সৌরশক্তি: বিদ্যুৎ সংকটের স্থায়ী সমাধান

হক মো. ইমদাদুল

ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন ক্রমশ বিদ্যুতের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। আধুনিক জীবনযাত্রা, শিল্প উৎপাদন এবং কৃষিক্ষেত্রের অগ্রগতির জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অপরিহার্য। কিন্তু বিদ্যমান বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার তুলনায় এখনও অনেক পিছিয়ে, ফলে লোডশেডিং, শিল্পখাতে উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়া, কৃষি সেচব্যবস্থায় বাধা এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নানা দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

এই জটিল সমস্যা সমাধানে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে মনোযোগ দেওয়া সময়ের দাবি। বিশেষ করে সৌরশক্তি হতে পারে একটি টেকসই ও কার্যকর সমাধান। এটি পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী এবং দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক। সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়ানো গেলে বিদ্যুৎ ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট: কারণ ও বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করলেও, এখনো বিদ্যুৎ সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বর্তমানে কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও ডিজেলের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই জ্বালানিগুলো আমদানি-নির্ভর এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় বিদ্যুৎ খাতে বিশাল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়। বিদ্যুৎ সংকটের মূল কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

বিদ্যুৎ সংকটের কারণ

১. জ্বালানির উচ্চ মূল্য ও সীমিত মজুদ: দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ দিন দিন কমে আসছে এবং কয়লা ও ডিজেলের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যায়।

২. লোডশেডিং ও অপর্যাপ্ত সরবরাহ: বিশেষত গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, যা বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হয় না। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘ সময় লোডশেডিং দেখা যায়।

৩. অকার্যকর বিতরণ ব্যবস্থা: বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে দুর্বল অবকাঠামো, ট্রান্সমিশন লাইন ও গ্রিডের অপ্রতুলতা বিদ্যুৎ বিতরণের সমস্যার অন্যতম কারণ। এতে বিদ্যুতের অপচয় হয় এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ব্যাহত হয়।

৪. দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা: বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ও অনিয়মের কারণে সংকট আরও গভীর হয়েছে। অনেক সময় ব্যয়বহুল প্রকল্প নেওয়া হলেও সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না।

৫. পরিবেশগত ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ: বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতা যেমন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদ, আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও জটিলতা দেখা যায়। ফলে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দেয়।

৬. বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার না বাড়ানো: বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম। সৌর ও বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখনও খুব সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। যদি এই খাতকে গুরুত্বসহকারে সম্প্রসারণ করা হতো, তাহলে সংকট অনেকাংশে কমানো সম্ভব হতো।

বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাব্য সমাধান

বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যার মধ্যে রয়েছে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি। তবে কার্যকর সমাধানের জন্য নিচের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা প্রয়োজন:

স্থানীয় গ্যাস ও কয়লার যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের প্রসার।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে দক্ষতা বৃদ্ধি ও দুর্নীতি প্রতিরোধ।

ট্রান্সমিশন ও বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন।

সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের মতো টেকসই ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো।

যথাযথ পরিকল্পনা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট নিরসন করা সম্ভব এবং টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

সৌরশক্তি: বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের টেকসই সমাধান

বর্তমান বিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। এর মধ্যে সৌরশক্তি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিবেশবান্ধব শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ, একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে, বিদ্যুৎ সংকটের মোকাবিলায় সৌরশক্তিকে কাজে লাগাতে পারে।

সৌরশক্তির সম্ভাবনা ও বাংলাদেশে এর গুরুত্ব

বাংলাদেশ একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ, যেখানে বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক এলাকা জাতীয় গ্রিডের আওতার বাইরে রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সৌরশক্তি হতে পারে একটি কার্যকর ও টেকসই সমাধান।

বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন এক অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে প্রচুর সূর্যালোক পাওয়া যায়। দেশের দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো সৌরশক্তির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। গ্রীষ্মকালে দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা সূর্যের আলো পাওয়া যায়, যা সৌরশক্তি উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত।

