুর-সংগীত করেছেন কলকাতার অম্লান।

বড় পর্দায় সোমেশ্বর অলির প্রথম কাজ শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’ সিনেমায়। ‘ঈশ্বর’ শিরোনামের গানটি লেখেন তিনি। গানটিতে সুর করেন প্রিন্স মাহমুদ এবং কণ্ঠ দেন রিয়াদ। এই গানের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো প্রিন্স মাহমুদ আর সোমেশ্বর অলির একসঙ্গে কাজ করেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এই গানটির মাধ্যমে সোমেশ্বর অলি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন। তুমি এই রোদের মতো

আমি তোমায় মাখছি গো,

তুমি এই মেঘের মতো

বৃষ্টির আশায় থাকছি গো।

ভাবি যেতে যেতে থেমে

সেই দেখা শেষ দেখা না হোক,

তোমার আমার প্রেমের

আমি কি একাই স্মৃতির বাহক।

তুমি সব ভালো আমার

তুমি সব আলো আমার,

অন্ধকার তো না,

তবে কি বৃথা যাবে প্রেম প্রার্থনা।

ঈশ্বর কি তোমার আমার

মিলন লিখতে পারতো না?

মোস্তফা কামাল রাজের ‘ওমর’ সিনেমায় যুক্ত ছিলেন সোমেশ্বর অলি। তার লেখা গানে প্রায় পাঁচ বছর পর সিনেমায় কণ্ঠ দেন সংগীতশিল্পী আরফিন রুমি। ভারতের স্যাভির সুর-সংগীতে ‘দুই নয়নের মণি’ শিরোনামের গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। গানের কথা লিখেছেন সোমেশ্বর অলি।

‘ঈশ্বর কি তোমার আমার মিলন লিখতে পারতো না!’ গান লেখার মাধ্যমে শ্রোতাদের কাছ থেকে তুমুল ভালোবাসা পেয়েছিলেন সোমেশ্বর অলি। ‘স্বপ্নধরা বিএফডিএ এওয়ার্ড’ এ এই গানের জন্য ২০২৩ সালের সেরা গীতিকারের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি। ‘ঈশ্বর’ গানটির কথা কিভাবে মাথায় এলো জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘ঈশ্বর কি তোমার আমার মিলন লিখতে পারতো না’ এই লাইনটা আগে থেকেই আমার লেখা ছিল। আমার প্রচুর লেখা রয়েছে অসম্পন্ন। কখনো কখনো সেগুলো বেশ কাজে দেয়। এবারও তাই হয়েছে। হিমেল আশরাফের কাছ থেকে গল্পটা শোনার পরই মনে হয়েছিল এই লাইন নিয়ে গানটি লেখা যায়। হলোও তা-ই। ৫-৭ দিনের মধ্যে লিখে ফেলি পুরো গান, বেগ পেতে হয়নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনো শব্দ সংযোজন, সংশোধন বা বাদ দিতে হয়নি।

২০২৩ সালে বইমেলায় ‘কিছুটা উপর থেকে মানুষ দেখতে ভালো লাগে’ নামে কবিতার বই প্রকাশ করেন। জনপ্রিয় এসব গান লেখার পরেও পর্দার অন্তরালেই থাকেন তিনি। নামে নয় কাজের মাধ্যমে শ্রোতাদের মাঝে থাকতে চান। ২০২৫ সালের নতুন বই প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশ ও কলকাতার বেশ কিছু সিনেমার গান লেখা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। যা সামনের বছর ধারাবাহিকভাবে শুনতে পারবেন শ্রোতারা।

সোমেশ্বর অলির লেখা জনপ্রিয় কিছু গান: মিফতাহ জামানের ‘তাই তোমার খেয়াল’, মাহতিম শাকিবের ‘বুকের বাঁ পাশে’, ‘না থাকা জুড়ে’, ‘মুঠোর ভেতর তুমি নেই’, লুৎফর হাসানের ‘আমার আকাশ পুরোটাই’, ‘আয়না দিয়ে ঘর বেঁধেছি’, ‘খরচাপাতির গান’, ঐশীর ‘মায়া’, তানজীব সারোয়ারের ‘ভেজা ভেজা চোখ’, ‘বোহেমিয়ান’, তাহসান-পূজার ‘একটাই তুমি’, সুমন কল্যাণের ‘ছাতার কারিগর’, ‘সুইসাইড নোট’, বেলাল খানের ‘দোযখ’, ‘দোলার জোছনা’, ইমরান ও কনার ‘শূন্য থেকে আসে প্রেম’, তাহসিনের ‘মন ভালো হয়ে যায়’, ‘সান্ত্বনা’, ‘নরকবাস’, ‘তুমি আমারই’, জয় শাহরিয়ারের ‘আমি নেই’, পথিক নবীর ‘জোড়া শালিক’, কুদ্দুস বয়াতী-প্রীতম হাসানের ‘আসো মামা হে’।

সোমেশ্বর অলির লেখা থেকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক আলোচিত গানের। তার লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন দেশের নবীন থেকে প্রবীণ অনেক শিল্পী। অলির লেখা শ্রোতাপ্রিয় গানের সংখ্যাও কম নয়। নিজের অজস্র গান অপ্রকাশিত রয়েছে যা বহুকাল আগে লিখে রেখেছিলেন। সেই গানগুলো প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × one =