সৌরশক্তির সুবিধাগুলো

১. প্রাকৃতিক ও সহজলভ্য: সৌরশক্তি একটি প্রাকৃতিক শক্তি যা সহজলভ্য এবং নিঃশেষযোগ্য নয়। বাংলাদেশে সারাবছর পর্যাপ্ত সূর্যালোক পাওয়া যায়, যা এই শক্তির অন্যতম প্রধান সুবিধা।

২. খরচ সাশ্রয়ী: একবার সৌরপ্যানেল স্থাপন করলে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এটি সাধারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুলনায় অনেক বেশি সাশ্রয়ী। যদিও প্রাথমিক ব্যয় কিছুটা বেশি, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।

৩. পরিবেশবান্ধব: জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যেমন কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি করে, সৌরশক্তি তেমন কোনো দূষণ সৃষ্টি করে না। এটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

৪. গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ: বাংলাদেশের অনেক গ্রাম এখনো জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের আওতায় আসেনি। সেখানে সৌরবিদ্যুৎ একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। সৌর প্যানেল ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব।

বাংলাদেশে সৌরশক্তি ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা

সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে বাংলাদেশে সৌরশক্তির ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং সরকারি দফতরে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (IDCOL)’ এর মাধ্যমে দেশের অনেক গ্রামে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৬০ লাখেরও বেশি সৌরবিদ্যুৎ ইউনিট বসানো হয়েছে, যা লক্ষাধিক পরিবারের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করছে।

সৌরশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

সৌরশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হলে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

১. প্রাথমিক বিনিয়োগ ব্যয়: সৌর প্যানেল ও ইনভার্টারের খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা এবং সহজ কিস্তিতে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।

২. প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: সৌরশক্তির ব্যাটারি প্রযুক্তি এখনো ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদী নয়। ব্যাটারির স্থায়িত্ব বাড়াতে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

৩. নগর ও গ্রামীণ অবকাঠামো: শহর ও গ্রামে সৌরশক্তি ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত অবকাঠামো তৈরির প্রয়োজন। বিশেষ করে, অফিস, স্কুল, হাসপাতাল ও কলকারখানায় সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

জাপানের নবায়নযোগ্য শক্তির সাফল্য

জাপান নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। ২০১১ সালের ফুকুশিমা পরমাণু দুর্ঘটনার পর দেশটি সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তির ওপর গুরুত্ব বাড়িয়েছে। বর্তমানে দেশজুড়ে হাজারো সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যা বিদ্যুৎ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানের কিউশু, চুগোকু এবং হোক্কাইডো অঞ্চলে বড় বড় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যেখানে লাখ লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।

বাংলাদেশও যদি যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তবে জাপানের মতো সৌরশক্তির ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের উষ্ণ আবহাওয়া এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোকের কারণে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বাংলাদেশ নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

সৌরবিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

সৌরবিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করতে হবে:

১. প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমাণ: সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায় বড় বড় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব।

২. সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ: সরকারকে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য নীতি সহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে কর সুবিধা, সহজ ঋণ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

৩. বিনিয়োগকারীদের লাভ: সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর পর পরিচালন ব্যয় তুলনামূলক কম, ফলে দীর্ঘমেয়াদে এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভজনক হতে পারে।

৪. নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ: সৌরবিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সোলার প্যানেল উৎপাদন, ইনস্টলেশন, রক্ষণাবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব।

বাংলাদেশে সৌরশক্তির প্রসারে করণীয়

বাংলাদেশে সৌরশক্তির প্রসার ঘটাতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে:

²  সোলার প্যানেল স্থাপনে ভর্তুকি: সাধারণ জনগণ ও শিল্পকারখানাগুলোর জন্য সরকার সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনে ভর্তুকি ও সহজ ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা নিতে পারে।

²  নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ: প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন, যা সৌরশক্তি গবেষণা, উন্নয়ন এবং পরিকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত হবে।

²  কর সুবিধা প্রদান: সৌরশক্তির উপকরণ আমদানিতে শুল্ক কমানো হলে ব্যয় কমবে এবং জনগণ আরও সহজে সোলার প্যানেল স্থাপন করতে পারবে।

²  বিল্ডিং কোডে সোলার প্যানেল বাধ্যতামূলক করা: নতুন নির্মিত ভবনগুলোর ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন বাধ্যতামূলক করার আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা শহরাঞ্চলে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রবৃদ্ধি ঘটাবে।

নবায়নযোগ্য এবং টেকসই: সৌরশক্তি একটি নবায়নযোগ্য শক্তি উৎস, যা প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল এবং কখনও শেষ হবে না। এটি টেকসই শক্তির একটি আদর্শ উদাহরণ, যা পরিবেশের উপর কোনও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না। সৌরশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে, আমাদের শক্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব।

শক্তির খরচ কমানো: যদিও সৌরশক্তির প্রাথমিক বিনিয়োগ কিছুটা বেশি, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি শক্তির খরচ অনেক কমিয়ে আনতে সক্ষম। সৌর প্যানেল স্থাপনের পর, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া যায়, যা দীর্ঘদিন ধরে সাশ্রয়ী হতে থাকে। এর ফলে, গ্রাহকরা তাদের বিদ্যুৎ বিলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাশ্রয় করতে পারেন, যা পরিবারের আর্থিক বোঝা কমাতে সাহায্য করবে।

বিকেন্দ্রীকৃত শক্তি উৎপাদন: সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন স্থানীয়ভাবে করা সম্ভব, যার ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য কেন্দ্রীয় গ্রিডে নির্ভরশীলতা কমবে। এটি বিকেন্দ্রীকৃত শক্তি উৎপাদন মডেলকে সমর্থন করে, যা গ্রামাঞ্চলসহ দূরবর্তী এলাকাগুলিতে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সাহায্য করবে।

কার্বন নিঃসরণ কমানো: সৌরশক্তি ব্যবহার করলে জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতা কমে যাবে, যার ফলে কার্বন নিঃসরণ এবং অন্যান্য পরিবেশগত দূষণ হ্রাস পাবে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে এবং বাংলাদেশের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি: সৌরশক্তির প্রসার বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। সৌর প্যানেল উৎপাদন, ইনস্টলেশন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এতে দেশের কর্মক্ষম জনশক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।

উপসংহার

সৌরশক্তি বাংলাদেশের জন্য শুধু বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের একটি বিকল্প নয়, বরং এটি হতে পারে একটি সমৃদ্ধ, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের ভিত্তি। অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রত্যন্ত গ্রামের প্রতিটি ঘর আলোকিত করতে পারে এই সৌরশক্তি। বিদ্যুতের অভাবে যারা এখনো আধুনিক জীবনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাদের জন্য সৌরশক্তি হতে পারে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার।

আমাদের কৃষক যখন মাঠে কাজ করেন, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যখন গভীর রাতে পড়াশোনা করে, তখন বিদ্যুৎ তাদের জন্য একটি অপরিহার্য চাহিদা হয়ে ওঠে। অথচ বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে বহু মানুষ প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সৌরশক্তি যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে এই সংকটের চিরস্থায়ী সমাধান সম্ভব। শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে।

এটি শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে খরচ সাশ্রয়ী ও দেশের অর্থনীতির জন্য এক বিশাল সুযোগ। বিদেশ থেকে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে, দেশীয় প্রযুক্তি ও সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে সৌরশক্তি আমাদের জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি হতে পারে। এতে একদিকে যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমবে, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে।

কিন্তু এই বিপ্লব সফল করতে হলে সরকারের দূরদর্শী নীতি সহায়তা, বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ, প্রযুক্তিগত গবেষণা এবং সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা জরুরি। সরকারের উচিত সোলার প্যানেল স্থাপনে ভর্তুকি প্রদান, সহজ ঋণের ব্যবস্থা করা এবং নবায়নযোগ্য শক্তির গবেষণাকে উৎসাহিত করা। পাশাপাশি জনগণেরও সচেতন হতে হবে—সৌরশক্তি শুধু ভবিষ্যতের নয়, এটি বর্তমানেরও বাস্তব সমাধান।

উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে বাংলাদেশ একটি নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। যদি আমরা এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করি, তবে একদিন আমাদের গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর সবই সৌরশক্তির আলোর মিছিলে যুক্ত হবে, এবং বাংলাদেশ সত্যিকারের সবুজ শক্তির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলতে পারি একটি টেকসই ও শক্তিশালী বাংলাদেশ!

হক মো. ইমদাদুল, জাপান: লেখক, সংগ্রাহক ও গবেষক 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × three =